৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণকর্তা কে

গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণকর্তা কে - ফাইল ছবি

ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশোর মতে-গণতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য হলো, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।’ আমাদের দেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৭ এর ১ ও ২ অনুচ্ছেদেও একই কথা বলা আছে। সেখানে বলা আছে, ‘(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইনে যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশোর উক্তি এবং আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ এই বাক্যগুলোর সহজ সরল অর্থ হলো, জনগণই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের মালিক।

গ্রাম অঞ্চলের মানুষ অনেক সময় একজন অন্যজনকে ধাঁধার মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করে, বলো তো দেখি, কোন জিনিস কথায় আছে কিন্তু বাস্তবে নেই? অনুরূপভাবে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, বাংলাদেশের কোন জিনিস সংবিধানে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই? যারা একটু রাজনৈতিকসচেতন, তারা খুব সহজেই বলে দিতে পারবে, ‘গণতন্ত্র’ নেই। কারণ আমাদের এই দেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির অন্যতম গণতন্ত্রের কথা খুব স্পষ্টভাবে লেখা থাকলেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এখানে জনগণের সিদ্ধান্তের কোনো মূল্যই নেই। সব কিছু রাজতান্ত্রিক দেশের রাজার মতোই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের আদেশ নির্দেশে হয়। রাজতন্ত্রে যেমন- রাজার আদেশই বিধান। রাজার ইচ্ছাই রাষ্ট্র ও আইন। আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অবস্থাও আজ সেখানেই পৌঁছেছে। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের কাজ হলো, রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের হুকুমকে পালন করা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের ইচ্ছা এখানে গৌণ বিষয়। এখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব বলতে কিছু নেই।

সংবিধানের আলোকে জনগণ সব ক্ষমতার মালিক কিন্তু জনগণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এখানে শাসকের ইচ্ছাকেই জনগণের ইচ্ছা বলে চালানো হচ্ছে। দেশ পরিচালনার জন্য রাজনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রের জনগণ রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিচালক নির্বাচন করবেন। কোন প্রক্রিয়ায় তারা তাদের নেতাদের সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারবেন, সেই সিদ্ধান্তও তাদের মধ্য থেকে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টোটি চলছে। এখানে জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সুবিধামতো ব্যবস্থায় জনগণকে ভোট দিতে বাধ্য করছে। এটা তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয় বরং স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, জনগণের স্বাধীন মতকে রহিত করার জন্য আদালতকেও নাকি ব্যবহার করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে!

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের লেশ মাত্র নেই। সেই জায়গা থেকেই, আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলোর অসহযোগ আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশনে ২৬৮-০ ভোটে পাস হয়। এই আইন রাজনৈতিক দল এবং জনগণের সিদ্ধান্তের ফল কিন্তু এমন কী ঘটে গেল যে, এই আইন বাতিল করতে হলো। যে আইন সংসদে পাস হলো সেই আইন বাতিল করার জন্য কোর্টের কাছে কেন যেতে হলো? কী নাটকীয়তা আছে এখানে?

এখানে আওয়ামী লীগ সরকারের কূট-কৌশলটা হলো, যে আইন পাসের জন্য তারা আন্দোলন করেছে সেই আইন বাতিল করে নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ হতে চায়নি। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, কাজেই কোর্টের ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের অধীন নির্বাচন করার জন্য তা বাতিল করার মতো কৌশল অবলম্বন করেছে। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পরে উক্ত রায়টি লিখেছেন যেটা নৈতিকভাবে মোটেও বৈধ নয়।

১৯৬৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আছে (ডিএলআর-১৬-এ উল্লেখ আছে), অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের দেওয়া রায় No judgement হিসেবেই গণ্য হবে। ’৬৪ সালে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া এই সিদ্ধান্ত পাল্টা কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ওভার রুল্ড বা পরিবর্তন হয়নি। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলা সাংবিধানিকভাবেই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের ওপর তারাই অবসরে গিয়ে রায় লিখে সংবিধানকে অগ্রাহ্য করছেন। তারপরও সংক্ষিপ্ত রায়ে লেখা ছিল, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। কিন্তু মূল রায়ে তিনি সেই কথাটি লেখেননি। ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে তাতে নিজে স্বাক্ষর করেন এবং অন্যান্য বিচারপতিদের স্বাক্ষর নিয়ে তা প্রকাশ করেন।

অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের মূল চেতনা পুরোপুরি পাল্টে ফেলার অভিযোগ করা হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করার পথ তৈরি করে দেয়া হলো। এই সুযোগ নিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কর্তৃত্ববাদী শাসন যেখানে জবাবদিহিতার বালাই নেই কোথাও। জনগণের বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ। বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এমন এক রাজনীতিহীন সংস্কৃতিতে যেখানে প্রতিবাদের সব ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছে মামলা, হামলা, গুম, খুনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের একজন মানুষও এখন আর বিশ্বাস করে না দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সহজ কথায়, দেশের গণতন্ত্রকে, নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

দেশ যখন কোনো সাংবিধানিক সঙ্কটের মধ্যে পড়ে, তার থেকে উত্তরণের সহজ উপায় হলো ‘গণভোট’। পৃথিবীর বহু দেশে গণভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক সঙ্কট দূরীভূত করা হয়। মাদার অব ডেমোক্রেসি নামক রাষ্ট্র ব্রিটেনে যেকোনো সাংবিধানিক সঙ্কট দূর করার জন্য গণভোটের মাধ্যমে জনমত নেয়া হয়। বাংলাদেশেও সাংবিধানিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অর্থাৎ সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২ক বা ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যবস্থা করে কোনো বিল উক্ত সংবিধানের ১৪২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে গৃহীত হবার পর সেটাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করবেন কি করবেন না এই প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ এর মাধ্যমে গণভোটের বিধান করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশ রাষ্ট্রপতি নাকি মন্ত্রী পরিষদ শাসিত শাসন-ব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হবে তা নির্ধারণ করার জন্য ‘গণভোটের’ আয়োজন করা হয়েছিল। জনগণের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশে মন্ত্রী পরিষদ শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। আজকে রাষ্ট্রে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তার থেকে উত্তরণের সহজ উপায় ছিল গণভোটের আয়োজন করা।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অর্থবিল ২০১৯ পাসের মধ্য দিয়ে জনমত যাচাইয়ের ‘গণভোট’ বিধানটি বাতিল করে দেয়। জনগণের মতামতের পদ্ধতিকে বাতিল করে সব কিছু আদালতের ঘাড়ে ছেড়ে দিয়েছে এই সরকার। জনগণ ভোটের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সেই বিধান বা আইন বাতিল করার ক্ষমতা কারোই থাকা উচিত নয়। বরং সরকার যদি নিজের স্বার্থ আদায়ের জন্য সংসদে এমন আইন তৈরি করে যা জনগণের অধিকারকে হরণ করে বা সংবিধান আইনের সাথে সাংঘর্ষিক, সেই আইন বাতিল করার ক্ষমতা আদালতের আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই দেশের বেশির ভাগ জনগণের পছন্দের বিষয় ছিল। কোনো প্রকার জনমত যাচাই ছাড়া একজন বিচারপতি অবসরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এমন একটি মীমাংসিত বিষয় বাতিল করার পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য বই অন্য কিছু আছে বলে মনে হয় না।

এই উপমহাদেশে গণভোট নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে যখন আমাদের এ উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তখন নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তর সিলেট জেলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সিলেটের পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ১৯৪৭ সালে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সেই জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পাকিস্তানের সাথে থাকার ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকলেও ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চম সংশোধনী আইন) ২৫ নং আদেশ বলে গণভোটের বিধান করা হয়েছিল। সরকারের মধ্যে জবাবদিহির মনোভাব থাকলে উক্ত আইন বাতিল করত না।

বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য। আজকে সরকার যে ধরনের ক‚টকৌশলের মাধ্যমে বারবার দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলে এর পরিণাম হিসেবে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর তাই গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে জনমতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যেই বলছি, আগামী জাতীয় নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে- এ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করে জনমতের ভিত্তিতে দেশের সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব। আর গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ভার জনগণের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। তাতে গণতন্ত্র, আইন, আদালত সবই মান বজায় রেখে চলতে পারবে। প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রই একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement