নদী শাসন ও বেশি খাল-বিল খনন জরুরি
- মো: আতিকুর রহমান
- ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৫৯
নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের সুজলা-সুফলা কৃষিনির্ভর এই দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ শত শত নদ-নদী, যা কেবল আমাদের অবহেলায়, উদাসীনতায়, অপরিচর্যায় ও প্রয়োজনীয় নদী শাসনের অভাবে ক্রমেই শুকিয়ে মৃত খাল ও মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে, যা দুঃখজনক। বর্তমানে যথাযথ নদী শাসনের অভাবে নদীপথের পানির প্রবাহ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি নদী ভরাট হয়ে বর্ষার সময়ে ভয়াবহ নদীভাঙনের তীব্রতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে নদীর দু’ধারের আবাদি জমি ও বসতভিটা নদীতে বিলীন হচ্ছে। এতে যেমন নদীপাড়ের শত শত জনগণ সহায়-সম্বল হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে একেবারে নিঃস্ব, হতদরিদ্র ও ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে, ঠিক তেমনি আবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে এ দেশে ঘন ঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে। এতে যেমন শত শত ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে, জীবজন্তু মারা যাচ্ছে, আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে ফলে কৃষির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে; দেশ ও জাতি হচ্ছে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও কৃষি খাত হচ্ছে বিপর্যস্ত। প্রতি বছর অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের কারণে সরকারের যে পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করছে সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে যদি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে নদ-নদীগুলোকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা যদি উদার দৃষ্টি ও বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারত তবে আমরা মনে করি, এতে সরকারের অর্থের সাশ্রয়ের পাশাপাশি আবাদি জমির ভাঙন রোধ, হতদরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনাসহ নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একই সাথে, দেশের কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়ন, আমদানিকৃত সেচের জন্য ডিজেলের চাহিদারোধসহ দেশের পরিবেশ ও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ভারত যেখানে তাদের কৃষিকাজে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বন্যার পানি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ, নদী শাসন ও বেশি খাল-বিল খননের প্রকল্প হাতে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে পানিসঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; সেখানে আমরা আমাদের এই মৃত নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনি যা দেশের ভয়াবহ প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে করি। সম্প্রতি পরপর দু’টি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন তারই প্রমাণ বহন করে। তাই অতিদ্রুত ওই সমস্যা সমাধানে এই খাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়াকে জরুরি বলে আমরা মনে করি। দীর্ঘ দিন এসব নদ-নদীর সঠিক পরিচর্যাহীনতা, নীতিনির্ধারকদের বেশি উদাসীনতা, প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা, বৈদেশিক সম্পর্কিত দেশগুলোর মধ্যে ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ও নদ-নদীর আগ্রাসন বন্ধ না হওয়াসহ এই খাত উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সরকারি অর্থ বরাদ্দ তেমন না থাকায় নদীগুলো শুকিয়ে নদীমাতৃক এই দেশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, নদীভাঙন রোধের জন্য কখনোই ড্রেজিংই এক সমাধান নয়। ড্রেজিং পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল, যা সরকারের পক্ষে করে ওঠাও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, নদীগুলো বছরের যে পরিমাণ পলি ধারণ করে সেখানে ড্রেজিং পদ্ধতি কার্যকর নয়। আমাদের নদীর চরিত্রগুলো বুঝতে হবে। সব নদীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কিন্তু আবার এক রকম নয়। কোনো নদী বেশি পলি ধারণ করে, আবার কোনোটা কম। কোনোটি বেশি খরস্রোতা, কোনোটি আবার সারা বছরই সমান তালে চলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি ধারণ করে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা। এক কথায় বলতে, দেশের বড় নদীগুলোরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো পলি ধারণ করা। তাই নদীর বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত রেখে তাকে ব্যবহারোপযোগী করতে হবে। এ জন্য নদী শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ পলি ধারণ করার কারণে তার পাড় ভাঙে। তাই আমাদের নদী শাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নদীর পাড় সংরক্ষণ করা। পাড় বাঁধা। সেই পাড় বাঁধাটাও আবার তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী করতে হবে। যে দিকটা বেশি ভাঙছে সে দিকটাকে বেশি শক্ত, মজবুত করতে হবে। লোকালয় থেকে একটা স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং সর্বোপরি, সেই কাজের সাথে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ড্রেজিং পদ্ধতিটাকে আমরা তখনই ব্যবহার করব, যখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে হবে। হয়তো এখানে নদী লোকালয়ে ঢুকে যাচ্ছে বা চরটাকে অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করতে হবে। সে সময় নদীর তলদেশ খনন করে নদীর মোড়টা বা মুডটা পাল্টানো যেতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কিন্তু তাই করা হয়। আমাদের নদীগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে শাসন করার জন্য নদীর পাড় বাঁধতে হবে যেন সে তার নিজস্ব আচরণ অব্যাহত রাখতে পারে; তার পলি ধারণ করে যেন সে পানিপ্রবাহ সচল রাখতে পারে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছর এত পরিকল্পনা করে, যার বাস্তবায়ন দেখা যায় বন্যা হলে, তা বাস্তবে কোনো সুফল বয়ে আনে না। নদী সংরক্ষণে এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা, তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করলে তারাও বিষয়গুলো সম্পর্কে একধরনের শিক্ষা গ্রহণ করে। তখন সে জরুরি মুহূর্তে সেবা দিতে পারে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
বস্তুত এই অবস্থাটা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যথাযথ পরিচর্যা, নদীখনন, পানিদূষণ ও উপযুক্ত নদী শাসনের অভাবে এখন এ দেশে প্রায় সব নদ-নদী মৃতপ্রায় যা কৃষিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। নদীর পানি অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের উপরের পানি না থাকার কারণে কৃষিকাজে সেচ প্রদানের ফলে গভীর নলকূপে ব্যাপক ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি ব্যবহৃত ডিজেলের আমদানি নির্ভরশীলতাকে কমিয়ে এসব নদ-নদীর পানি কৃষিকাজে বেশি ব্যবহার করতে পারতাম তবে কৃষি খাতে জ্বালানি ভর্তুকি কিছুটা রক্ষা করা যেত। এর ফলে কৃষকদের কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কম হতো। সরকারের আমদানিকৃত ডিজেলে বেশি ভর্তুকি হ্রাস পেত। বর্তমানে কৃষি ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির অভাব। ফলে চার দিকে পানি সঙ্কটে হাহাকার পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বর্তমানে আমরা মনে করি, এই সেক্টরে বেশি দলীয়করণ; স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার ও সুশাসনের অভাবে এর সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে না। অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ, পানিদূষণ, বেশি জনসংখ্যা, ঘনবসতি, নদ-নদী খননে ব্যর্থতা, নদী শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা, দক্ষ জনশক্তি, এ খাতে বেশি দুর্নীতি এবং কৃষিতে সেচকাজে ভূগর্ভের পানির বেশি ব্যবহার এবং যথাযথ পরিচর্যার অভাবে এই নদীগুলো বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, যা দেশের কৃষি খাতকে করছে বিপর্যস্ত, প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে মন্দ, পানি সঙ্কট আমাদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকাকে করছে মারাত্মক বিপর্যস্ত। এই সঙ্কট ও বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে অতিদ্রুত কৃষিকাজে পানিসঙ্কট নিরসন করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নদী শাসন ও বেশি খাল-বিল খনন প্রকল্প গ্রহণ করতে সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা কামনা করছি।
লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস-এর
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা