৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবতা ও সম্প্রীতির নবী সা:

-

মানবতার পরম বন্ধু মুহাম্মদ সা:। তাঁর মিশনের আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রীতি ও সম্প্রীতি। নানা মত নানা পথে বিভক্ত মানবতাকে একই পতাকার শান্তিময় ছায়াতলে, প্রশান্তির নান্দনিক সুখময় শিবিরে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস ছিল তাঁর পুরো জীবনে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, নিত্য ভাবনার কোথাও তিনি মানুষকে সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘুর বিভক্তিতে বিভাজন করতেন না; বরং তিনি পুরো মানবতাকে একই পিতার সন্তান হিসেবে একই পরিবারভুক্ত বিবেচনা করতেন।

ধর্ম মানুষের জন্য, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য জগৎস্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ধর্ম সৃষ্টি করেছেন। ধর্ম হলো মহান রবের বিশেষ অনুগ্রহ, মহান বিধাতার মহানির্দেশনা, আর তা বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব নবী-রাসূলদের। তাই আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব মুহাম্মদ সা: পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যের মহামিলনে একত্রিত করার মহামিশনে প্রেরিত হয়েছিলেন।

জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশাকালে মানবতাবিনাশী দানবের বর্বরতায় আরব ভূখণ্ডসহ তৎকালীন পুরো জগৎ যখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন মানবতাকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতিবন্ধন গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়, বিবদমান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সখ্য ও সম্প্রীতিভাব গড়ে তোলার জন্য জগতের মানুষকে একত্ববাদ তথা সিরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখানোর জন্যই মুহাম্মদ সা:-এর শুভাগমন ঘটে। তাঁর শৈশব-কৈশর, যৌবন-প্রৌঢ়কাল অধ্যয়নপূর্বক সামগ্রিক মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণে যা অনুমিত হয়, তা হলো- তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন মানবপ্রেমী, প্রীতি ও সম্প্রীতির সেরা আদর্শ মহামানব। বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা: শৈশবের গণ্ডিতে সর্বসাধারণের কাছে ‘আল-আমিন’ পরিচয়ে পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। অবিশ্বাসের চরম শূন্যতার জামানায় তিনি ছিলেন সবার পরম আস্থাভাজন। তৎকালীন যুগের কোনো রাজা-বাদশাহ, প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তিও জনতার হৃদয়ের আঙ্গিনায় ন্যূনতম বিশ্বাসের স্থানে পৌঁছতে পারেননি। সে সময়কার মানুষের মনে থাকত একধরনের ভীতি, অবিশ্বাসের ডালপালা, যা পুরো সমাজে ছেয়ে যাওয়ার কারণে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। যে হৃদয়ে অবিশ্বাসের ভীতি থাকে সে হৃদয়ে কখনো প্রীতি কাজ করে না। বিশ্বনবী সা:-এর বিশ্বস্ততা ও পরম আস্থার নীতি জনগণকে তাঁর প্রীতিতে আবদ্ধ করে, যে কারণে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ তাঁর পরম গুণমুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলে ডাকে। পবিত্র কুরআন মাজিদে তাঁর এ চরিত্র মাধুর্য ‘খুলুকে আজিম’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা কালাম, আয়াত-৪) বিশ্বনবী সা: নিজেই তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য’ (কানযুল উম্মাল)। খাদিজা রা: বলেন, আল্লাহর কসম, কখনোই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১/৩)

মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল নবী সা:-এর ফিতরাতগত অভ্যাস। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন কখনো ঘৃণা করতেন না, মানুষকে কাছে টানতেন, কখনো দূরে সরিয়ে দিতেন না, জালিমের জুলুমে মজলুম হয়েও প্রতিশোধ নিতেন না; বরং ক্ষমা করে দিতেন। তাঁর মানবপ্রীতির এ চিত্রটি তাঁর বক্তব্য ও কর্মে ফুটে ওঠে। উকবাহ বিন আমের রা: বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমার সাথে যে আত্মীয়তা ছিন্ন করেছে, তুমি তার সাথে তা বজায় রাখো, তোমাকে যে বঞ্চিত করেছে, তুমি তাকে প্রদান করো এবং যে তোমার প্রতি অন্যায়াচরণ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও।’ (আহমাদ-১৭৪৫২, মুস্তাদরাকে হাকেম-৭২৮৫)

মানবতাবোধের উত্তম উদাহরণ রাসূল সা:-এর জীবনে ভেবে দেখা যায়, এক বুড়ি না বুঝেই ইসলামের বিরোধিতা করত এবং নবী করিম সা:-কে কষ্ট দেয়ার জন্য মসজিদে যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হলো কি না- এই ভেবে দয়ার নবী সা: বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। তিনি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর পরিচয় পেয়ে বুড়ি হতবাক হয়ে গেল। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেল।

বিশ্বনবী সা:-এর মানুষের প্রতি, অসহায়দের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার চিরচেনা রূপটি বিশ্ববাসীর নজরে এরকম বর্ণিত রয়েছে- ঈদের দিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি শিশু কাঁদছে। রাসূল সা: সে পথে যাওয়ার সময় শিশুটিকে এ অবস্থায় দেখে আবেগমাখা সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, তোমার কী হয়েছে?’ শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা নেই। ঈদের দিনে নতুন কাপড় আমার নেই। আমার সাথীরা নতুন কাপড় পরে খেলাধুলা করছে।’ দয়ার নবী শিশুটিকে নতুন কাপড় কিনে দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। কন্যা হজরত ফাতেমা রা:-কে বললেন, ‘তোমার জন্য একটি ভাই নিয়ে এসেছি। তুমি জলদি করে তাকে গোসল দিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও। কিছু মিষ্টান্ন খাইয়ে দিয়ে শিশুদের সাথে খেলতে পাঠিয়ে দাও। হজরত ফাতেমা রা: শিশুটিকে নতুন কাপড় পরালেন। শিশুটি মনে আনন্দের দোলা বয়ে গেল, শিশুটি পেছনের দুঃখ ভুলে অন্য শিশুদের সাথে খেলায় মেতে উঠল।

বিশ্বনবী সা:-এর সম্প্রীতির আদর্শ দু’টি নমুনা আমরা দেখতে পাই, একটি হলো- নবুয়তের পূর্বেকার, অপরটি হলো- নবুয়তের পরবর্তী সময়ের। ঘটনা দু’টি হলো- মক্কার বিবদমান সব গোত্রই পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণকে সৌভাগ্য ও মর্যাদার প্রতীক মনে করত। কাজেই তারা সবাই মিলে বিবাদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাবা পুনর্নির্মাণকাজ সমাধা করল। আগেই কাবাঘরের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল জান্নাতি ‘শুভ্র পাথর’ যা পাপশোষণের কারণে কালো হয়েছে যাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বলে। ওই পবিত্র পাথরখানা কাবা শরিফের যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে সব পক্ষই তীব্র দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কেননা, এ প্রতিস্থাপন কর্মটি ছিল বড়ই মর্যাদার ও মহাগর্বের। তাই সব পক্ষ চাচ্ছিল, এ গৌরব নিজেরাই অর্জন করুক। আসন্ন এ চরম কঠিন বিপদসঙ্কুল ও সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নবী সা: সম্প্রীতির বাতাবরণে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে একখানা চাদর এনে তার চতুষ্কোণ বিবদমান পক্ষগুলোর হাতে দিয়ে আর স্বয়ং নিজে ‘হাজরে আসওয়াদকে’ ওই চাদরে রেখে কাবায় গিয়ে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে মহাসঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করলেন। সব পক্ষই সন্তুষ্ট ও পরম খুশি হলো, সম্প্রীতি ও প্রীতিতে বলীয়ান হয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে আলিঙ্গন করল। সবাই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করল। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আর রাহিকুল মাখতুম, সিরাতে ইবনে হিশামের আলোকে)

ইসলাম প্রীতি ও সম্প্রীতির ধর্ম। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয়তম রাসূল সা:-কে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ তাওহিদবাদী মানবিক পরিবেশ কায়েমের জন্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি আপনাকে পুরো বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর নবী সা: সেখানকার ‘আওস ও খাজরাজ’ গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতির আবহে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুললেন। তাদের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের সঙ্ঘাতকে তিনি শান্তির মহামিলনে উপসংহার টানলেন। মদিনায় মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অপরাপর ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে সহাবস্থান তৈরি করেন। মদিনায় অসাম্প্রদায়িক, আদর্শ সমাজ, সুখী-সমৃদ্ধ আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তিনি ‘মদিনা সনদ’ নামে বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করেন, যার ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে পূর্বতন ইয়াসরিব নগরী ‘মদিনাতুন্নবী’ নামে সম্প্রীতি ও প্রীতির আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে নতুন পরিচয় লাভ করে।

মানবতার নবী মুহাম্মদ সা: হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে অনিবার্য রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতকে সম্প্রীতির মাধ্যমে সমাধান করেন। তিনি মক্কা বিজয়ের পর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বে সম্প্রীতির যে নজির কায়েম করলেন, তা বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার। মূলত এ বিষয়টি এ জন্য হয়েছে যে, তিনি মানবতার নবী, সাম্যের নবী, সম্প্রীতির নবী, প্রীতির নবী, নীতির নবী, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির নবী। তিনি অনৈক্য ও দলাদলির বদলে মানুষের মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মমত্ববোধ কায়েম করেছেন।

লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর সদর, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement