৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাস্তবতার সংখ্যা দিয়েই সমাধানের গণিত কষতে হবে

-

ডলার সঙ্কট, বৈশ্বিক মন্দার-আভাস, করোনার রেশ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মতো কারণ একত্রিত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। রেমিট্যান্স কমেছে। রফতানিও কমেছে। মধ্যমানের অর্থনীতিতে উত্তরণের অতি আশাবাদ ও আগাম উচ্ছ্বাসের কারণে বৈদেশিক সাহায্যের ঝুড়িটিও আকারে ছোট হয়ে এসেছে। এহেন একটি উদীয়মান অর্থনীতি কি পারবে এতগুলো নেতিবাচক প্রভাব রুখতে? রফতানি কমে যাওয়ার শঙ্কা বহুদিন ধরেই ছিল। কারণ এ দেশের বড় বড় বাজার সবই কমবেশি মন্দাক্রান্ত। তৈরী পোশাক রফতানি ‘পারফরম্যান্সে’ নিরাশাজনক অধোগতি দেখে তেমনটিই ধারণা করা যাচ্ছিল। রফতানি কমার একটি বড় কারণ, পৃথিবীর প্রায় দেশের মুদ্রামানের বিপরীতেই ডলারের মূল্যমান ঊর্ধ্বগতি। বেশির ভাগ রফতানিতেই মূল্য নির্ধারণ হয় মার্কিন ডলারে। এমনকি ভারত ও চীনে রফতানির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বাংলাদেশের রফতানিকারকরা বহুদিন ধরে তৃতীয় মুদ্রা অর্থাৎ ডলারের মাধ্যম পরিত্যাগ করে বা মুদ্রা ‘swap’ না করে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রাবিনিময় চালু করার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যাপ্ত ভারতীয় রুপি বা চীনা ইউয়ান (আরএমবি) না থাকায় ব্যাংকগুলোও রুপি, রিংগিত কিংবা ইউয়ানে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। তা ছাড়া এ জন্য দ্বিপক্ষীয় মুদ্রাবিনিময় চুক্তিও নেই। থাকলে মালয়েশিয়ার রিংগিত বা ইন্দোনেশিয়ার রুপি একবার টাকা থেকে ডলার করে আবার ডলার থেকে রুপি, ইউয়ান, রিংগিত বা সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রায় রূপান্তরের লোকসান ঠেকানো যেত।

ডলারের তেজস্বিতার সঙ্গী হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সবাই শুধু হেরেই চলেছে। কেউ প্রত্যক্ষ কেউ পরোক্ষ। জিততে পারছে না কোনো পক্ষই। রাশিয়ার সম্পদ আছে, তেল-গ্যাস কার্যত অফুরন্ত। কিন্তু আমেরিকার মোড়লিপনার কারণে তারাও ‘Sanction’ এবং ‘Embrgo’-এর শিকার। তাদের নগদ তারল্য বাজেয়াপ্ত। তার মিত্রদের গোলাবারুদ আছে। তাদের নগদ ডলার নেই। থাকলেও দেয়ার উপায় নেই। চীনও সেই গতিতে এগিয়ে আসছে না, যে গতিতে রাশিয়া একদিন ‘মনরো ডকট্রিন’ বা ‘ডালেস ডকট্রিনের’ বিপরীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে তার মিত্রদের পুনর্গঠনে এগিয়ে এসেছিল। রাশিয়ার অনেক দোষ। তবে সমাজতান্ত্রিক সংহতির একটি বৈশ্বিক প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। এই মহাসঙ্কটে তাদের পাশে কার্যত কেউ নেই। আর এই অসহযোগিতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে আমেরিকা ও তার উত্তর আটলান্টিকের মিত্ররা। মাঝখান থেকে বলীর পাঁঠা হচ্ছি আমরা। আমাদের দেশে ‘মানবাধিকার’ দেখার বা ‘বাল্যবিয়ে’ ঠেকানোর বহু পক্ষ আছে। আমাদের জন্য অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করার কেউ নেই। মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা দিশেহারা। গোটা অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চলেছে অনিরাময়যোগ্য কুষ্ঠরোগের লক্ষণ।

জাতীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে সামগ্রিক নেতিবাচক অর্থনীতির প্রভাব। দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মূল ভাণ্ডারই হলো সঞ্চয়। বর্তমানের ভোগ ত্যাগ করে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের জন্যই মানুষ সঞ্চয় করে। ব্যক্তির সঞ্চয় জাতীয় সমষ্টি রূপে বিনিয়োগে খাটে। তাতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটে। সঞ্চয় যত বেশি হয়, প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। একটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপি-সঞ্চয় অনুপাত তীব্রভাবে নেমে গেছে। এতে বলা হয়েছে- ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির সাথে জাতীয় সঞ্চয় অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৩১.১৪, ৩২.৪২, ৩০.৭৯ ও ২৫.৪৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ থেকে সঞ্চয়ের হার কমতে শুরু করেছে বা সঞ্চয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে।

বাংলাদেশে জিডিপি-সঞ্চয় অনুপাত হওয়া উচিত কম করে হলেও ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। তিন-চার বছর আগেও সে রকমটি ছিল। সঞ্চয় বৃদ্ধির পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে তা কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। আমরা এমনিতেই পুঁজির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছি না রাষ্ট্রীয় অপচয় এবং নির্বাহী পর্যায়ে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে। সরকার সব পর্যায়ে কৃচ্ছ্র সাধনের ওপর জোর দিলেও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও সর্বব্যাপী অব্যবস্থার রাশ টানা সম্ভব হয়েছে এমন দাবি করাই যাবে না। শুধু কোভিড, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বিশ্বজোড়া মন্দাব্যবস্থার অজুহাত দেখিয়ে কি বাস্তব সত্যকে আড়াল করা যাবে? কেউ যখন দায়িত্ব এড়াতে চায়, তখনই অজুহাত তালাশ করে এবং দোষারোপের পাত্র ও পরিস্থিতির তো কোনো অভাব কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। সঞ্চয় বাড়ানোর অনেক ইতিবাচক পথ আছে। সঞ্চয়কে আকর্ষণীয় করতে হলে সঞ্চয়ের সুদের হার বাড়াতে হয়। এতে আপাত দৃষ্টিতে লোকসান মনে হলেও কার্যত বর্ধিত সঞ্চয়ের কলেবর ঘুরে আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ হয়েই ফিরে আসে।

নেতিবাচক গতিপ্রকৃতি দেখে যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, তাদের রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ছে। এক দিকে প্রবাসীদের পাঠানো উপার্জন কমেছে। রফতানি বাজার ছোট হয়ে আসছে। বৈদেশিক ঋণ-দায় কমছে না; বরং সুদাসলে চক্রাকারে বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো চেপে বসেছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কী? টানেলের অপর প্রান্তে আলোর দেখা মিলছে কি? মনে হয় না, কারো কাছে নতুন কোনো আশাবাদ জাগানোর সুখবর আছে। আমরা তাহলে যাচ্ছি কোথায়? মুদ্রা তহবিলের ‘প্রেসক্রিপশনে’ তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর কথা ফের শোনা যাচ্ছে। এর অর্থ হবে- ২০২৬-এ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্থানের আগে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কারণে এসব মৌলিক সেবাপণ্যের দাম আরো কয়েক দফা বাড়বে। সরকার মুদ্রা তহবিলের কাছে জুলাইয়ে (২০২২) ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল। সম্প্রতি তহবিলের প্রতিনিধিরা ঢাকা সফরে আসায় ভর্তুকির কথা আবার উঠে এসেছে। তহবিলের ব্যবস্থাপত্র অযৌক্তিকও নয়। ঠিকই তো। যে সব সরকারি কর্মকাঠামো বা সরকারি ব্যবসায় উদ্যোগ ‘ক্রনিক’ লোকসানে আকীর্ণ, এখন সেগুলো জাতির ঘাড় থেকে নামানোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। লোকসানি পাবলিক এন্টারপ্রাইজ বেশির ভাগই বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে। তাহলে বাকিগুলো লোকসান দিতেই থাকবে, জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ করতেই থাকবে এবং এক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ ক্ষমতাশালী মানুষ সেগুলো ভোগদখল করতেই থাকবে কোন যুক্তিতে? পাবলিক এন্টারপ্রাইজ যদি লাভের মুখ কোনোদিনই দেখতে না পায় তবে সেগুলো অন্যান্য লোকসানি প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে বাধা কোথায়? সরকার বলছে এবং বলতেই থাকবে যে, ভর্তুকি কমানো হলে দাম বাড়াতে হবে। একবার-দু’বার নয়, বিগত দেড়-দুই বছরে বারবার সরকারি খাতের তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। উপরন্তু কৃচ্ছ্রের নামে উৎপাদন ও প্রবাহ কমানো হয়েছে। এনার্জি রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ তাহলে কী করছে? তারা প্রতিবাদ করে বলছে না কেন যে, আর কতবার তেল-গ্যাস-বিজলির দাম বাড়ানো হবে? মুদ্রা তহবিলের কথা শুনে ভর্তুকি কমাতে পণ্য বা সেবামূল্য হার বাড়াতেই হবে, এ কেমন কথা?

দাম না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কার, সঙ্কোচন ও অপব্যয়-অপচয় কমিয়েও তো ভর্তুকি যুক্তিযুক্ত করার ইতিবাচক পথ আছে। সরকার যে খাতে যে ঋণ নিচ্ছে সেই সংশ্লিষ্ট খাতকেই ভর্তুকির ব্যবস্থা সম্পাদন করতে বলতে হবে। প্রকল্পের পর প্রকল্প না বাড়িয়ে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ধরে রেখেও অপব্যয়-অপচয় কমানোর পথ আছে। টিসিবি, সুগার অ্যান্ড ফুড, বিসিআইসি, বিআরটিসি, বিজেএমসি, বিটিএমসি, বিআইডব্লুটিসি, বিআইডব্লুটিএ, বিএফডিসি, এফআইডিসির মতো সংস্থা বা বডি-করপোরেটগুলোকে আইএমএফের মোট তহবিল ঢেলে দিলেও তারা লাভের মুখ কোনোদিনও দেখতে বা দেখাতে পারবে না। কারণ লোকসান তাদের পুরো দেহে ‘ক্যান্সারের’ মতো ম্যালিগন্যান্সি ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কালচারই হচ্ছে, জনগণ লোকসান বহন করতেই থাকবে এবং তারা বহাল তবিয়তেই থাকবে। এর একটি হিল্লা আসলেই করা দরকার। কথায় বলে ‘Enough is enough’ এদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো আর কিছু আশা করার মতো অবশিষ্ট নেই। যখন শেষ আশাও নেই তখন টিউমার ফেলে দেয়ার মতো পাবলিক সেক্টরের এসব লোকসানি দানবকে তো জাতির ঘাড় থেকে নামাতেই হবে। যে লোকসান ও ঝুঁকি স্থায়ী রূপ ধারণ করে রাষ্ট্রের রক্তশূন্যতা চরমে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বহাল তবিয়তে থাকার বা রাখার প্রয়োজন কী? মুদ্রা তহবিল যদি না-ও বলত, তবুও তো জনহিতকর কোনো সরকারের পক্ষে উচিত নয়, সেবার নামে এহেন অবিরাম রক্ত শোষণ বহাল রাখা। বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাজেটে অর্থায়ন কৌশল প্রকৌশলীর নৈপুণ্য দিয়ে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে সার্জনকে নিষ্ঠুর বলেন আর নির্দয় যাই বলুন না কেন, তিনি সেই টিউমার রোগীর দেহে রাখবেনই না, যা ইতোমধ্যেই ‘ম্যালিগন্যান্ট’ বলে ‘বায়োপসিতে’ ধরা পড়েছে। অর্থনীতির রিপোর্টগুলোও তেমনি এই লোকসান- ক্যান্সারের ‘বায়োপসি’। এখানে আবেগ ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। কথা হবে বাস্তব সূচকের লক্ষ্যমাত্রা সূচক ধরে ধরে। সূচক মোতাবেকই বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) সাব্যস্ত হবে; সূচক অনুযায়ীই কাঠামো-সূচকের সাথে জলবায়ুগত পরিবর্তনের মতো ইস্যুকে খাপ খাওয়াতে হবে এবং বিনিয়োগ ও রাজস্ব ঝুঁকির অঙ্ক কষতে হবে। বাস্তবতার গাণিতিক পরিভাষা দিয়েই Logarithm সাজাতে হবে। সেখানে অভিমান বা আবেগের কোনো অবকাশই থাকবে না।


আরো সংবাদ



premium cement
২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার দিল্লিতে দূষণের সাথে শীতের কামড়, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি! আজ তামিলনাড়ুতে আঘাত হানবে '‌ফেনজল'! মির্জা ফখরুল ১০ দিনের সফরে আজ যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন চিন্ময় দাসের গ্রেফতারকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে : জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ গাজার উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের গভীরে ইসরাইলি ট্যাংক, নিহত ৪২ রাজধানীতে আসছে শীতের প্রচুর সবজি ওপারে রাতভর বোমার বিস্ফোরণ আতঙ্কে নির্ঘুম টেকনাফবাসী সীমান্তের ওপারে ফ্যাসিস্ট বসে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র করছে : মির্জা ফখরুল আওয়ামী শাসনামলের চেয়ে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছে সেন্টমার্টিনে বছরে দেড় লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে

সকল