৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রশাসনিক নজরদারি প্রয়োজন

- ছবি : সংগৃহীত

দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনালে কিছু ভাসমান মানুষকে সব সময় ঘুরতে দেখা যায়। তাদের ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি, সংসার, থাকার জায়গা আছে বলে মনে হয় না। তারা গৃহী মানুষ না। গৃহী হলে গৃহে থাকত। ক্ষেত-খামারে, কল-কারখানা, দোকান বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। অহেতুক টার্মিনাল বা স্টেশনে বসে সময় নষ্ট করত না। লোক- তা মহিলা বা ছেলে বুড়ো যেই হোক না কেন, এদের বসে থাকা, আড্ডা মারা, ঘোরাঘুরি করা স্বাভাবিক পর্যায়ে পড়ে না। আসলেই এদের বেশির ভাগ স্বাভাবিক জীবনের মানুষ না। এদের পেশা ভিন্ন। এরা জনসমাগমপূর্ণ স্থানে নিজেদের মতলব চরিতার্থ করার জন্য হাজির থাকে। এরা বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাঘুরি করলেও দল আছে বলে জানা যায়।
চুরি, ছিনতাই, গাঁট কাটা, অজ্ঞান পার্টি যত অপকর্ম আছে সবই হয় টার্মিনাল বা স্টেশনগুলোতে। এগুলো ভ‚তে করে না, মানুষই করে। উটকো লোকজন দ্বারা এসব অপকর্ম হয় তা হয়তো পুলিশের খাতাতেও লেখা থাকে। এদের মাঝে মধ্যে উচ্ছেদও করা হয়। আবার বানের শ্যাওলার মতো এরা এসে পড়ে পূর্বতন স্থানে।

ঝালমুড়ি, চানাচুর ভর্তা, পানদোক্তা, চা-সিগারেট, ডাব, কোল্ডড্রিঙ্কস, চকোলেট এগুলো স্টেশন বা টার্মিনালে বিক্রি হয়। বিক্রেতাদের ঢালাওভাবে ‘বাটপাড়’ বলাও উচিত নয়। কারণ তারা এগুলো বিক্রি করে রুজি জোগায়। অথচ এরই ছদ্মাবরণে লুকিয়ে আছে সামাজিক অপরাধীরাও। এরা এসব বিক্রির আড়ালে অপরাধী কাজকর্ম করে। মানুষকে খাবার খেতে প্রলুব্ধ করে থাকে। বা পানীয়তে মিশিয়ে দেয় অচেতন করার ওষুধ। সে ওষুধ যার পেটে যায়, সে হয়ে পড়ে অচেতন। আর ঝোপ বুঝে তার সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় অচেতন পার্টি। মানুষ শুধু অচেতনই হয় না, বেশি মাত্রার ওষুধে প্রাণ হারায়। কেউ দয়াপরবশ হয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও দেখা যায় জ্ঞান আর ফেরে না। কেউ কেউ সুস্থ হলেও স্মৃতিশক্তি হারায়, মস্তিষ্কের ও শারীরিক ক্ষতি তো আছেই।

অনেক দিন আগে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের কোনার রাস্তায় সারা শরীরে দগদগে বড় বড় ঘা নিয়ে ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া এক অপ্রকৃতিস্থ তরুণকে দেখেছিলাম। ট্রাফিক পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য ধমকাচ্ছিল। ছেলেটির বোধশক্তি ছিল না বুঝা যাচ্ছে অথবা শারীরিক সামর্থ্য। আমি ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, ছেলেটি স্কুটার চালক ছিল। অচেতন পার্টি তাকে বিষাক্ত কিছু খাইয়ে স্কুটার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল, সেই আঘাতেই তার সারা শরীরে ঘা আর বোধশক্তি হারা। ট্রাফিক পুলিশ বা পুলিশ জাতীয় মানুষ মানুষের সাথে কথা বলে না সাধারণত। কিন্তু ওই পুলিশকে আমি বলেছিলাম, ‘আপনি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেননি কেন?’ উনি উত্তরও দিয়েছিলেন যে, ‘এ ধরনের কেস নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া সমস্যা, রোগীর স্বজন না থাকায় ওষুধ কিনে দিতে হয়, খরচ করতে হয়, সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? তাই ঝামেলা নিতে চায় না কেউ।’ কার ছেলে কোথায় এভাবে বেঘোরে অচেতন পার্টির কাছে জান কোরবান দিলো সে খবর কেউ নিলো না। এভাবে স্টেশনে স্টেশনে, টার্মিনালে, লঞ্চে, গাড়িতে, বাসেও আক্রান্ত হয় যাত্রীরা। কয়েক মাস আগে কমলাপুর স্টেশনে এক বয়স্ক দম্পতি এদের শিকার হয়েছিলেন। খুব সম্ভব, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদেরই একজন মারাও যান।

এরকম কাহিনী অনেক আছে। পুলিশ প্রশাসনও তৎপর, অপরাধীরাও তৎপর। এভাবে টিকে আছে অসৎ পেশা, মাঝখানে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। শুধু অচেতন পার্টিই বলি কেন, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বরাবরই ব্যাগ কাটা, মোবাইল টানা পার্টি আছে। ভিড়ের মধ্যে হোক আর যাত্রীর অসতর্কতাতেই হোক যেকোনোভাবেই যাত্রী হারাতে পারে তার দামি জিনিস। কেউ কল্পনাও করে না বোরকা পরে নিরীহ মানুষ বা ভিক্ষুক সেজে অথবা ট্রেনিং শিশুদের দিয়ে অপতৎপরতাগুলো চলছে। জিনিস খোয়া গেলে তখন হা-হুতাশ। ঝামেলা মনে করে কেউ এসব নিয়ে থানা-পুলিশ করে না। করে লাভ নেই জেনেই করে না। অসামাজিক কাজ, মাদক বেচাকেনা তাও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টার্মিনাল বা স্টেশনে, যানবাহনে- এর বিহিত তো হওয়াই দরকার। অপরাধীরা কখনো মনে করে না, তারা অপরাধ করছে। এই সীমা তারা দেখাতে পারে তাদের গডফাদারদের জন্য। কাজেই অভিযান হতে হবে অন্য গডফাদারদের বিরুদ্ধে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। সেই যাত্রাটা নিরাপদ হওয়া চাই। মোবাইল, ব্যাগ, ঘড়ি, কানের দুল, টাকা ইত্যাদি চুরি বা ছিনতাই হয়ে গেলে মহাবিপদ, মহাক্ষতি। যত সতর্কতাই অবলম্বন করা হোক না কেন, দেখা যায় কোনো না কোনো কিছু খোয়া যাচ্ছেই। চোখের পলকে হাওয়া হচ্ছে মূল্যবান জিনিস। মানুষের মালামালের নিরাপত্তা দেখার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রের বাহিনী আছে। তাদের কর্তব্যপরায়ণতাই অপরাধীদের দমাতে পারে।

অপরাধীদের কাছে নীতিনৈতিকতার দাম নেই। আইনের শাসন দ্বারাই তাদের শাসন করতে হয়। যানবাহনের স্টেশনে, টার্মিনালে নজরদারি বাড়িয়ে ভাসমান মানুষের অহেতুক আনাগোনা, আড্ডা উচ্ছেদ করতে হবে। নিজেদের সচেতনতা থেকে অনেক সময় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা যায়। যেমন- রাস্তাঘাট বা যানবাহনে টার্মিনালে অপরিচিত কারো সাথে খোলামেলা কথাবার্তা বা বন্ধুসুলভ আচরণ থেকে দূরে থাকা, তাদের দেয়া পানাহার, পান সিগারেট, বিড়ি নেয়া থেকে বিরত থাকা, অপরিচিত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে না বসা। কারো কাছে কোনো কিছুর জন্য সাহায্য না চাওয়া, নিজেদের দামি জিনিস, বাচ্চাকাচ্চা সাবধানে রাখা। যান বাহনে এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের দলের মধ্যে গল্প বলে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এদের মুগ্ধ শ্রোতা জোটে। শ্রোতাদের মুগ্ধতা সৃষ্টি করে অন্যরা যাত্রীর মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে। এই বিষয়গুলো অনেকেই জানেন। জেনেও ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। আরো সচেতনতাই পারে এই বিরূপ পরিস্থিতি থেকে সাবধান থাকার।

টার্মিনাল বা স্টেশনে নাকি মাদককারবারি, জুয়াড়িরাও আসর বসায়। ওই সব স্থানে তো বাহিনীর লোকজনও থাকে। তারা যথাযথ তৎপরতা দেখালে অবশ্যই ‘আসর’ বসানোর সাহস কারো থাকার কথা নয়। কিন্তু কিভাবে কী হচ্ছে তা রহস্য। কে না জানে, মাদক-জুয়ার হাত ধরেই আসে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ। স্টেশন বা টার্মিনাল ঘিরে গড়ে ওঠা এইসব খারাপ মানুষের আড্ডা তুলে দিতেই হবে।

যাত্রাপথে নাকে চেতনানাশক দ্রব্য দেয়া রুমাল বা টিস্যুপেপার ধরে যাত্রীদের অচেতন করে লুটপাটের খবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি। মানুষ নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন ঘরের বাইরে বের হয়।

চাকরি-বাকরি, পড়াশোনা, হাসপাতালে যাত্রা, ঘুরে বেড়ানো, ব্যয়াম, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদির কারণে প্রতিদিন লাখে লাখে মানুষ পথে বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন দুর্বৃত্ত পার্টির লক্ষ্যই এই আদম সন্তানেরা। কে জানে তার ডান পাশ, বাম পাশ, সামনে-পেছনে কারা ছুটছে কোন মতলবে। অনেক সময়ই কিছু আঁচ করতে পারলেও সাধারণ মানুষ দুর্বৃত্ত দলের হাত থেকে রেহাই পায় না। এদের মোকাবেলা করা সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। এর জন্য দরকার পুলিশ-প্রশাসনের শক্ত হাত। এরাই তাদের নির্মূল করতে পারে। আইনের ফাঁক দিয়ে দুর্বৃত্তরা বেরিয়ে যায়, এই অভিযোগ পুরনো। দেখতে হবে, কোনো উপযুক্ত শাস্তিতে ঠগ, জোচ্চোর, ছিনতাইকারী, প্রতারক, মাদককারবারি, অচেতন পার্টিকে শায়েস্তা করা যায়।

লেখক : সাংবাদিক, কথাশিল্পী


আরো সংবাদ



premium cement