কবে মুক্তি মিলবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে আফ্রিকা!
- মাজহারুল ইসলাম শামীম
- ৩০ অক্টোবর ২০২২, ১৯:১৭
সভ্যতার অগ্রগতির সাথে পৃথিবীর ও পরিবর্তন হচ্ছে। একইসাথে পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর বসবাসকারী মানুষের ভাগ্যও। কিন্তু শুধু পরিবর্তন হচ্ছে না আফ্রিকার জনগোষ্ঠীদের ভাগ্যের। দীর্ঘ সময় ধরে তারা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের শিকলে বন্দি হয়ে আছে। পুরো আফ্রিকার সকল নিয়ন্ত্রণ যেন ইউরোপীয়দের হাতে। আর সে সাথে আফ্রিকার হতভাগা মানুষেরা দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। যুগে যুগে আফ্রিকা থেকে সকল মূল্যবান ধাতু, যেমন : স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, লৌহা, ইস্পাত, খনিজ তেল সকল কিছু নিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা। এদিকে দিনের পর দিন অনাহারে, অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগতে হচ্ছে আফ্রিকার জনগোষ্ঠীদের। আর এই আফ্রিকায় শোষণের ঔপনিবেশিক গড়ে তোলার পিছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস। আজ আফ্রিকার জনগণ নিজ দেশে পরবাসী হয়ে রইলো।
অজস্র ভাষা আর শত শত ঐতিহ্যবাহী ধর্মের সম্মিলন ঘটেছে আফ্রিকায়। তেমনিভাবে সেখানকার সৌন্দর্য আর সম্ভাবনা টানে আগমন ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের। এতে করে আফ্রিকার মানুষের ভাগ্য ও দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দি হওয়া শুরু হলো। রাষ্ট্র বলতে আমরা যে রাজনৈতিক কাঠামোকে বুঝে থাকি আধুনিককালে, তার সূচনাও হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে। সাহারা মরুভূমির মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত আফ্রিকা মহাদেশের সাথে এশিয়ার মানুষদের সুদূর অতীত থেকেই যোগাযোগ থাকলেও ইউরোপের সাথে এর যোগাযোগ স্থাপিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে।
প্রথমে যদিও বাণিজ্যের প্রয়োজনে আসা ইউরোপীয়রা একসময় দক্ষ প্রশাসন আর প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী দ্বারা ঔপনিবেশিক করে আফ্রিকা মহাদেশের সবগুলো দেশকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর আফ্রিকাকে বিভিন্নভাবে শোষণ করেছে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, আফ্রিকা সরাসরি ইউরোপের রাজনৈতিক শাসনের অধীনে ছিল ১০০ বছরেরও বেশি সময়। এতে করে আফ্রিকা মহাদেশের সকল কিছু একে একে জিম্মি করে নিতে থাকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা। যেমনটা এশিয়া মহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা তৈরি করেছিল।
যেভাবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা প্রবেশ করলো আফ্রিকায় :
পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগালের রাজপুত্র হেনরির আগমন ঘটে আফ্রিকা মহাদেশে, ইউরোপের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয় আফ্রিকার। কাছাকাছি সময়ে ইউরোপীয় বণিকেরা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে, অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপকে যুক্ত করে পৃথিবীর সবগুলো অংশের সাথে। এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অংশে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই উপনিবেশ স্থাপন শুরু করলেও আফ্রিকাতে প্রক্রিয়া শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। শুরুর দিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহের মধ্যে ছিল আফ্রিকার সমুদ্র বন্দরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা, এশিয়ার সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য রুট তৈরি করে দেয়া দেশীয় বণিকরা। এতে করে তারা এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে রাজত্ব কায়েম করতে পারবে এবং তা পেরেছেও।
খ্রীস্টাব্দ ১৮০০-১৮৭০
ওলন্দাজদের উপনিবেশ :
ওলন্দাজ বণিক শক্তি বহু আগেই উত্তমাশা অন্তরীপ দখল করেছিল। পরে ওলন্দাজরা কেপ কলোনি ইংরেজদের বিক্রি করে দিলে তা ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে লিমপোপো নদী পর্যন্ত সুবিস্তৃত অঞ্চলে ওলন্দাজদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলের মধ্যে ওলন্দাজদের নতুন উপনিবেশগুলো। ছিল- নাটাল, অরেঞ্জ নদী উপত্যকা অঞ্ল এবং ট্রান্সভাল।
পার্তুগিজদের উপনিবেশ :
ব্যাবসা-বাণিজ্য অপেক্ষা লুঠতরাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই পর্তুগিজরা আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলে। এই পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি পর্তুগিজ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল- গিয়ানা উপকূল, শোফালা এবং অ্যাঙ্গোলা।
ফরাসিদের উপনিবেশ :
উনিশ শতকের প্রথম পাদে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়াতে ফরাসিরা প্রথম উপনিবেশ গড়ে তোলে।
এভাবে একের পর এক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক গড়ে উঠে আফ্রিকায়। আর এই ঔপনিবেশের ফলাফল দাঁড়ালো এক সময় আফ্রিকাবাসীরা তাদের স্বাধীনতা হারায়। শুধু তাই নয়, এখানকার মানুষদের বন্দি করে নিয়ে গিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা শুরু হয়। তবে একটা সময় গিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে রেনেসাঁর প্রভাবে স্বাধীনতা অর্জন আর যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ ইতি টানে ইউরোপীয়দের দাস ব্যবসায়।
বস্তুত, ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার প্রাথমিক কারণ ছিল ব্যবসা করা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের সাথে ইউরোপকে যুক্ত করা। পরবর্তী কয়েক শতকের মধ্যে ইউরোপের অর্থনীতি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় এশিয়ার সাথে বাণিজ্য। এর মধ্যেই ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয়, দ্রুত বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্যের উৎপাদন। এ পণ্য উৎপাদনের জন্য যেমন কাঁচামালের প্রয়োজন ছিল, তেমনিভাবে প্রয়োজন ছিল উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার খুঁজে বের করা। আফ্রিকার কৃষিপ্রধান অর্থনীতি সে কাঁচামাল যোগানের মাধ্যম হয়েছে। উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিস্তৃত করেছিল নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার।
দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আঁধার আফ্রিকা মহাদেশের প্রতি ইউরোপের আগ্রহের অন্যতম কারণ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল ও গ্যাসের উৎস ছিল আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলো, ক্যামেরুন, সাদ, কঙ্গোর মতো দেশগুলো। হীরকও পাওয়া যেত আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে। সোনা, নিকেল, ইউরেনিয়াম, আকরিক লোহা, অ্যালুমিনিয়ামের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের যোগান দিয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ, পশ্চিম সাহারায় পাওয়া যেত ফসফেট, কপারের মতো খনিজ পদার্থ। এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের উপস্থিতি আফ্রিকা মহাদেশকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
আবার,খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগমন ঘটে আফ্রিকাতে। আফ্রিকা মহাদেশে খ্রিষ্টান ধর্মের আগমন ঘটে প্রথম শতাব্দীতেই, বিস্তৃত হয় উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে। পরবর্তী সময়ে, সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বিকাশ ঘটে আফ্রিকায়, বিস্তৃত হয় আফ্রিকার বড় একটা অংশ জুড়ে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে নিজেদের উপনিবেশ শাসনের নৈতিক বৈধতা অর্জনের জন্য করেছে ধর্মপ্রচারের কাজও।
আফ্রিকা মহাদেশের ঔপনিবেশিক গড়ে তুলে ইউরোপ তাদের সভ্যতার অগ্রযাত্রা করতেছে। কিন্তু আফ্রিকার মানুষেরা অনেকে আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে। আফ্রিকার অনেক জনগোষ্ঠী আজও আধুনিক সভ্যতার আলো চোখে দেখে নি। ইউরোপ এক দিকে যেমন শিল্প বিপ্লব গড়াচ্ছে, অন্যদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড , বড় হচ্ছিল অর্থনীতির আকার। এরই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ইউরোপের জনসংখ্যাও। এই বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটাতে হয় ইউরোপীয় দেশগুলো, উপনিবেশ স্থাপন করে এশিয়া আর আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অভিবাসী হওয়া ইউরোপীয়রা আফ্রিকাতে এসে পায় ভূমির দখল, চর্চার সুযোগ পায় রাজনৈতিক ক্ষমতা। জনসংখ্যার এই বিকেন্দ্রীকরণ অভিবাসী হওয়া ইউরোপীয়দের এবং মূল ভূখণ্ডে থাকা ইউরোপীয়দের জীবনমান বাড়ায়।
নিজেদের নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়নের এ প্রচেষ্টাও ভূমিকা রাখে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টাকে জ্বালানি দিতে।
সুযোগের সৎ ব্যবহার কখনও করতে পারেনি আফ্রিকা। যার জন্য তাদের সারাজীবন কপাল পুড়তে হলো। ইউরোপীয়রা ঔপনিবেশিক গড়ে তুললেও প্রথম-প্রথম ম্যালেরিয়ার ভয়ে ইউরোপীয়দের দখল-দারিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করার জন্য কয়েক শতাব্দী সময় পেলেও সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে নি আফ্রিকানরা, ব্যবহার করতে পারেনি প্রকৃতি প্রদত্ত ভৌগোলিক সুবিধাগুলো। যার জন্য তাদের কখনও মুক্তি ও মেলে নি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক থেকে।আজও তারা বন্দি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকের কাছে। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যাওয়ার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ এটাই- সময়ের সাথে নিজেদের পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছিল আফ্রিকানরা, ব্যর্থ হয়েছিল নিজেদের সামষ্টিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন আর সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করলেও এখনো আফ্রিকাতে চলছে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পরোক্ষ ঔপনিবেশবাদ, চলছে শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা। আফ্রিকার ১৪টি দেশের মুদ্রা ছাপা হয় ফ্রান্সের টাকশালে, বৈদেশিক মুদ্রার ৮৫ শতাংশ জমা রাখতে হয় ফ্রান্সের কাছে, ভাড়া দিতে হয় ঔপনিবেশ আমলের নির্মিত অবকাঠামোগুলোর জন্য। আফ্রিকায় উৎপাদিত তেল আর অন্যান্য খনিজের সিংহভাগ লভ্যাংশই যায় ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের হাতে, শান্তিরক্ষী মিশনগুলো অংশ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের এ শোষণে, বিভিন্নভাবে জিইয়ে রাখছে ক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত আর সহিংসতা।
ধারণা করা হচ্ছে, পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে আরো কয়েক প্রজন্ম কে মুক্তির সংগ্রামের লড়াই করতে হবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকের বিরুদ্ধে। তবে হয়তো কখনও মুক্তি মিলতে পারে আফ্রিকার এসব শিকলে বন্দি জনগোষ্ঠীদের।
নাম : মাজহারুল ইসলাম শামীম।
শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ।
বিভাগ : ব্যবস্থাপনা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা