আরএসএস ও মুসলিম নেতৃত্ব
- শাকিল রশিদ
- ২৮ অক্টোবর ২০২২, ২০:০২
২০০২ সালের কথা। মুসলিম নিধন দাঙ্গার পর আমার কয়েকবার গুজরাটে যাওয়া হয়েছিল। সে সময় সেখানে অবিভক্ত জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ বড় পরিমাপে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত জাতির পুনর্বাসনের কাজ করছিল। আর মাওলানা মাহমুদ মাদানী, যিনি তখন একেবারেই তরুণ নেতা, কলোনিগুলোর নির্মাণের দেখভাল করছিলেন। এক সাক্ষাতে আরএসএস প্রসঙ্গে তিনি বললেন, সঙ্ঘ পরিবারের সাথে মুসলমানদের আলোচনার ব্যবস্থা করা দরকার। আমি মাওলানাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কি এ ব্যাপারে কোনো চেষ্টা করেছেন? জবাব ছিল হ্যাঁ সূচক। কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার পর আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি যে, মাওলানা মাহমুদ মাদানী আরএসএসের সাথে কোনো আলোচনার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন কি না। তবে এতটুকু জেনেছি, তিনি আরএসএসের মহলে মোটেও অপরিচিত নন। এর বিপরীতে তার চাচা মাওলানা আরশাদ মাদানী, যিনি জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের এক অংশের সভাপতি, তিনি শুধু আরএসএসের কাছেই নয়; বরং সঙ্ঘের চতুর শীর্ষ নেতা মোহন ভাগবতের সাথে দিল্লিতে সঙ্ঘের কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাত করেন এবং এক বিবৃতিও প্রকাশ করেন, আরএসএস এখন বদলাচ্ছে।
মাওলানা আরশাদ মাদানীর পদক্ষেপ আমিসহ অনেকেরই জুতসই মনে হয়েছিল। কেন না, সঙ্ঘ পরিবারের সাথে আলোচনার জন্য একটি দরজা খুলতে দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এ দেশের মুসলমানদের অস্থিরতায় নিমজ্জিত রাখা নানাবিধ সমস্যার সমাধান হবে; কিন্তু এখন দিল্লির পাঁচ প্রভাবশালী মুসলমান ও ইমাম ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র মাওলানা উমাইর ইলইয়াসির সাথে মোহন ভাগবতের সাক্ষাতের পর মনে হচ্ছে, মাওলানা আরশাদ মাদানির পদক্ষেপ ততটুকু যথাযথ নয়, সেই সময় যতটুকু মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, মোহন ভাগবতসহ আরএসএসের নেতারা বিভিন্ন সময় মুসলমানদের সাথে যে সাক্ষাৎ হয়েছে এবং হচ্ছে, তা মূলত আলোচনার ব্যবস্থার জন্য করেননি এবং এখনো করছেন না; বরং তাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য, সঙ্ঘের স্বার্থকে অগ্রসর করা।
আর যে সব মুসলমান মোহন ভাগবতের সাথে ওঠাবসা করছেন, মূলত ব্যবহৃত হচ্ছেন অথবা তারা চাচ্ছেন আরএসএস তাদের ব্যবহার করুক। আর এরও সম্ভাবনা আছে যে, মোহন ভাগবতের সাথে হাত মেলানো মুসলমানরা নিজেরা ‘সমস্যা’ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না। আমি ওই সাক্ষাৎকারগুলোর একটি শব্দ ছাড়া বাকিগুলোর কোনো বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছি না। ওই শব্দটি হচ্ছে ‘সমস্যা’, যা মাওলানা আরশাদ মাদানী ও মোহন ভাগবতের মাঝে সাক্ষাতের সময় বিদ্যমান ছিল এবং আজো বলবৎ আছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি যেমনকার, তেমনই আছে। এ বিষয়টিতেই আরএসএসের নেতাদের চিন্তাধারা পরিমাপ করা যায়, তারা মুসলমানদের কোর্টে বারবার বল ছুঁড়েছে, বল কখনো নিজেদের এরিয়ায় রাখেনি।
উদাহরণস্বরূপ মোহন ভাগবত ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ের একটি অভিজাত হোটেলে কয়েকজন মুসলমানের সাথে- যাদের মুসলিম সমাজের ‘ভদ্র মানুষ’ বলা যেতে পারে, সাক্ষাৎ করে তাদের কাছে এ আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘বোদ্ধা মুসলমানদের সর্বাবস্থায় উগ্রপন্থার নিন্দা করা উচিত’। এরপর তিনি তার কথার নিরন্তর পুনরাবৃত্তি করেন, এ দেশে বসবাসকারী ব্যক্তি, সে যে ভাষারই হোক না কেন, যে ধর্মেরই হোক না কেন, প্রত্যেকেই হিন্দু।’ মানুষ দেখল, তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। গণপিটুনি, লাভ জিহাদ, বন্দে মাতরম, ধর্মান্তর, অযথা গণগ্রেফতার, এনআরসি, মাদরাসা, মসজিদ, আজান, নামাজ- কত যে সমস্যা ছিল ও আছে, তিনি কখনো এগুলো সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
সম্প্রতি সঙ্ঘ প্রধান বিশেষত দিল্লির পাঁচ ‘প্রভাবশালী মুসলমান’ সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ শাহেদ সিদ্দিকী, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর জমিরুদ্দিন শাহ, সাবেক চিফ ইলেকশন কমিশনার ইন্ডিয়া এসওয়াই কুরেশি, দিল্লির সাবেক লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং ও বড় ব্যবসায়ী সাঈদ শিরওয়ানির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তবে ওই সাক্ষাৎকারে কী কথা হয়েছে তা জানা যায়নি।
শুধু এতটুকু জানা গেছে, ‘গোহত্যা’ ও ‘কাফের’ শব্দে ভাগবতের আপত্তি রয়েছে। আর এতটুকুও জানা গেছে, এই প্রভাবশালী মুসলমানরা দু’টি আপত্তির সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছেন এবং ভাগবতজি সম্ভবত আশ্বস্ত হয়েছেন। কেননা, তিনি খুশি মনেই ফেরত গেছেন। এরপর উমাইর ইলইয়াসি তাকে ‘রাষ্ট্রপিতা’ ও ‘রাষ্ট্রঋষি’ খেতাব দিয়ে আরো খুশি করে দেন। এখন উমাইর ইলইয়াসির ফতোয়াও চলে এসেছে, রাষ্ট্রপিতার কোনো কথাকে ভুল বলা যাবে না।’ এটিই সেই কথা, যার দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। আরএসএস মুসলিম নেতাদের মুখে তালা লাগানোর ও নেতাদেরকে নিজেদের অনুগত বানানোর চেষ্টা করছিল। মোহন ভাগবত এ ব্যাপারে বিশাল সফলতা অর্জন করেছেন। তিনি এক হিসেবে এক তীরে দুই শিকার করেছেন। একটি তো, মুসলিম নেতাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। অপরটি হচ্ছে- মুসলিম দেশগুলোতে পর্যন্ত এ বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, ভারতে মুসলমানরা বেশ শান্তিতে আছেন। এতটাই শান্তি যে, সঙ্ঘের নেতারা পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ করছেন ও তাদের সমস্যাবলি সমাধান করার কথা বলছেন।
এটি কি সত্য নয় যে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শানে ধৃষ্টতার জন্য মুসলিম দেশগুলোতে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের ঢেউ উথলে উঠেছিল? এটি একেবারে সত্য কথা। আর এটি সেই সত্য, যাকে ধুয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আরো একটি চেষ্টা এটাও হচ্ছে যে, মুসলমানদের তাদের ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে। এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করা হবে, সহজেই তাদের ‘ঘর ওয়াপসি’ করানো যাবে।’ ভাগবতজি বলেই দিয়েছেন, মুসলমান নিজেদের ‘হিন্দু’ বলবে। ‘ঘর ওয়াপসি’ করানোর জন্য ইসলাম ধর্মের দুর্গ হিসেবে পরিচিত মাদরাসাগুলোর ওপর সার্ভের আকৃতিতে হামলা শুরু করে দেয়া হয়েছে। সব মুসলিম নেতা- কী রাজনৈতিক কী ধর্মীয়, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সামনে অবনত মস্তক হয়ে গেছেন। মাদরাসাগুলোতে আধুনিক শিক্ষা ও তার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ভালো, কিন্তু অতিবাহিত গতকাল যে ভিত্তিতে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ছিল, সেই ভিত্তি কি আজ শেষ হয়ে গেল? আজ উসুলে হাশতগানা (দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি অষ্টক) কি অর্থহীন হয়ে গেল? আকাবিরে ওলামা, যেমন মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ., মাওলানা কাসেম নানুতুবি রাহ. প্রমুখের শিক্ষা পরিকল্পনা কি অনুপকারী ছিল?
আরো একটি প্রশ্ন, দশম শ্রেণী পাস যে ছেলেটি দ্বীনী মাদরাসা থেকে পড়ালেখা করে দারুল উলুমে ভর্তির স্বপ্ন দেখে, তার কী হবে? এক ব্যক্তি বলছিল, ‘আমাদের নেতারা সব কিছু চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। এ সার্ভে তো লোকদেখানো মাত্র। কোনো মাদরাসার কিছুই হবে না।’ যদি বাস্তবেই এমনটি হয়, তাহলে তো ভালো কথা; কিন্তু এতে বিশ্বাস হয় না। মসজিদের অবস্থা দেখুন। ফজরের আজান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, লাউড স্পিকার (মাইক) নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন তো স্বয়ং মৌলভী সাহেবরা বলতে শুরু করেছেন, ‘এমনভাবেও নামাজ পড়ানো যায়’। এটিই সেই কথা, যা মোহন ভাগবতজি পাকাপোক্ত করছেন।
আরএসএসের একটি মুসলমান ‘সন্তান’ আছে। তার নাম ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’। এর প্রধান ইন্দ্রিশ কুমার। তবে মুসলমানদের মধ্যে তার কোনো প্রভাব নেই। সঙ্ঘ মনে করছে, মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আগে অরিজিনাল আলেমদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা জরুরি। ভাগবতজি এরই চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং বিশাল পরিসরে সফলতা লাভ করেছেন। মসজিদ ও মাদরাসার পর ওয়াক্ফ সম্পত্তির সার্ভে হচ্ছে। এর পর সম্ভবত খোদ মুসলমানদেরই সার্ভে করা হবে। ভাবখানা এমন যে, মসজিদ ও মাদরাসার দায়িত্বশীলদেরই সব অপরাধ। বলা হচ্ছে, ‘মসজিদ ও মাদরাসার নামে বহু ঘাপলা ও দুর্নীতি করা হয়েছে। জাকাত পর্যন্ত আত্মসাৎ করা হয়েছে!’ এমন অপপ্রচার তো হওয়ারই কথা। এখন সেই দিন আসা বাকি, যেদিন মাদরাসাগুলোকে এমনভাবে নিষিদ্ধ করা হবে, মনেই হবে না, এটি কখনো ইসলামের দুর্গ ছিল। আর চিন্তা করবেন না, তাদেরও পালা আসছে, যারা আজ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ ও প্রতিবাদ করছে। সফুরা জারগারের অবস্থা দেখুন।
শাহীনবাগের সহায়তা ও এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলাফল সামনে রয়েছে; এদের জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রিসার্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কয়েকজন অমুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট ছাড়া কোনো মুসলিম নেতা মুখ খুলেননি, খুলবেনও না। খুব বেশি দিন লাগবে না, দল-সংগঠন-সংস্থার পালাও আসবে। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই) দিয়ে শুরু করা হয়েছে। এই ফ্রন্টের অপরাধটা কী? তাদের অপরাধ এটিই, তারা মুসলমান, সংখ্যালঘু, দলিত ও পশ্চাৎপদদের সমস্যা সমাধান করা, ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব দেয়া ও ন্যায়বিচারের কথা বলত এবং সরকারের জনবিরোধী নীতিসমূহ এমনকি আরএসএস সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করত। এনআইএ ও ইডির সাঁড়াশি অভিযান আর ১০৬ জনের গ্রেফতারির উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য একটিই- মুখে তালা লাগাও, নতুবা ...।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু
নিউজ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা