ওদেরকে মানুষ হতে শেখান
- মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
- ১২ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৫৫
মানুষের চারিত্রিক পদস্খলন ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অব্যাহত বেড়ে চলেছে। তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। বেড়ে গেছে পারিবারিক ও সামাজিক বহু ধরনের বিশৃঙ্খলা। মানুষও এক ধরনের আস্থাহীনতায় ভুগছে। সমাজে জ্ঞানী-গুণীদের সমাদর এখন আর আগের মতো নেই। মানুষকে বিচারের অনুষঙ্গ যখন ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি, তখন মানুষ জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞতার দিকেই বেশি ধাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মূর্খ ও অযোগ্যরা যখন সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, কালো টাকার পাহাড় জমায়, অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়, তখন এটি জাতির কাছে একটি ভুল ম্যাসেজ দেবে এটাই বাস্তব। সভ্য সমাজের সংজ্ঞাকে তারা আজ নানাভাবে কলুষিত করছে। এই লুটেরার দল যখন সমাজের কর্তৃত্ব হাতে নেয়, সাধারণ মানুষ তখন তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। কেউ অনিরাপদ থাকতে পারে না। এক শ্রেণীর ক্ষমতা ও অর্থলোভী মানুষও তাদের অনুসরণ করতে চায়। এরা রীতিমতো সমাজের জন্য হুমকি। অনেক মানুষের বখে যাওয়ার পেছনে এরা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে বেশ কিছু অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, শিক্ষার্থী মহল তথা আমাদের তরুণ প্রজন্ম সব থেকে বেশি আহত করছে। তারা শিক্ষার্থী হলেও অনেকের আচরণে সেই শিক্ষার্থীসুলভ মনোভাব নেই। হিংস্রতা তাদের অন্তরে বাসা বেঁধেছে। যাদের আমরা সবসময় কোমলমতি হিসেবে ভেবে থাকি। ক’দিন আগের ঘটনা, উত্ত্যক্ত করার ঘটনা কেন্দ্র করে সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করে তারই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। এই নারকীয় ঘটনা জাতি চেয়ে চেয়ে দেখল। এ রকম অনেক উৎপল কুমার এ দেশের আনাচে-কানাচে পড়ে রয়েছে। উৎপল কুমার আজ প্রাণ ত্যাগ করেছে বলে, পত্রিকার পাতায় নিউজের অংশ হয়েছে। যে উৎপল কুমাররা মুখ খুলে নিজের কষ্টের কথা বলতে পারেন না, তাদের কেউ আর জানতে পারে না।
যে শিক্ষার সাথে নৈতিকতা যোগ হয় না, সে শিক্ষা কখনোই পূর্ণতা লাভ করে না। শিক্ষা হলো সেইটুকু, যা মানুষ শেখে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগায়। আজকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা এমন সব আচরণ প্রকাশ পায়, জাতি হিসেবে তারা আমাদের লজ্জিত করে। সম্প্রতি ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে সিট-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এমনটি এমন একটি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যে, ছাত্রীদের চাপ প্রয়োগ করে অনৈতিক কাজ করিয়ে থাকে তারা। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক, এ ধরনের ঘটনাগুলো দেশীয় পরিমণ্ডলের বাইরেও আমাদের সুনাম ও সুখ্যাতিকে ম্লান করে দিচ্ছে। শাসনের ক্ষেত্রগুলো এতই সঙ্কুচিত যে, অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার ভয়ে এখন কেউই আর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে যায় না। যারা দায়িত্ববান হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন পদে পদে তারাও লাঞ্ছিত হন। আবার শিক্ষকরাও তাদের পিতৃত্বসুলভ ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষাদানের চেষ্টা করেন না। মাঝে মধ্যে শিক্ষকরাও এমন কাজ করেন যা তাদের কাছ থেকে আমরা কখনো আশা করি না।
শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সম্মান ক্রমেই কমে আসছে। এক ধরনের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে। একের পর এক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে শিক্ষার্থীরাই বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। হয়রানির শিকার নারীদের ৫৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নির্দেশনা দেয়, সেখানে বলা হয়েছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী রয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি গঠন করা হবে।
উক্ত কমিটিতে নারীদের কর্তৃত্ব থাকবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে কোনো অভিযোগ আছে কি না তা চেক করবে। কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। ওই নির্দেশনায় আরো বলা হয়, এই তদন্তে নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখবে প্রতিষ্ঠানগুলো। কেউ চাইলে সরাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবে। কিন্তু ওই নির্দেশনা প্রদানের ১২ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো কমিটির অস্তিত্ব নেই।
সমাজ থেকে আদব-কায়দা, বিনয়-নম্রতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ এসব হারিয়ে যেতে বসেছে। সমাজে কেউ অন্যায় করলে একসময় মানুষ নীরবে মুখ বুজে সহ্য করত না, আশপাশের মানুষগুলো ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। গ্রাম-গঞ্জে বা পাড়া-মহল্লায় এখন মুরব্বিদের ছোটরা সম্মান করতে চায় না। কারণ ওরা এভাবে দেখে দেখেই বড় হয়ে উঠছে। নিজেরাও তা-ই করছে। এক সময় সমাজে জ্ঞানীদের অনেক বেশি কদর ছিল। এলাকায় বা পাড়া-মহল্লায় কোনো সমস্যা হলে মানুষ তাদের ডাকত। বিচার সালিশ বসত। এরা নিরপেক্ষভাবে মানুষের মাঝে বিচার করে দিতেন। এদের রায়ের ব্যাপারে মানুষ খুব একটা দ্বিমত পোষণ করত না। দলবাজি নিয়ে মানুষ এতই ব্যস্ত যে, মানবিক এই বিষয়গুলো তাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে।
সমাজ বিনির্মাণের চেয়ে মানুষ এখন ভাঙার কাজেই বেশি ব্যস্ত। এসব কারণে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। ছোট ভাই বড় ভাইকে সমীহ করে না। সন্তান বাবার কথা শোনে না। এগুলো কখনো একদিনে হয় না। একটু একটু করে সেই সমস্যাগুলো পুঞ্জীভূত হয়েছে। যেহেতু এই সমস্যা আমরাই তৈরি করেছি, একে আমাদেরই তাড়াতে হবে। এই সমস্যা যাদের দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে তারা আমাদেরই সন্তান। হয় আমার, না হয় আপনার। ও যখন ছোট ছিল, ওর প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব ছিল। হয়তো আপনি সে দায়িত্ব পালন করেননি। ও যখন ছোট অন্যায়গুলো করেছে আপনি ওকে ন্যায়ের কথা বলেননি। ও যখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে সঠিক সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত করেননি। ও যখন আপনার কথা শুনত, ওকে তখন শাসন করেনি। যখন ওর অন্যায়ের মাত্রা বেড়ে গেল, আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তখন ওকে শাসন করতে চাইলেন।
তাই আপনি আপনার সন্তানের জন্য উত্তম শিক্ষাটি রেখে যান। সে আপনার কথার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেবে। আপনি নিজে অন্যায় থেকে বিরত থাকুন। সে-ও অন্যায়ের দিকে পা বাড়াবে না। আপনি সত্য বলুন, সে মিথ্যা বলবে না। আপনি অন্যের অধিকার নিয়ে সচেতন হন। সে অন্যের অধিকার হরণ করবে না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখুন, সে অনাত্মীয়কেও অবহেলা করবে না। আপনি আপনার পিতা-মাতা ও নিকটজনের খবর নিন, সে আপনাকে দেখে এখান থেকে শিক্ষা নেবে।
আপনি সত্য কথা বলছেন, ন্যায়ের পথে চলছেন এখন সমাজ আপনার সঠিক মূল্যায়ন দিতে চাইবে না। একেবারেই যে কেউ করবে না, তা কিন্তু নয়। তাই বলে আপনি কখনোই মনঃকষ্টে ভুগবেন না। যদি আপনার মনের জোর শক্তিশালী হয়, ওদের সমস্ত প্রশান্তির চেয়ে আপনার সত্যের ওপর অবিচল থাকার প্রশান্তি হবে অনেক বেশি আনন্দদায়ক। তাই হতাশ হয়ে কখনোই ন্যায়ের রাস্তাটি ত্যাগ করবেন না, কারণ আপনাকে ওই একজন হতে হবে, যার কারণে হাজারও মানুষ ন্যায়ের দিকে ফিরে আসবে। আপনি যদি ওদের থেকে বিমুখ হয়ে যান, তাহলে ওদের জন্য শেষ আশাটিও নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার চার পাশের সবাই একটি অন্যায়কে ন্যায় বলবে, তবুও সেই অন্যায়কে অন্যায় বলেই জানবেন। কারণ, পৃথিবীর সব মানুষ একটি অসত্যকে সত্য বললেও তা কখনো সত্য হবে না, বরং অসত্যই রয়ে যাবে।
আপনি মানুষকে কষ্ট দিয়ে সুখের প্রাসাদ গড়তে যাবেন, এই অট্টালিকা আপনার জন্য সুখের না-ও হতে পারে। অন্যায়ের প্রতিশোধ আপনার দিকে আসবেই। এ বিষয়ে আপনি কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ করবেন না। বরং এই প্রতিশোধ আসার আগে আপনি নিজেকে শুধরে নিন, হয়তো তাহলে ক্ষমার শেষ রাস্তাটি আপনার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে না। মানুষ আপনাকে সেবকের আসনে বসিয়েছে, সেই মানুষের উপর আপনি জুলুম করবেন না। হতে পারে, এই জুলুম আপনার অন্তরের সাথে এমনভাবে মিশে যাবে, জালিম হয়ে আপনি জুলুমের কথা বুঝতে পারবেন না।
এমন বিষয় দিয়ে কখনো নিজেকে সান্ত্বনা দেবেন না, যা আপনার অন্যায়কে গোপন করে রাখে। অন্যায় করেও নিজের অন্যায় বুঝতে না-পারা অনেক বড় ভুলের মধ্যে পড়ে থাকা। বিবেকবান মানুষ হয়েও আপনি এই ভুলটি করবেন না। অন্যায়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে ভালো কাজ করলেও তার ফলাফল অন্যায়ই থেকে যায়। এমন মূর্খতার জগতে নিজেকে নিয়ে যাবেন না। নিজের উপার্জনের ব্যাপারে যত্নবান হউন। যেখানে সন্দেহ দেখবেন, সেখান থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন। অন্যকে বাঁচাতেও চেষ্টা করুন। নিজের আসল দায়িত্বকে নকল বানিয়ে দেবেন না। আর নকলকেও আসল করবেন না। দায়িত্বকে দায়িত্বের কথা ভেবে পালন করুন। মানুষের ওপর অদায়িত্বের বোঝা যেন না চাপায়।
নিজের কথা ভাবুন, কিন্তু অন্যের ক্ষতির দিকে লক্ষ করুন। উপকার করার মানসিকতা আপনি পোষণ করতে পারেন না, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু কারো অনিষ্ট করতে যাবেন না। নিজের আকাঙ্ক্ষাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবেন না, যা আপনি পূরণ করার ক্ষমতা রাখেন না। এমনটি করতে গেলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। যখনই এই বৃত্তের মধ্যে আপনি প্রবেশ করবেন, আপনি আর সুস্থ থাকতে পারবেন না। তাই নিজের যা আছে তা নিয়ে খুশি থাকতে চেষ্টা করুন। আপনার চাহিদাকে যতই দীর্ঘায়িত করবেন, সে আপনার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করবে।
কখনোই ক্ষমতার দম্ভ দেখাবেন না। সব কিছুর যেমন একটি ভালো দিক আছে, তেমনটি একটি খারাপ দিকও আছে। ক্ষমতা যদি আপনাকে দিয়ে খারাপ কাজ করিয়ে নেয়, এটিই ক্ষমতার মন্দ দিক। কারণ কিছু মানুষের ক্ষমতা দিয়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় আর কিছু মানুষকে ক্ষমতা দেয়া হয় তাকে অপমানের জন্য। তাই ক্ষমতাকে রহমত হিসেবে ভাবুন। ক্ষমতার গজব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা