৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার, কতটা সত্যি

সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার, কতটা সত্যি - ছবি : সংগৃহীত

‘সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল বিএনপি সরকার।’ বক্তব্যটি শুনতে শুনতে রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে জানার ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশন টকশোতে আওয়ামী লীগের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা সমস্বরে একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন। বিগত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গড়গড়তা সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করার অভিযোগের পটভূমি এবং বিষয়টি আদৌ সত্য কিনা, তা তথ্য-উপাত্তসহকারে আলোচনা প্রয়োজন।

সংবিধানের ১১৯(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোটার তালিকা তৈরির কাজটি নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা। ভোটার তালিকা নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অচলাবস্থা সৃষ্টির খেলাটি শুরু হয় ২০০৫ সালের শেষের দিকে। ২০০৬ সালের ২৩ মে, বিবিসি বাংলা পরিবেশিত একটি সংবাদের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘নির্বাচন কমিশনের নতুন ভোটার তালিকা তৈরির শুরুতে এর বিরুদ্ধে রিট মামলা করেছিলেন আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা যে মামলায় হাইকোর্ট পুরনো ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে তালিকা তৈরির জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জানুয়ারি (২০০৬) মাসে।

হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (এম এ আজিজ) আপিলের আবেদন খারিজ করে দিলেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ একটি বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকেই নির্দেশ দিলেন ২০০০ সালের ভোটার তালিকাকেই হালনাগাদ করার। এ ভোটার তালিকার কেউ মারা গেলে অথবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে কেবল তাদের নাম বাদ দেয়া যাবে।’

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে নির্দেশনা সংবলিত হাইকোর্টের রায় এবং মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল নিষ্পত্তি হয়ে গেল। তাহলে রিট মামলাগুলো কবে শুরু হয়েছিল? প্রশ্ন এসে যায়, আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় রাষ্ট্রপক্ষে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু পালন করেছে?

এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক এক কোটি ২১ লাখ বা এক কোটি ২৩ লাখ বা গড়পড়তা সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার কি আসলে বিএনপি সরকার যুক্ত করেছিল? ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেশের মোট ভোটার সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৩৫ জন। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৈরি ভোটার তালিকায় ভোটার ছিল সাত কোটি ৪৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬৪ জন। অর্থাৎ সাড়ে চার বছরে ভোটার বেড়েছিল এক কোটি ৮২ লাখ ২৯ হাজার ৪২৯ জন। হাইকোর্টের নির্দেশনানুযায়ী ২০০০ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে হালনাগাদ করার পর ২০০৬ সালের ভোটার তালিকায় ভোটার সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ জন। এ ক্ষেত্রে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত হিসাবে ধরে সাড়ে পাঁচ বছর সময়ে ভোটার বেড়েছিল এক কোটি ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ২২৯ জন (৩.৯৭%)। এখানে সংখ্যা এবং শতকরা হিসাবেও ভোটার বৃদ্ধির পরিমাণ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৈরি ২০০০ সালের ভোটার তালিকায় ভোটার বৃদ্ধির পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। তারপরও ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার সংযুক্তির বিষয়টি ছিল, তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু।

এ আন্দোলনে আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে ২০০৬ সালের ৩ ডিসেম্বর এনডিআই নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটি জরিপের তথ্য প্রকাশ করে বলে, বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় ‘১ কোটি ২১ লাখ ভুয়া ভোটার’ আছে। এখানে সঙ্গতকারণে প্রশ্ন আসে, এনডিআই কি সারা দেশে ব্যাপকভিত্তিক কোনো জরিপ চালিয়ে ছিল? কোথায়, কখন কী পদ্ধতি অনুসরণ করে এনডিআই জরিপ চালিয়েছিল? যদি জানতে চাওয়া হয়, এক কোটি ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ২২৯ জন ভোটারের মধ্যে এক কোটি ২১ লাখ ভোটার যদি ভুয়া হয়ে থাকে তাহলে ২০০১ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে কি দেশে মাত্র ৪২ লাখ ৬৮ হাজার ২২৯ জন বেড়েছিল? অর্থাৎ ভোটার বৃদ্ধির হার ছিল কি মাত্র ১.২৫%? তখন কি আমাদের সন্তানদের তারুণ্যপ্রাপ্তি বন্ধ ছিল? সহজে অনুমেয়, ভুয়া ভোটারের ভিত্তিহীন অভিযোগটি ছিল ওয়ান-ইলেভেনের কারণ সৃষ্টির অন্যতম উপাদান মাত্র।

ওয়ান-ইলেভেনের পর মাত্র ৮১ মিলিয়ন ডলারের বিদেশী সহায়তা খরচ করে তৈরি ভোটার তালিকার অবস্থা কী? ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম. সাখাওয়াত হোসেন ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট প্রথম আলোর মতামত কলামে লিখেছেন, ‘২০০৭-২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ডেটাবেজ বা তথ্যভাণ্ডার তৈরির সফল উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রায় ১১ মাসে সম্পূর্ণ হয়েছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ। ২০০৮ সালের ভোটার তালিকায় ভোটারের সংখ্যা ছিল আট কোটি ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৮, তার মানে ২০০৬ সালের ভোটার তালিকা থেকে এক কোটি এক লাখ ৮১ হাজার ১৪৪ জন ভোটার কমেছিল।’

তাহলে প্রশ্ন, এই বাড়তি ভোটার পূর্বতন তালিকায় কেন ছিল? প্রথমত, বিগত জানুয়ারি (২০২২) মাসের হিসাব অনুযায়ী ‘এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) কর্মকর্তা বলেছেন, বিশ্বের ৪০টি দেশে মোট এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৬৪ জন বাংলাদেশী রয়েছেন এনআইডি ছাড়া (জাগোনিউজ টোয়েনটি ফোর ডটকম ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। তাই বলা যায়, ২০০৬ সালে অন্তত ৭০ লাখ বাংলাদেশী নাগরিক প্রবাসে দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। নির্দিষ্ট ফরমে স্বাক্ষর ও ছবি সংযুক্তির নিয়মে তারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েন। দ্বিতীয়ত, দ্বৈত ভোটার; জেলা শহরে, মহানগরে যারা জীবিকা বা পেশার কারণে অবস্থান করছিলেন তাদের বেশির ভাগ মানুষের শেকড় গ্রামে, তাই নিজ নিজ গ্রামে ভোটার তালিকায় নাম যুক্ত রাখতেন। এমনকি থানা সদরে যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তারাও নিজ গ্রামে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় একাধিক স্থানে ভোটার হতেন। সে সময় ভোটার তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভোটারের উপস্থিতি, নির্দিষ্ট ফরম পূরণ বা স্বাক্ষর দান বা আঙুলের ছাপ দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় সম্ভাব্য মেম্বার ও চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও শহরে এবং প্রবাসে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের নাম ভোটার তালিকায় সংযুক্ত করতেন। পদ্ধতিগত কারণে একই ব্যক্তির একাধিক স্থানে ভোটার হওয়ার বিষয়টি রোধের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ডিজিটাল ডেটাবেজ করায় দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। ২০১৯ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় এক বছরে নতুন ভোটার হয়েছেন ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০৫ জন। ‘ডেটাবেজ পদ্ধতিতে ভোটার তালিকা তৈরির পরও দ্ইু লাখ সাত হাজার ৬৩৫ জন দ্বৈত ভোটার হয়েছেন। তা উদঘাটিত হওয়ায় তাদের হিসাব থেকে বাদ রাখা হয়েছে’ (বিডি নিউজ টোয়েনটি ফোর ডটকম, ২০ জানুয়ারি, ২০২২)। অর্থাৎ দেখা যায় ২০১৯ সালে ডিজিটাল ডাটাবেজের যুগেও শতকরা ৩.৮৭% মানুষ দ্বৈত ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তাই হাতে লেখা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তৈরি করা ভোটার তালিকায় ভুলত্রæটি শতকরা ৩%, কমপক্ষে দ্বৈত ভোটার শতকরা ৭%, মোট ১০% হলে ২০০৬ সালের ৯ কোটি ১৩ লাখ ভোটারের মধ্যে ৯১.৩ লাখ বাড়তি ভোটার এবং বাদ পড়া ৭০ লাখ প্রবাসীর সংখ্যা ধরলে এক কোটি ৬১ লাখ তিন হাজার- এই বাড়তি ভোটার যুক্তিসঙ্গতকারণে থাকার কথা। সেখানে পদ্ধতিগত কারণে ২০০৬ সালের থেকে ২০০৮ সালে ডাটাবেজ হওয়ার পর ভোটার সংখ্যা মাত্র এক কোটি এক লাখ কম হওয়ার পর প্রমাণিত হয়েছে, ২০০৬ সালের ভোটার তালিকায় কোনো ভুয়া ভোটার সংযুক্ত হয়নি। বরঞ্চ ভোটার সংখ্যার অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের কারণে ২০০০ সালে তৈরি করা ভোটার তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ বলা যায়।

২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের ভোটার তালিকায় ভোটার সংখ্যা কমেছে কোথায় কোথায়? খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের তারাবো পৌরসভা, গাজীপুরের টঙ্গী পৌরসভাসহ বিভিন্ন শিল্পঘন এলাকায় ২০০০ সালের থেকে ২০০৮-এ ভোটারসংখ্যা কমেছে। আবার জাতীয় সংসদের পঞ্চগড়-২, সাতক্ষীরা-১, সিলেট-৫ ও কক্সবাজার-৪ আসনে ভোটার সংখ্যা কমেনি বরঞ্চ বেড়েছে।

২০০৭ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা ও সংবিধানবহির্ভূত একটি সরকার আনার প্রক্রিয়া ২০০৫ সালের শেষের দিকে শুরু হয়। এর একটি অংশ ছিল ভোটার তালিকার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধকরণ। পরে সোয়া কোটি ভুয়া ভোটারের ভিত্তিহীন অভিযোগ ঘিরে সরকারবিরোধী আন্দোলন, ফল হিসেবে ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল ও ১/১১ এর সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই অসত্য প্রতিষ্ঠিতর অপচেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী
e-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement