৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হিজাব যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি

- ছবি : সংগৃহীত

হিজাব : পরা, না পরা, এটিই প্রশ্ন। প্রশ্নটির উত্তর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারক দিয়েছিলেন কিন্তু, ১৩ অক্টোবর দিনের শেষে, দুটি মতামত ছিল, এর কোনো উত্তর ছিল না। ফলে মিজ আইশাত শিফা ও মিজ তেহরিনা বেগম কুন্দাপুরা সরকারি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তাদের পড়াশোনা পুনরায় শুরু করতে পারছে না। তারা কর্নাটকের উদুপি জেলার কুন্দাপুরা নামে একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করে ও বেড়ে ওঠে।

দুই ছাত্রীই দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। আগের বছর কলেজে যোগদানের দিন থেকে, তারা হিজাব পরেছিল- একটি স্কার্ফ যা মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখে তবে মুখটি দৃশ্যমান ছিল। নির্ধারিত ইউনিফর্মের পাশাপাশি হিজাবও পরত তারা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তাদের গেটে থামানো হয় এবং বলা হয় যে, তাদের কলেজে প্রবেশের আগে হিজাব খুলে ফেলতে হবে। তারা প্রত্যাখ্যান করে, এরপর তাদের কলেজে প্রবেশ থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং আট মাস পরও বিষয়টি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

হিজাব আলাদা নয়, হিজাব পরা একজন মহিলা কারো জন্য কোনো অপরাধ করে না। এটি জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা বা স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে নয়। ধর্মীয় তাৎপর্য নির্বিশেষে, হিজাব পরা একজন মহিলা ভারতের মহিলাদের থেকে খুব আলাদা নয়, যারা তাদের শাড়ির পল্লু বা দুপাট্টা দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে। পুরুষরা পাগড়ি পরে। শিখ পুরুষরা পাগড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে। ভারতের অনেক রাজ্যে বিশেষ অনুষ্ঠানে পরা স্বতন্ত্র হেডগিয়ার রয়েছে (যেমন মাইসুরু পেটা)। বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় কী? হৈ হুল্লোড় শিরোনাম, টেলিভিশনে কোলাহল, সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য, ট্রল ও মেমের বন্যা আর যোগ্য নেতাদের উচ্চবাচ্যের মধ্যে, কেন্দ্রীয় ইস্যুটি হারিয়ে গেছে। আমার দৃষ্টিতে, সমস্যাটি একটি শব্দে ফুটে ওঠে; সেটি হলো ‘পছন্দ’।

চটুল বেড়া হিজাব পরিধানের বিষয়ে ‘পছন্দের’ প্রশ্নে দু’টি পন্থা রয়েছে। আমি দুই বিচারক, বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত ও বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার মতামত থেকে উদ্ধৃত করে দু’টি পদ্ধতির ব্যাখ্যা করতে পারি : বিচারপতি গুপ্ত- ‘হিজাব পরার অভ্যাস একটি ধর্মীয় অনুশীলন বা একটি অত্যাবশ্যক ধর্মীয় অনুশীলন হতে পারে বা এটি ইসলামী বিশ্বাসের মহিলাদের জন্য সামাজিক আচরণ হতে পারে...ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয় তহবিলে চলা ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’

বিচারপতি ধুলিয়া- ‘হিজাব পরা একটি অপরিহার্য ধর্মীয় অনুশীলন কি না, এই বিরোধের সমাধান অপরিহার্য নয়। যদি বিশ্বাস আন্তরিক হয় ও এটি অন্য কারো ক্ষতি করে না, তাহলে ক্লাসরুমে হিজাব নিষিদ্ধ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।’ বিচারপতি গুপ্ত- ‘... রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত কলেজ উন্নয়ন কমিটিকে বাধ্যতামূলক করে যাতে ছাত্রদের নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরিধান করতে হয়, এটি সংবিধানের ১৯(১)-এ অনুচ্ছেদের অধীনে গ্যারান্টিযুক্ত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে না; বরং অনুচ্ছেদ ১৪-এর অধীনে সমতার অধিকারকে শক্তিশালী করে।’

বিচারপতি ধুলিয়া- ‘একজন প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলছাত্রীকে তার স্কুলের গেটে হিজাব খুলে ফেলতে বলা তার গোপনীয়তা ও মর্যাদার ওপর আক্রমণ। এটি সংবিধানের ১৯(১)(এ) এবং ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে তাকে দেয়া মৌলিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’ বিচারপতি গুপ্ত- ‘অতএব, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা বা ভ্রাতৃত্বের মূল লক্ষ্যটি ধর্মীয় পার্থক্য, অসমতা দূর করে ও ছাত্রদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তাদের সাথে সমান আচরণ করার মাধ্যমে আরো ভালোভাবে তা পরিবেশন করা হবে।’ বিচারপতি ধুলিয়া- ‘এটি তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীলতা, সহানুভ‚তি ও বোঝাপড়া তৈরি করার সময়। এই সেই সময় যখন তাদের আমাদের বৈচিত্র্য দেখে আতঙ্কিত না হয়ে এই বৈচিত্র্যকে আনন্দিত ও উদযাপন করতে শেখা উচিত।’

বিচারপতি গুপ্ত- ‘যদি তারা নির্ধারিত ইউনিফর্মের কারণে ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া বেছে নেয়, তবে এটি এই জাতীয় শিক্ষার্থীদের একটি স্বেচ্ছামূলক কাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক ২৯ ধারার লঙ্ঘন বলা যাবে না এটিকে।’ বিচারপতি ধুলিয়া- ‘যদি সে তার ক্লাসরুমের ভেতরেও হিজাব পরতে চায়, তাকে আটকানো যাবে না, যদি এটি তার পছন্দের বিষয় হিসেবে পরা হয়, কারণ তার রক্ষণশীল পরিবারের তাকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার এটিই একমাত্র উপায় হতে পারে এবং সেসব ক্ষেত্রে, তার হিজাবই তার শিক্ষার টিকিট।’ পছন্দ বা নিয়ম কিছু ভাষ্যকার অভিযোগ করেছেন, যখন রক্ষণশীল ইরানে হিজাব ত্যাগ করার জন্য আন্দোলন চলছে, তখন এটি আশ্চর্যজনক যে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশ আধুনিক ভারতে শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের হিজাব পরার অধিকার রক্ষা করা উচিত বলে বলছে। এই সমালোচনা সম্পূর্ণ ভুল। ইরান ও ভারত উভয় ক্ষেত্রেই বিতর্ক একই- এটি হলো ‘পছন্দ’ নিয়ে। এটি আমেরিকায় নারীর গর্ভপাতের পছন্দ নিয়ে বিতর্কের মতো। বিবাদটি ‘চয়েস’ ও ‘রুল’-এর মধ্যে। ‘চয়েস’ স্বাধীনতা, মর্যাদা, গোপনীয়তা ও বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে। ‘শাসন’ প্রায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, অসহিষ্ণুতা ও অভিন্নতার জন্য চালনার ফল। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(২) বা অনুচ্ছেদ ২৫(১)-জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্য এবং তৃতীয় অংশের অন্যান্য কিছু বিধানে অন্তর্ভুক্ত ভিত্তিগুলোকে আকৃষ্ট করে এমন কিছু পরিস্থিতিতে ‘চয়েস’ ‘শাসন’-এর কাছে গৃহীত হবে। সংবিধানের (মৌলিক অধিকার) অনুপস্থিত এই ধরনের ভিত্তির ক্ষেত্রে, ‘চয়েস’ অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া- ‘চয়েস’ বহাল রাখেন কারণ হিজাবই হতে পারে মেয়েদের শিক্ষার একমাত্র টিকিট। বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত- ‘শাসন’ বহাল রেখেছেন। যদিও রাজ্য কোনো বাধ্যতামূলক প্রয়োজনীয়তা দেখায়নি। সুপ্রিম কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে আইনটি পেশ হবে। এ দিকে আপনাদের প্রত্যেককে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি ‘চয়েস’ বা ‘রুল’ এর সাথে দাঁড়ান কিনা।

লেখক : ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে
অনুবাদ : মাসুম খলিলী

 

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল