০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩০, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

নির্বাচন কমিশনের বাগাড়ম্বর

নির্বাচন কমিশনের বাগাড়ম্বর - প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন তাদের মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বক্র করে সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের প্রতি তাদের অনুগত কর্মকাণ্ডে মনে হয়, নিজেদের বিবেক পর্যন্ত সরকারের কাছে বন্ধক রাখা আছে। যার কারণে সংবিধান যে তাদেরকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছে তা তারা বেমালুম ভুলে যায়। নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড এবং তাদের কর্মপরিকল্পনার সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয় তারা সংবিধানের কাছে নয় বরং সরকারের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশনের ভ‚মিকা কম নয়। নির্বাচন কমিশন যদি বিবেক দ্বারা চালিত না হয়ে কারো দাসত্ব ও বশ্যতার শিকারে পরিণত হয় তাহলে জনগণ একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হবে। কাজেই নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচন কমিশনকে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি না রেখে স্বীয় বিবেক দ্বারা সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে, যে নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে।

নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে সংলাপের আয়োজন করেছিল। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদকসহ বিভিন্ন গ্রুপের সাথে সংলাপ করেছিল। সংলাপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগের মতামত ছিল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে। এমনকি সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপে বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।’ কেবল সরকারি দল ও গুটিকয়েক সমমনা রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে কথা বলেছিল। সেটি হয়তো মোট অংশগ্রহণকারীর মধ্যে পাঁচ শতাংশের উপরে নয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন অধিকাংশের মতামত উপেক্ষা করে মাত্র কিছু অংশের অর্থাৎ সরকারি দলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৫০টি আসনে ইভিএমে নির্বাচন হবে মর্মে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। এটাই যদি সিদ্ধান্ত হবে, তাহলে সংলাপের কী প্রয়োজন ছিল? যেখানে নির্বাচন কমিশন নিজেই গণতন্ত্র মানে না অর্থাৎ মেজরিটির মতামত উপেক্ষা করতে পারে সেখানে তারা কিভাবে সরকারের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে?

রকীব উদ্দীন, নুরুল হুদা ও আউয়াল কমিশনের বাগাড়ম্বর কারো থেকে কারোটা কম নয়। প্রথম প্রথম তাদের বাগাড়ম্বর দেখে মনে হয় তারা সুন্দরবনের সবচেয়ে শক্তিশালী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারা কোনো কিছুকেই পরোয়া করে না। তাদের হুমকি-ধমকি দেখে মনে হয় কোনো শক্তিই তাদেরকে সুষ্ঠু ভোট করতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সময় যখন ঘনিয়ে আসে তাদের দাসত্ব স্বীকারের চমৎকৃত ভাব দেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে যায়। কমিশন সচিব অশোক কুমারের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসির হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট নেয়া সম্ভব। তাহলে তারা ৭০-৭৫টি না বলে ১৫০টি আসনের কথা কেন বলল? তারা সরকারের পথ পরিষ্কার করার জন্য সরকারের শেখানো বুলিই নিজেদের মুখে প্রকাশ করেছে মাত্র। অর্থাৎ বেশি আসনে ভোট করতে আরো এভিএম কিনবেন।

সে জন্য নতুন প্রকল্পও নেয়া হবে। এতে নির্বাচন কমিশনের লাভ হবে দু’টি- এক. কমিশন বাণিজ্যও হবে; দুই. সরকারকেও খুশি রেখে নিজেদের আখের গুছানো হবে। ভবিষ্যতে আরামের বিছানায় শুয়ে সুখের নিদ্রা যাপনের জন্য এর থেকে ভালো পন্থা আর কী আছে। এর জন্য ধনুকের মতো কেন প্রয়োজনে আরেকটু বাঁকিয়ে হলেও সরকারের পায়ে প্রণাম করলে দোষ কোথায়?

নির্বাচন কমিশন অবসর জীবনে সুখনিদ্রার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও ইভিএমে ভোট দিতে দেশের মানুষ এখনো প্রস্তুত নয়। ইভিএম সম্পর্কে মানুষের নেগেটিভ ধারণা রয়েছে। কুমিল্লা নির্বাচনে ইভিএমের ধীরগতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হলে ইভিএম যে কতটা বিপজ্জনক, তারও প্রমাণ মিলেছে। দু’জন প্রার্থীর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ওই নির্বাচনে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফলে ৬২৯ ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থী শেষ চারটি কেন্দ্রের ভোটে যে নাটকীয়তায় ৩৪৩ ভোটে হেরে গেছেন, তাতে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। কুমিল্লা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৭ জুন ২০২২ তারিখে প্রথম আলোয় ড. বদিউল আলমের লেখার শিরোনাম ‘কুমিল্লায় কেউই জেতেনি, হেরেছে নির্বাচন কমিশন’ বাক্যটিই উপযুক্ত হয়েছে। জনসিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন কমিশন শুধু সরকারকে খুশি করতে গিয়ে ইভিএম ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জনগণের সাথে প্রতারণা বৈ অন্য কিছু নয়।

এই সিদ্ধান্ত দিয়ে নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে যে, তারা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষমতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত নয় বা উপলব্ধি করতে পারছে না। আমাদের নির্বাচন কমিশন অসামান্য ক্ষমতাধর একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে।’

সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে চারটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করেছে। ‘নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ এবং আইন যেখানে অসম্পূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন নির্দেশনা জারির মাধ্যমে সেই অসম্পূর্ণতাও দূর করতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে শুধু বিধিবিধানের সাথে সংযোজনই নয়, ফলাফল ঘোষণার পরও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনকে সুস্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে।’ এত ক্ষমতা পাওয়ার পরেও নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রতি যে পরিমাণ নতজানু তা দেখে মনে হয় তারা সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েই এই পদে এসেছেন।

কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেয়ার পর ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার’ অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করবেন। সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তির কথাও তিনি বলেছেন। কিন্তু কমিশনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তিনি ক্ষমতাসীন দলকে সরাসরি আলোচনার অনুরোধ জানাতেও সাহস করেননি। অর্থাৎ তার সব বুলি মুখের বাণী হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। দেশের প্রতি, সংবিধানের প্রতি সর্বোপরি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। অথচ জনগণ মনে করে একটি দন্তবিহীন নয়; দন্তযুক্ত নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। কিন্তু রকীব উদ্দীন কমিশন থেকে শুরু করে নুরুল হুদা কমিশন এবং বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের অবস্থাও দন্তহীন বাঘের মত। রকীব উদ্দীন এবং নুরুল হুদা কমিশন নির্বাচনী সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায় তা ধ্বংস করে গেলেও তারা তা স্বীকার না করে বরং তারা সফলতার জয়গান গেয়েছেন।

অথচ রাষ্ট্রের সব শ্রেণীর মানুষের অভিমত হলো- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, রকীব উদ্দীন এবং নুরুল হুদা কমিশন তা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু রকীব উদ্দীন ওই সময় বলেছিলেন, তাদের কোনো ব্যর্থতা ছিল না।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনে যে ক্যান্সারের বীজ বপন করেছিল আজ তা ফুলে ফলে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। যার কারণে নির্বাচন কমিশনের হাবভাব দেখে মনে হয় আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল বা না করল তাতে নির্বাচন কমিশনের কী যায় আসে। তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এসে খালি মাঠে গোল দিতে পারলেই তারা শতভাগ সফলতা ঢেঁকুর তুলতে পারবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার’ যে অঙ্গীকার করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করার যে কথা বলেছিলেন, এখন সেই সুর পাল্টে ফেলেছেন। এখন নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হলো, কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াসও নেবে না। এর মানে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সংলাপ বর্জনকারী দলগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে স্বস্তি দেয়ার সব ব্যবস্থা করে দেয়ার অঙ্গীকার কমিশনের মাথায় আছে।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকার নিজেই নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই করে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা খাঁটি নাকি ভেজাল আছে তা কষ্টিপাথরে যাচাই করেই তাদের শপথের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং তারা তাদের খাঁটিত্বের পরিচয় নিয়োগকর্তাকে দেবেন এটাই তো ঈমানদারিত্ব। জনগণের ভোটাধিকার রসাতলে যাক, নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ঈমানের পরীক্ষায় পাস করলেই তো আউয়াল কমিশন, রকীব উদ্দীন এবং নুরুল হুদা কমিশনের মতো শতভাগ সফলতার ঢেঁকুর তুলে জয়গান গাইতে পারবে।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজ সিকদার-আবু সাইদ হত্যা একই সূত্রে গাঁথা : রাশেদ প্রধান আন্দোলনে আহত রাতুলকে আর্থিক সহায়তা দিলো বিজিবি গাবতলীতে দিনমজুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ বিএসএমএমইউ পরিচালকের পদত্যাগে আলটিমেটাম রাবিতে পোষ্য কোটা বাতিল কবরস্থানে চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার ২০২৫ সেশনের জন্য ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গঠন দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কচির পদ স্থগিত দুই জেলায় বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত, একটিতে স্থগিত সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা রোববারের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারতে আটক জেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে

সকল