৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যুদ্ধ বন্ধ না হলে মন্দাও বন্ধ হবে না

ইউক্রেন যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি রুশ ট্যাঙ্ক। - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বজুড়েই এখন অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সারা বিশ্বে এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার এখন ব্যয় সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু ব্যয় সঙ্কোচন নীতির মাধ্যমে আমরা জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে যতই চেষ্টা করি না কেন, তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য কোনো ধরনের সুফল বয়ে আনবে না। ব্যক্তি বিশেষের ব্যয় সঙ্কোচন ওই ব্যক্তির জন্য সাময়িক অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনে এ কথা ঠিক; কিন্তু সবাই যখন ব্যয় সঙ্কোচন করে তখন অর্থনীতিও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। কারণ, একজনের ব্যয় মানে কিন্তু আরেক জনের আয়। তাই সবাই যদি ব্যয় কমিয়ে দেয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের আয় কমে যায়। বাজারে মুদ্রার প্রবাহ কমে যায় এবং অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অর্থনীতি বিকশিত না হয়ে উল্টো সঙ্কুচিত হয়। অর্থনীতিতে মন্দার সৃষ্টি হয় ও মানুষের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। পৃথিবী থেকে যতদিন যুদ্ধ বন্ধ না হবে, ততদিন অর্থনৈতিক মন্দাও বন্ধ হবে না।

মানুষের ব্যয় সঙ্কোচন নীতি কিভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করে একটু ব্যাখ্যা করছি। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের আয়ই সীমাবদ্ধ। যারা অনেক বড় ব্যবসায়ী, জমিদার ও বড় বেতনের চাকরিজীবী কেবল তাদেরই আর্থিক সমস্যা নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সমস্যা নেই, তাদের ব্যয় কমাতে হয় না; কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, দিনমজুর, ছোটখাটো ব্যবসায়ী- তাদের সবারই আয় সীমিত ও নির্দিষ্ট। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে এরা সমস্যায় পড়েন। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কেনাকাটা কমিয়ে দেন। অনেকে অপেক্ষাকৃত বড় বাসার পরিবর্তে একটি ছোট বাসা ভাড়া নেন। কেউ বা বাসার কাজের মানুষটিকে বিদায় করে দেন। এতে কাজের লোকটি বেকার হয়ে যায় এবং তার পরিবার কষ্টে পড়ে। তারা যদি ব্যক্তিগত কোনো গাড়ি ব্যবহার করেন, তাহলে খরচ কমানোর জন্য গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে দেবেন। এর অংশ হিসেবে ড্রাইভারকে চাকরি থেকে বিদায় করবেন। গাড়ির তেল কেনা কমিয়ে দেবেন। নতুন গাড়ি কেনাও কমে যাবে। ফলে গাড়ির আমদানিও কমবে। এতে করে গাড়ি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

খরচ কমানোর অংশ হিসেবে এসব ব্যক্তি বাসায় পত্রিকা কেনা বন্ধ করে দেবেন। পত্রিকার মালিক, প্রেসের মালিক, পেপার মিলের মালিক, কাগজ ও কালি বিক্রেতা, পত্রিকা বিক্রেতাসহ এ খাতে জড়িত সবারই আয় কমে যাবে এবং তারা সমস্যায় পড়বেন। খরচ কমাতে গিয়ে তারা পোশাক ক্রয় কমিয়ে দেবেন, হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া কমিয়ে দেবেন এবং বেড়ানো কমিয়ে দেবেন। ফলে পোশাক ব্যবসায়ী, হোটেল, পরিবহন ব্যবসায় এবং পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বিপদে পড়বেন। খরচ কমাতে গিয়ে তারা বিলাসিতা পরিহার করবেন এবং এতে সব ধরনের বিলাস সামগ্রীর ব্যবসায়ে জড়িতরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ, ফ্ল্যাট কেনা আপাতত স্থগিত রাখবেন অনেকে। ফলে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, টাইলস, সেনিটারি আইটেম, রঙ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ এসব খাতে জড়িত ব্যবসায়ীদের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পরিণতিতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে।

মূলত একটি দেশের সব মানুষের ব্যয় সঙ্কোচন আরেকটি দেশের অর্থনীতি এবং মানুষকে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর সব দেশের ব্যয় সঙ্কোচন নীতি সব দেশের অর্থনীতিকেই বিপর্যস্ত করে। এতে পুরো বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের মানুষ গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে দিলে দেশে গাড়ি ও জ্বালানি তেল আমদানি কমে যাবে। ফলে জাপানের গাড়ি রফতানি ও সৌদি আরবের তেল রফতানি কমে যাবে।

আবার ব্যয় সঙ্কোচন করতে গিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার জনগণ পোশাক কেনা এবং চিংড়ি খাওয়া কমিয়ে দিলে বাংলাদেশের পোশাক ও চিংড়ি রফতানি আয় কমে যাবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতে জড়িত সবারই ক্ষতি হবে। শিল্পপতিরা সমস্যায় পড়বেন বিধায় নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করবেন না। ফলে ব্যাংকের বিনিয়োগ ও আয় কমে যাবে। একই সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় বেকার বেড়ে যাবে। আবার আমদানি-রফতানি কমে গেলে শিপিং ও পরিবহন ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি দেশের আমদানি মানে কিন্তু আরেকটি দেশের রফতানি। সুতরাং একটি দেশের আমদানি ও আমদানি ব্যয় কমে গেলে, আরেকটি দেশের রফতানি ও রফতানি আয় কমে যাবে। যেহেতু পৃথিবীর কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতিটি দেশেই একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেহেতু ব্যয় সঙ্কোচন পুরো বিশ্বের অর্থনীতিরই ক্ষতি করবে।

যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হলো- বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার জন্য যুদ্ধই অন্যতম কারণ। তাই মন্দাবস্থা কাটাতে হলে সবার আগে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধ এক ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া। এতে সব কিছুই কেবল ধ্বংস হয়। বিপুল মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অথচ পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগেই আছে। সব সময়ই বিশ্বের কোনো না কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ বিদ্যমান ছিল, এখনো আছে। এক জায়গায় যুদ্ধ বন্ধ হলে সাথে সাথেই আরেক অঞ্চলে শুরু হয়েছে। এ যেন এক চলমান প্রক্রিয়া।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ায় আগ্রাসন চালিয়েছে, যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। এখন আবার ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ চলছে। এসব যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কোনো ধরনের কল্যাণ বয়ে আনেনি; বরং সর্বক্ষেত্রে ধ্বংস ও ক্ষতিই বয়ে এনেছে।

জাতিসঙ্ঘ বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ের পুরোটাই অনুৎপাদনশীল ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আর এর পুরোটাই ক্ষতি। তাই বিশ্ব অর্থনীতিতে আজ এত সঙ্কট ও মন্দার পদধ্বনি।

অর্থনৈতিক লেনদেনের একটি নিয়ম আছে যা প্রতিটি লেনদেনেই প্রযোজ্য। সেটি হলো- ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের লাভ হওয়া। হয়তো একজনের বেশি আরেকজনের কম লাভ হতে পারে; কিন্তু দু’পক্ষই নিশ্চিতভাবে লাভবান হবেন। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ সূত্র প্রযোজ্য হয় না। যুদ্ধে একটি বোমা ব্যবহৃত হলে একটি বাড়ি ধ্বংস হয়। ফলে বোমার উৎপাদনখরচ ও বাড়ির নির্মাণখরচ উভয়ই সরাসরি ক্ষতি।

এভাবেই যুদ্ধে ব্যয় করা অর্থের পুরোটাই কেবল বিনষ্ট হয়। বিনিময়ে কোনো রিটার্ন আসে না। এভাবেই মন্দার সৃষ্টি হয়। আর পৃথিবীর দেশগুলো যেহেতু একে অন্যের সাথে যুক্ত ও নির্ভরশীল তাই মন্দায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের জোয়ার-ভাটা, হিমালয় আর মেরু অঞ্চলের বরফ গলায় সারা বিশ্বের পানির স্তর যেমন প্রভাবিত হয় ঠিক তেমনি পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের দু’টি দেশের মধ্যকার যুদ্ধে সারা বিশ্বের অর্থনীতিও প্রভাবিত হয়।

যুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য সবসময় কেবল দুর্ভোগই নিয়ে আসে। যে দুর্ভোগের পরিমাণ হিসাবের বাইরে, যার বোঝা সারা বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষকে বইতে হয়।

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সারা বিশ্বের নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়ে এবং প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ এর ফলে কষ্ট পায়। সুতরাং বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের এই দায়ভার যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর ওপর বর্তায়। অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো, তাদের জনগণ ও নেতারা কেউই পৃথিবীতে যুদ্ধ শুরু করেনি। তাই চলমান বিশ্বমন্দার জন্য তারা দায়ী নন। মূলত সবচেয়ে উন্নত, সভ্য ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের সৃষ্ট দুর্ভোগ তারা বহন করছে। এ রাষ্ট্রনেতাদের সৃষ্ট যুদ্ধ পুরো মানবজাতির জন্য ভয়াবহ দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। তাদের ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে সারা বিশ্বে আজ অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে কষ্ট পাছে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ।

এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধ-সঙ্ঘাত চিরতরেই বন্ধ করতে হবে। বিশ্বকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করতে হবে। মানুষকে স্বাভাবিক এবং ভীতিহীন পরিবেশে কাজ করার ও বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে হবে। তা হলে মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড, উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। ফলে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও বিকাশ স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকবে এবং অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হবে না।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement