হঠকারিতা বিপর্যয় ডেকে আনবে
- আবুল কালাম মানিক
- ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০৪
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় সফল গণআন্দোলন হয়েছে। পাঁচ মাসব্যাপী তুমুল গণবিক্ষোভে নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছে। প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিক্ষুব্ধ জনগণ। প্রতিবাদকারীরা ১৪৪ ধারা ও কারফিউ অমান্য করে রাজপথ দখলে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্রও ছিনিয়ে নেয় কেউ কেউ। কিন্তু শ্রীলঙ্কা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী খুব দক্ষতা ও ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি সামাল দেয়। বিক্ষোভকারীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সীমিত শক্তি প্রয়োগ করে। এ সময়ে মাত্র একজন বিক্ষোভকারী নিক্ষিপ্ত কাঁদানো গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। আহত হয় ৮৪ জন। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে মাত্র দেড় মাসে বিনা প্ররোচনায় পুলিশের গুলিতে তিন তিনটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়েছে, আহত হয়েছে কয়েক শ’ বিক্ষোভকারী।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ভোলায় আহূত মিছিলে পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আব্দুর রহিম ও ছাত্রদল নেতা নূরে আলম নিহত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই বিগত ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রায় গুলি করে যুবদল কর্মী শাওন প্রধানকে হত্যা করা হয়। প্রধান বিরোধী দলের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০টি মামলায় ২৪ হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে এবং পুলিশ তাদের বাড়িঘরে হানা দিচ্ছে। আসামিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অতীব ভয়ঙ্কর, উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং ভোলায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতা নিহতের প্রতিবাদে বিগত ২২ আগস্ট ১০ দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। রাজধানী ঢাকায় কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলেও, দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিএনপির সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলে হামলা চালায়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলার ভয়াবহতার চিত্র ফুটে ওঠেছে বিগত ৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তিনটি প্রতিবেদনে। এসব প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকারি দল, মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ একাট্টা হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে কোনঠাসা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত সংবাদের শিরোনামগুলোই পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট। ‘পুলিশ-আ’লীগ আতঙ্কে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি,’ ‘বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে হামলা-সংঘর্ষ চলছেই’, ‘ঢাকায় বিরোধী দলের পাড়া-মহল্লার নেতাদের তালিকা করছে পুলিশ।’
প্রতিবেদনে পুলিশের গ্রেফতার আতঙ্ক এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলার ভয়ে নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত এক ছাত্রদল নেতা বলেছেন, ‘আমাদের কর্মীদের হত্যার পর আমাদেরই মামলার আসামি করা হয়- ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। আমরা এখন বাড়িতে থাকতে পারি না।’ বিরোধী দলের নেতাদের অভিযোগ, নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় এবং মামলার আসামি করার জন্য নির্বাচনের আগে পুলিশ তালিকা করছে।
বিরাজমান সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিরতায় জনজীবনে সৃষ্ট চরম দুর্ভোগের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আহূত বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশ ও কর্মসূচির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতগুলো ব্যতিক্রমধর্মী নির্দেশনা জারি করেছিলেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড চাপ উপেক্ষা করে হরতালের মতো কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তারপরও অনাকাক্সিক্ষত রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল ও শোভাযাত্রার ওপর গুলিবর্ষণ সম্প্রতি ঢাকা সফররত জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মিশেল ব্যাশেলেতের উদ্ধৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বাংলাদেশে পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করে তাদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ পন্থায় বিরোধী দলের কর্মসূচি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে তার কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছে না। রাজনৈতিক সঙ্কট অতীতের রক্তাক্ত পথে ধাবিত হওয়ার আলামত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনা প্রবাহে প্রমাণ হয়েছে, সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সুদূর পরাহত।
গত ২৩ জুলাই রোববার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের এক যৌথ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসলে বিএনপিকে বাধা দেয়া হবে না। তাদের বসিয়ে চা খাওয়ানো হবে, তবে বোমাবাজি ও ভাঙচুর করলে উপযুক্ত জবাব পাবে তারা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি বসাব, চা খাওয়াব, কথা বলতে চাইলে শুনব। কারণ, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই।’ তা ছাড়া, বিগত ১৪ আগস্ট গণভবনে প্রধানমন্ত্রী কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেন। সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস পরিবেশিত নির্দেশনার খবর পরের দিন দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। সংবাদের শিরোনাম ছিল : ‘যারা আন্দোলন করছে, তাদের যেন গ্রেফতার করা না হয়।’ নির্দেশনায় তিনি আরো স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরোধী দল একটা সুযোগ পাচ্ছে, তারা আন্দোলন করবে, করুক। আমি আজকে নির্দেশ দিয়েছি খবরদার, যারা আন্দোলন করছে, তাদের কাউকে যেন গ্রেফতার করা না হয়, বা ডিস্টার্ব করা না হয়। শেখ হাসিনা বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলের আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে বলেন, আন্দোলনের নামে বাড়াবাড়ি জনগণের দুর্ভোগ আরো বাড়াবে।
প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখিত নির্দেশনায় শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা কার্যকর না হওয়ায় তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে সরকারি দল, প্রশাসন ও পুলিশ বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মিছিল, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। এসব সহিংস হামলায় অনেক নেতা-কর্মী নিহত ও আহত হয়। বিস্ময়করভাবে প্রশাসন ও পুলিশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধেই মামলা করে এবং অনেককেই গ্রেফতার করে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসন ও পুলিশের প্রকাশ্য অনীহার কারণে সঙ্কট ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে। ফলে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা সৃষ্টির ন্যূনতম অথবা দূরতম কোনো সম্ভাবনাও অবশিষ্ট থাকল না। সঙ্গত কারণেই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আন্তরিক কি না। নাকি এটি নতুন কোনো রাজনৈতিক কৌশল।
এদিকে বিগত ১২ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক পেশাজীবী সমাবেশে বলেন, ‘আজকে আমরা এখানে বসে আছি, চারদিকে পুলিশ আছে, খুব ঝামেলা করছে না। কারণ একটাই তারা দেখাতে চাচ্ছে যে আমরা (আওয়ামী লীগ) খুব গণতান্ত্রিক দল। আমরা খুব ঝামেলা করি না। এগুলো প্রতারণা। এই প্রতারণা তাদের চরিত্রের সাথে জড়িয়ে আছে। গত ১৫ বছরে তারা আমাদের ছয় শতাধিক নেতা-কর্মীকে গুম করেছে। সহ¯্রাধিক কর্র্মীকে হত্যা করেছে। সেদিন ভোলায় বিনা কারণে দুজন তরুণ নেতাকে গুলি করে হত্যা করেছে।’ আন্দোলনে সরকার পক্ষের বাধা না দেয়ার অঙ্গীকার সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিবের সংশয়ের বাস্তব প্রতিফলন খুব অল্প সময়েই দৃশ্যমান হয়। বিগত ৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মাত্র ১৪ দিনের আন্দোলনে ২০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ভোলায় পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আব্দুর রহিম এবং ছাত্রদল নেতা নূরে আলম নিহত হয়েছে। পুলিশ-আওয়ামী লীগ যৌথ হামলায় দুই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছে। দুই শতাধিক গ্রেফতার হয়েছে। ২০ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় চার হাজার ৮১ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। ৫০টি জায়গায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করে ২৫টি স্থানে বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড করে দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন বিরোধী দলকে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেয়া হবে। প্রধান বিরোধী দলও মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড বাধা উপেক্ষা করে ‘এখনই’ হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা না করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এতে চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিরতার কারণে জনজীবনে সৃষ্ট গভীর সঙ্কট এবং সামনের দিনগুলোতে ঘনায়মান নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্ঘাত সংলাপের মাধ্যমে নিরসনের একটি পথ রচিত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু অনাহূত রক্তপাত এবং পুলিশ ও সরকারি দলের বাড়াবাড়ি পুরো দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রশাসনকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংস সঙ্ঘাতে বিপুল প্রাণহানিসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টের তিক্ত অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবারো সেই অশুভ যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটানো হবে হঠকারিতার শামিল। হঠকারিতা নিঃসন্দেহে দেশকে পুনরায় রক্তপাত ও অনিশ্চয়তার পথে ধাবিত করবে। অতীতের ন্যায়সঙ্গত কারণেই এর দায়দায়িত্বও সরকার ও সরকারি দলকেই নিতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা