রেললাইনের পাশে বাজার ও বস্তি কেন
- মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
- ১০ অক্টোবর ২০২২, ২০:০১
এ যেন ব্যস্ত এক হাট। দুই পাশে সারি সারি বাহারি দোকান। পসরা সাজিয়ে ক্রেতা- বিক্রেতার কেনাবেচার ধুম। এটা যে রেললাইন তা বোঝার উপায় নেই। ট্রেন এলেই মালামাল গুছিয়ে নেয়। আবার ট্রেন চলে গেলে একই স্টাইলে কেনাবেচা চলে। অথচ রেললাইনের ওপর এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছে! তার কারণ- আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা।’ অর্থাৎ আইন আছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। ১৮৬১ সালের রেল আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দু’পাশের ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া বাহিরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি গরু-ছাগলেরও প্রবেশ নিষেধ। গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে নিলামে বিক্রি করে দেয়ার বিধানও আছে। ট্রেনে কাটা পড়ে আহত হলে তার বিরুদ্ধে রেল কর্তৃপক্ষ মামলাও করতে পারে। রেললাইনের ২০ ফুট এলাকায় ২৪ ঘণ্টা ১৪৪ ধারা জারি থাকে। সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেফতারের বিধান আছে।
১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনে রেল চলাচলের দিকনির্দেশনা থাকলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ প্রতিফলিত হচ্ছে না; বরং আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে। রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯ অনুসারে রেললাইনের আশপাশে কোনো অবৈধ স্থাপনা কিংবা সম্পত্তি দখল করলে তাকে সাত বছর পর্যন্ত জেল জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। এত কঠোর নিয়ম থাকা সত্তে¡ও রেললাইনের দু’পাশে বস্তি ও ভাসমান বাজার ঠেকানো যাচ্ছে না।
ট্রেনে কমলাপুর স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় বিমানবন্দর স্টেশন ও টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের দু’পাশে বস্তি ও ভাসমান বাজার দেখে বিচলিত হলাম। ছোট ছোট কখনো রেললাইনের কাছে, কখনো পাশের লাইনের ওপরে উঠে লাফালাফি করছে। তাদের মনে কোনো ভয়ের ছাপ দেখছি না। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল। কখন জানি দুর্ঘটনা ঘটে। রেললাইনের দু’পাশে বস্তি উচ্ছেদ নামে প্রায়ই ইঁদুর বিড়াল খেলা হয়। বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের বিষয়টি সুরাহা হয়নি। ছোট ছোট খুপরি থেকে কারা ভাড়া আদায় করেন তা জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। রেললাইনের ২০ ফুটের ভেরতে যেখানে হাঁটা পর্যন্ত নিষিদ্ধ সেখানে কারা খুপরি বাসা গড়ে তুলছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ দিন দিন রেললাইনের পাশে বস্তি ও ভাসমান বাজারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে কখনো কখনো রেললাইন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। রেললাইন থেকে কমপক্ষে ৫০ গজ দূরত্বে যেখানে হাটবাজার বা বসতবাড়ি করার কথা সেখানে দুই গজের কম দূরত্বের মধ্যে খুপরি ঘর গড়ে উঠছে। বস্তির খুপরি ঘরগুলো লাইনের ২-৩ হাতের বেশি দূরত্ব হবে না। এসব বস্তি উচ্ছেদ না করার ফলে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে, অনেকে অঙ্গপ্রতঙ্গ হারাচ্ছে।
রেললাইনের ওপর ভাসমান বাজার নতুন নয়। বেশ পুরনো ঘটনা। বর্তমানে ভাসমান বাজারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব বাজারে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। লাইনের ওপর অবাধে চলাফেরা নিষিদ্ধ হওয়া সত্তে¡ও মানুষ চলাচল করছে এবং প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ৪০০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে এসব অবৈধ বাজার উচ্ছেদ করা হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কারওয়ান বাজার ও জুরাইনের মতো জায়গায় অবৈধভাবে বাজার গড়ে উঠলেও রেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কারওয়ান বাজারের রেললাইনের ওপর বাজার বসা নিয়ে একটি রিপোর্ট দেখলাম। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেললাইনের বাইরে মাছ বিক্রি করতে হলে ডালাপ্রতি ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত লাইনম্যানদের দিতে হয়। আর লাইনের ওপর মাছ বিক্রি করলে ডালাপ্রতি ১০০ টাকা দিতে হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ক্রয়-বিক্রয় করছে। ট্রেন এলেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। আবার ট্রেন চলে গেলে একই দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাঠকেরা নিশ্চয় ২০১৪ সালের দুর্ঘটনার কথা এখনো ভোলেননি।
ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সকালে কারওয়ান বাজারে রেললাইনের ওপর মাছের বাজার বসেছিল। এ সময় একই সঙ্গে দুটো ট্রেন চলতে গেলে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ওই সময় ট্রেনের ধাক্কা ও নিচে কাটা পড়ে চারজন মানুষ মারা যান, গুরুতর আহত হন আটজন। এরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা আমরা কেউ চাই না।
সারা দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। রাজধানীর মতো জায়গায় এত ভাসমান বাজার ও বস্তি কিভাবে গড়ে উঠল তা বোধগম্য নয়। রাজধানীর ভাসমান বাজারগুলো হচ্ছে- কারওয়ান বাজার লেভেলক্রসিং, মালিবাগ, মগবাজার, তেজগাঁও, নাখালপাড়া, খিলখেত, জুরাইন, গেন্ডারিয়া ও মহাখালী। রেলওয়ে পুলিশের ভাষ্যমতে কমলাপুর থানা এলাকায় প্রায় অর্ধশত বাজার রয়েছে। তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টির মতো। তারা বলছেন, বাজারকে কেন্দ্র করে লাইনের ওপর দিয়ে পার হতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা গেছে। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২১ সালে শুধু লেভেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মানুষ মারা গেছে। আর অসতর্ক বা কানে হেডফোন দিয়ে হাঁটার সময় ১২৩টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন মানুষ মারা গেছে। যদিও রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। কিছু অসাধু সিন্ডিকেট ও ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী নেতার কারণে রেললাইনের ওপর থেকে অবৈধ বাজার ও বস্তি উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে সরকারি প্রকল্প বা পুনর্বাসনের প্রস্তাব থাকা সত্তে¡ও বস্তির দৃশ্য বদলায়নি। বরং রেললাইনের ধারে গজিয়ে ওঠা বস্তির সংখ্যা কমেনি; বরং বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। শুধু উচ্ছেদই সমাধান নয়; প্রয়োজন বস্তিবাসীর জন্য নিরাপদ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, যেন রেললাইনের দু’পাশ দখলদারের ছোবল থেকে মুক্তি পায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা