৭৫ বছরে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান
- হামিদ মীর
- ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:২১
পাকিস্তান ৭৫ বছর পূর্ণ করল। বর্ষপূর্তি যতটা উদযাপনের উপলক্ষ হতে পারে, আত্মসমালোচনা বরং তার চেয়েও গুরুতরভাবে হওয়া উচিত। অনেক পাকিস্তানি নিজেদের বিশ্বের প্রথম মুসলিম পারমাণবিক শক্তি হওয়ার কৃতিত্ব উল্লেখ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়লে পারমাণবিক অস্ত্র কিভাবে পাকিস্তানকে বাঁচাবে? সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের সংসদ, বিচার বিভাগ ও মিডিয়া দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটি লজ্জাজনক যে, চারজন সামরিক শাসক ৩২ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তান শাসন করেছেন। বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীরা ৪৩ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন। কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেননি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনের ৭৫ বছরে পাঁচবার পাকিস্তানের তিনটি ভিন্ন সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে।
এটি সত্য, যে পাকিস্তানকে একটা সময় নিয়মিত একটি গ্যারিসন রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হতো, তবে ২০০৭ সাল থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ নেই। তারপরও গণতন্ত্র এখনো খুব দুর্বল। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সম্প্রতি পাকিস্তানকে একটি হাইব্রিড শাসনের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এটি এমন একটি দেশ, যার কিছু গণতান্ত্রিক দিক থাকা সত্ত্বেও সেটি উপযুক্ত গণতান্ত্রিক হিসেবে যোগ্য নয়। এটি কোনো গোপন বিষয় নয়, জেনারেলরা ২০১৮ সালে প্রভাব খাটিয়ে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
খানের অধীনে পাকিস্তান যখন ‘অশাসনযোগ্য’ হয়ে ওঠে, তখন সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরের শুরুর দিকে, খান তার সরকারকে বাঁচাতে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে একটি সঙ্কট তৈরি করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদীয় অনাস্থা ভোটে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। এরপর তিনি তার পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে থাকেন। তিনি সামরিক নেতৃত্বের নিরপেক্ষতাকে আক্রমণ শুরু করেন এবং তাদের দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করেন। তিনি সেই জেনারেলদের ব্লাকমেইল করে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করেন, যারা তাকে একবার প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তবে তার কৌশল কাজ করেনি।
তার আমেরিকা বিরোধিতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট তাকে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। এখন, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে দুর্নীতি ও নিষিদ্ধ তহবিলের অভিযোগে আরেকটি মেয়াদে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন। ২০১৭ সালে, সুপ্রিম কোর্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে খানের বিজয় সম্ভব করে তোলেন। বর্তমান সরকারও তাই করতে চায়। এটি ন্যায্য হলেও, আরেকজন জনপ্রিয় নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করলে তা আরো অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার সুনাম নেই। দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট একটি গ্রুপ, যা সারা বিশ্বে আইনি ব্যবস্থার ওপর নজর রাখে। তারা আইনের শাসনের ক্ষেত্রে ১৩৯টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানকে ১৩০ নম্বরে রেখেছে। স্বৈরশাসক ও বিচারকদের মধ্যে সমঝোতার একটি ঐতিহাসিক প্যাটার্ন গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। পাকিস্তানি বিচারকদের রাজনীতিতে জড়ানো বন্ধ করতে হবে। একদিকে খান সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জ করছেন, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরকার খানকে অযোগ্য ঘোষণা করতে আদালতে চাপ দিচ্ছেন। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে লড়াই করছে।
ক্ষমতার খেলোয়াড়দের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াইয়ের আরেকটি ক্ষতিগ্রস্ত দিক হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। ২০২২ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে পাকিস্তানের অবস্থান হচ্ছে ১৮০-এর মধ্যে ১৫৭তম। ২০১৮ সালে খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তান র্যাংকিংয়ে ১৮ পয়েন্ট হারিয়েছে। টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, গ্রেফতার ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
খান ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার পর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো হুমকির মুখে। গত বছর আমার সহকর্মী আসাদ তুর ও আবসার আলমের ওপর হামলা হলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ তাদের সাথে দেখা করেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার খানপন্থী টিভি চ্যানেল এআরওয়াই নিষিদ্ধ করেছে। ওই চ্যানেলের মালিক ও উপস্থাপকদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সমালোচনা প্রচারের দায়ে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর যখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিলাম, তখন এআরওয়াইয়ের বিশ্লেষকরা আমাকে কারাগারে দেখতে চেয়েছিলেন। এর একজন উপস্থাপক আমাকে পাকিস্তানের শত্রু ঘোষণা করেছিলেন, কারণ আমি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছিলাম, যারা আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীকে আক্রমণ করেছিলেন। তবু দেশ ছেড়ে যাইনি। আমি এখানে থাকাকে বেছে নিয়েছি। আমার প্রাক্তন সমালোচকরা এখন একই ধরনের অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। আমি তাদের কণ্ঠ রোধ করাকে সমর্থন করি না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অপরিহার্য স্তম্ভ। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার বিস্তৃত আলোচনার অনুমতি দেয় না এমন কোনো গণতন্ত্রের কথা কল্পনা করা কঠিন। গত বছর আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়া আমাকে ৯ মাসের জন্য আকাশপথে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ইমরান রিয়াজ নামে আরেক উপস্থাপককে কোনো অভিযোগ ছাড়া তার চ্যানেল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ধরনের কৌশল শুধু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়াকে দুর্বল করবে না; বরং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি গণতন্ত্রকে একটি রসিকতায় পরিণত করবে।
আমি জানি, আমার সাথে যাদের ভালো সম্পর্ক বা আমার প্রতি যাদের ভালো ধারণা ছিল না, তাদের পক্ষ নিতে আমি ক্ষমতায় থাকা লোকদের কাছ থেকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারি। কিন্তু আমি মনে করি না, প্রতিশোধ গ্রহণ আমাদের সমস্যার সমাধান। আমি মনে করি, খানকে বলা উচিত, শরিফকে অযোগ্য ঘোষণাকে সমর্থন করা তার ভুল ছিল। শরিফেরও উচিত, খানকে অযোগ্য ঘোষণার বিরোধিতা করা।
প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের মানুষ, যার নেতৃত্বে আছেন খান। শাহবাজ শরিফ সেই নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই, যিনি ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। এ দুই শক্তির খেলোয়াড় কি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক অংশীজনদের সাথে একটি সংলাপ শুরু করতে পারেন? আইনের শাসন ও সংবিধানের আধিপত্য এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ। একমাত্র তারা পারেন প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে।
ওয়াশিংটন পোস্টের সৌজন্যে
ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা