৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ হিন্দুস্তান আজ কিসকা

- ছবি : সংগৃহীত

সম্রাট অশোকের গৃহীত ও পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটেছে, এমনকি ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রান্তেও। তেমনি রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন-১-এর গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইতঃপূর্বেকার নির্যাতিত খ্রিষ্ট ধর্মটির প্রসার ঘটেছে গোটা ইউরোপে। কিন্তু ইসলাম? ‘এক হাতে কুরআন অন্য হাতে তলোয়ার’ এর বিস্তৃতির কারণ বলে অনেক সমালোচকরা বলে থাকেন। অথচ ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসজনিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাজ্য জয়ের পাশাপাশি একেশ্বরবাদ ও সাম্যবাদিতার নব্য দর্শনে বহু অনুসারী ঘটার বিষয়টিও নির্ভেজাল সত্য। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রায় ২০০ বছরেরও আরব শাসনাধীনে থাকা ভারতের সিন্ধুতে কখনই উল্লেখযোগ্য ধর্মান্তকরণ ঘটে নাই। তদ্রুপ পরবর্তীকালের ভারতে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানের সুলতানি শাসনামলের ৩২০ এবং মোগলদের প্রায় ৩৩০ বছরসহ সর্বমোট ৬৫০ বছরের শাসনেও গোটা উপমহাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত হয় নাই। বরং এর প্রায় ৫০ কোটি মুসলমানের দ্বিগুণ, শত কোটিরও বেশি অমুসলিম জনসংখ্যা। আর্যদের মতো অগণিত বহিরাগত দখলদার মুসলমানের স্থায়ী বসবাসে ভারতে তাদের বংশধরের সংখ্যার তুল্যতায় ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা বেশি নয়। এ ধর্মান্তরের মুখ্য কারণ সম্পর্কে ১৯৩৩ সালে কলকাতায় প্রকাশিত ‘কুরআন-তত্ত্বের’ ষষ্ঠ খণ্ডের ৩২০, ৩২১ ও ৩২২ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত চার সুখ্যাত ভারতীয়র অভিমত হলো :

১। ১৩২৩ সালের ২২ শে বৈশাখের এডুকেশন গেজেট হতে, পণ্ডিতবর ভ‚দেব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘হিন্দু তাহার নিম্নশ্রেণীর অন্ত্যজবর্ণ নাম দিয়া পশুর অপেক্ষাও অধিক ঘৃণা করিয়াছি। ...হিন্দুর এই স্বধর্মীয় বিদ্বেষের জন্য ভগবান তাহার অসীম কৃপায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্বধর্মপ্রেমিক জাতি মুসলমান তাহার অসীম কৃপায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্বধর্মপ্রেমিক জাতি মুসলমানকে শাসক ও শিক্ষকরূপে ভারতে প্রেরণ করেন।’

২। মায়াবতী মেয়োরিয়াল এডিশন, খণ্ড-৩, পৃ-৬৫২ মতে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মোছলেম কর্তৃক ভারত বিজয় দরিদ্র, পদদলিত জনগণের জন্য মুক্তিরূপে সমাগত হইয়াছিল। ইহাই আমাদের এক-পঞ্চমাংশ লোকের ইছলাম মণ্ডলীভুক্ত হওয়ার একমাত্র কারণ। তরবারি এই দীক্ষা ক্ষেত্রে কিছু করে নাই। তরবারি ও উৎপীড়ন দ্বারা এই দুরূহ কার্য সুসম্পন্ন হইয়াছে, ইহা বলা ঘোর বাতুলতা।’

৩। ১৯২৭ সালের ৭ ডিসেম্বরের অমৃত বাজার পত্রিকা মতে, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথায়, “যাহাদিগকে আমরা অদৃশ্য মনে করি তাহারা রাজ-শক্তির নিষ্পেষণে নহে, বরং আমাদের নির্মম ব্যবহারে, ইসলাম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে। রাজাদেশে হিন্দু ইসলামে দীক্ষিত হইলে, আমরা দিল্লি, মুর্শিদাবাদ ও ঈদৃশ অন্যান্য স্থানে অধিকতর মুসলমান দেখিতে পাইতাম। কিন্তু আমরা ইহার বিপরীত শাসন বিভাগের বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে দূরবর্তী স্থানগুলোতে অধিকসংখ্যক মুসলমান দেখিতে পাই। ইসলামের মূল মন্ত্র সাম্যবাদ ও ভ্রাতৃত্ব। যখন মুসলমানরা এই দেশে আসিয়া এই মহাবাণী প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন, জনগণ দলে দলে এই ধর্ম গ্রহণ করিতে অগ্রসর হইল।’

৪। ১৯২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আহমদাবাদের সবরমতি আশ্রমে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘মহত্তম মুসলমানদের সহিত আমার সংসর্গ আমাকে শিক্ষা দিয়াছে যে, ইসলাম অসিবলে বিস্তার লাভ করে নাই; কিন্তু সাধারণত সাধু পুরুষ ও ফকিরদের প্রেমবলে সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে।’
মুসলমান ও তৎপরবর্তী ব্রিটিশ শাসিত ভারতেও বহু খ্যাতনামা ও এমনকি অনেক ব্রাহ্মণও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন : রাজা গণেশ ওরফে কংস রাজার পুত্র জিতমল জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ নামে বাংলার শাসক, সুলতান সেকেন্দার শাহ রাজত্বকালে ‘বোৎ শোকান’ (Idol breaker) নামে খ্যাত হন তার হিন্দু মন্ত্রী শিও দেও ভট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অত্যন্ত হিন্দুবিদ্বেষী হওয়ার কারণে। কালীদাস গজদানী নামে জনৈক রাজপুত্র ধর্মান্তরিত হয়ে সোলায়মান খান নাম গ্রহণ করেন। তারই পুত্র বাংলার ১২ ভঁ‚ইয়াদের অন্যতম ঈসা খান। সম্রাট ফিরোজ শাহ তোগলক ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মোজাফফর শাহ নামে জনৈক ইসলামে দ্বীক্ষিত ব্রাহ্মণ ১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে আহামদ নগরে নিজাম শাহী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়ের রাজা সোলায়মান কাররানীর (১৫৬৩-৭৩ খ্রি:) সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়, যিনি ব্রাহ্মণ থাকাকালে রাজু বা রাজচন্দ্র নামে পরিচিত এবং মুসলমান হয়ে চরম হিন্দুবিদ্বেষী হয়েছিলেন। হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথের রাজা আমীর সিং, সিন্ধু প্রদেশের লোহানা সম্প্রদায়ভুক্ত সুন্দরজী ও হংসরাজা নামের দুই নেতা আদমজা ও তাজ মোহাম্মদ নাম গ্রহণ, কুচবিহারের যুবরাজ বিষ্ণু নারায়ণ, সম্রাট আকবরের কন্যা বিবাহ করে গায়ক তানসেন হন ‘মিঞা অতানসেন’, ধর্মান্তরিত রাজপুত্র বংশধরের ‘ওস্তাদ বেলায়েত আলী খান’, অনুরূপ রাজপুতের বংশধর চাটারীর নবাব স্যার সৈয়দ মোহাম্মদ আহামদ খান, কাশ্মিরের কেশুওয়ারের রাজপুত্র রাজা, দক্ষিণ ভারতের দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান তথা বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান, শ্রীহট্টের লাউড়ের শেষ রাজা গোবিন্দ সিংহ, সেখানের আরো এক রাজা সুবিদ নারায়ণের মৃত্যুর পরে তার পাঁচ পুত্রের চার পুত্রই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ২টায় রাজত্ব করেন।

লখনৌয়ের এক ইংরেজ খ্রিষ্টান পরিবারের সবাই ১৮৫০-এর দশকে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করেন, যার কর্মকর্তা নবাব আমীর মির্জার পূর্ব নাম ছিল Joseph Wathers, পাঞ্জাবের শিখ পিতা রাম সিংয়ের পুত্র ওবায়েদুল্লা সিন্ধি ১৮৮৭ সালে, কাশ্মিরের ব্রাহ্মণ শিখবিদ ড. শেখ আবদুল্লাহ ১৮৯১ সালে, জোদ্দান বাঈকে (ভারতীয় নায়ক সঞ্জয় দত্তের নানী) বিবাহের পূর্বে উত্তম চাঁদ মোহন চাঁদ ১৯১৮ সালে এবং পাঞ্জাবের কানাই লাল গৌবা ১৯৩৩ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে ড. ইকবালের দেয়া খালেদ লতিফ গৌবা নাম গ্রহণ করেন। পাঞ্জাবের হিন্দু ও খ্যাতনামা সায়গল পরিবারের শিল্পপতি আমিন সায়গল, স্যার মো: ইকবালের পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মিরের সাপ্রু নামক ব্রাহ্মণ পরিবারের, যারা ১৭০০ শতাব্দীর দিকে এবং তারও পূর্বে ধর্মান্তরিত; রাজপুত্রের বংশধর স্যার মালিক মোহাম্মদ ফিরোজ খান নুন ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম রাজনীতিবিদ। তদ্রুপ ৪০০ বছর আগে ধর্মান্তরিত আর এক রাজপুত্রের বংশদর হলেন পাকিস্তানের মরহুম রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো, যার মা খুরশিদ বেগমও ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান। পাকিস্তানের নিহত প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের দ্বিতীয় স্ত্রী রানা বেগম ছিলেন ব্রাহ্মণ কন্যা; যার নাম তখন ছিল মিস পাণ্ড। তবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মা মিথুবাঈ গুজরাটে অনেক হিন্দু মহিলার হওয়া নাম এবং তার পিতামহ ধর্মান্তরিত মুসলমান বলে বিস্ময়কর এক তথ্য পেলাম ভারতের প্রখ্যাত সম্পাদক রাজমোহন গান্ধীর Understanding Muslim Mind বইটির ১২৩ পৃষ্ঠায়। ধর্মান্তরিত হয়ে ১৯১৮ সালে জিন্নাহর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে তার স্ত্রী রুতিবাঈ ছিলেন পার্সি।

পরিশেষে, হিন্দু বিজেতা আরবরা এর উচ্চারণে আজো ভারতকে বলা হিন্দু থেকে উৎপত্তি শব্দ হলো হিন্দু, যা কোনো ধর্ম নয় বরং উপমহাদেশের জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব অধিবাসীকে বুঝায়। বাবর তার পুত্র হুমায়ুনকে ভালোবাসা দিয়ে ভারত শাসনের পরামর্শ দেয়ার তথ্য আছে। তাই মোগল সম্রাটদের হিন্দুস্তান বলতে ছিল গর্বের স্বর। এর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করে ইংরেজরা প্রাণ ভিক্ষা চাইতে বলায় তিনি দৃঢ় কণ্ঠের উত্তরে বলেন, ‘গাজিও সে বু-রহেগি সব তক ইমাম কি, তব তো লন্ডন যত দিন যোদ্ধাদের অন্তরে থাকবে, তত দিন হিন্দুস্তানের দাপট পৌঁছবে লন্ডন পর্যন্ত। ড. ইকবালও গর্বের সহিত তার কবিতায় সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে ভালো আমাদের হিন্দুস্তান’ বলে দাবি করেছেন। জাতি, ধর্মের এই হিন্দুস্তানি ঐক্যের ইতিহাসকে বিস্মৃত রেখে সাম্প্রদায়িক অতীতকে পুনরুজ্জীবিতকরণের চেষ্টা অবশ্যই ভারতের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সহায়ক হওয়ার নয়।


আরো সংবাদ



premium cement