নির্বাচনে ইভিএম : বিশ্বাস ও অবিশ্বাস
- আদিত্য রহিম
- ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০২
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয় ২০১১ সালে। এরপর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে, এমন বিশ্বাস সাধারণ মানুষ রাখতে চায় না। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মঈন উদ্দিন আহমেদ। মূলত সেটা ছিল সেনা প্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অনেকেই সেই সরকারকে সেনা সমর্থিত বললেও আমার মতে সেটা ছিল সেনা প্রভাবিত। সমর্থিত ও প্রভাবিত শব্দ দু’টি আলাদা আলাদা অর্থ প্রকাশ করে। সেই সরকার ১২ জানুয়ারি ২০০৭ থেকে ৯ জানুয়ারি ২০০৯ খ্রি: পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এই সময়ে সেনাবাহিনী এবং ডিজিএফআই ছিল অবিরত তৎপর। তারা নির্বাচন বিলম্বিত করে। পরে এক/এগারো ফর্মূলা দিয়ে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে কারাগারে রাখা হলো। তারপর যা হয়েছে তার বিবরণ পাওয়া যায় ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইতে। বইটি লিখেছিলেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মঈন উ আহমেদ আশঙ্কা করেছিলেন শেখ হাসিনা মুক্ত হলে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। প্রণব মুখার্জি জেনারেল মঈন উ কে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে দায়িত্বও নিয়েছিলেন যে, শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে মঈন উ আহমেদ নিরাপদে থাকবেন। সেনা প্রধানের সাথে প্রণব মুখার্জির এসব সন্ধি হয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে; কিন্তু এসব জানা গেছে নির্বাচনের অনেক পরে। আড়ালে হয়েছে সবকিছু। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কল্পনাতীত ২৩০টি আসনে জয়ী হয়। বিএনপি পেয়েছিল ৩০ আসন। প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনার সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। ২৩০ আসনের সাথে এ সম্পর্কগুলো মিলিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল বলে বিএনপি অভিযোগ করেছিল। কিভাবে কারচুপি হয়েছে সেটা বিএনপি পরিষ্কার করে বলতে পারেনি। তবে মঈন উ আহমেদ জানত কিভাবে নির্বাচন ম্যাকানিজম করা হয়েছিল। নির্বাচনের পরে শর্তানুযায়ী মঈন উদ্দিন, ফখরুদ্দীন নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশে এই এক সুবিধা রয়েছে; জাতির সাথে, দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অবশেষে সসম্পদে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া যায়। এই সুবিধা আইন করে বন্ধ করা যেতে পারে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা থাকবেন তাদের অবসরে কিংবা অব্যাহতির পর দেশে থাকা নিশ্চিত করতে না পারলে এসব স্বভাবের মানুষ বারবার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেরাও ভাবতে পারেনি তারা এতগুলো আসনে জয়ী হতে পারে। তাহলে এমন হলো কেনো? হলো এ জন্য যে, ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের সুদৃষ্টি ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি। এ বিশ্বাস প্রণব মুখার্জির বই থেকেই কৌতূহলীদের মধ্যে জন্মাতে পারে। কেননা শেখ হাসিনার জেতা মানে মঈন উ আহমেদের বাঁচা। মঈন উ আহমেদ এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কাজেই সহজেই বোঝা যায়, এ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপরও সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণ বিশ্বাস রাখতে পেরেছিল।
মঈন উ আহমেদের হাত ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এতে বিএনপিসহ রাজনৈতিক অন্যান্য দলগুলোও প্রতিবাদ করে এবং সংবিধানে তা পুনস্থাপন করার দাবি করে। আওয়ামী লীগ শাসিত সরকার সে দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। বিনা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ১৫৩ আসনসহ একতরফা প্রহসনের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কটে আবর্তিত হতে থাকে। তবুও আওয়ামী লীগ তথাকথিত জঙ্গি সৃষ্টি ও জঙ্গি দমনের নাটক প্রদর্শন করে এবং উন্নয়নের স্লোগান ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রলম্বিত করার কৌশল খোঁজে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজনৈতিক অন্য দলগুলো মাঠে সরব থাকতে চাইলে মিথ্যা মামলা, পুলিশি হামলা ও গুমখুনের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমনে সরকার কঠোর নীতি অবলম্বন করতে থাকে। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে বিশ্বাস প্রত্যাহার করেছে, সেটা আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার বিকল্প খুঁজতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থেকেই বিএনপিসহ রাজনৈতিক অন্যান্য দলগুলো শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়তো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অধীনে হতে পারে। সেজন্য বিরোধীদলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কিছু শর্তারোপ করেছিল। সেসব শর্তের অন্যতম ছিল, নির্বাচন তদারকিতে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া। সরকার সে দাবি মেনে নিয়ে সেনাবাহিনী নিয়োগও করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেনাবাহিনী জনগণের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। নির্বাচনের আগের রাতে সিলমারা ব্যালট দিয়ে ভোটের বাক্স ভর্তি করা হলো এবং ভোটের দিন বেলা ১২টার মধ্যেই বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হলো। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। অভিযোগ ওঠেছিল, নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়েছে সে অনিয়মে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছিল, ক’দিন আগে ভূমিমন্ত্রীও সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পুলিশ কঠোর হলে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা কঠিন হতো। তিনি বলেন, আমি দেখেছি তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শেল্টার দেয়ার প্রবণতা বেশি। তিনি আরো বলেন, পুলিশকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ চিন্তা আছে। আপনাদের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি। আপনাদের সহযোগিতা আমরা সবসময় পেয়েছি, সামনের দিনে আরো সহযোগিতা চাই। মন্ত্রীর অবচেতন মনে স্বীকার করা এ বক্তব্যের তাৎপর্য নাই তা বলা যাবে না। মানুষও এমনটাই বিশ্বাস করে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় জনগণের সামনে প্রকাশ হয়েছে। গত নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা যে নিরপেক্ষ ছিল না সে কথাও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা বলাবলি করছে। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা অনুমান করা যাচ্ছে।
আগামী ২০২৩ সালের নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হবে সেটা নিশ্চিত করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে আরো ইভিএম কেনার প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে এবং সেনাবাহিনী ইভিএম ১৫০ আসনের টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের দায়িত্বেও থাকবে। দেখা যাচ্ছে গত নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি করা হয়েছিল কিন্তু সামনে নির্বাচনে বিনা দাবিতেই সেনাবাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিইসি। এখন কথা হচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মঈন উ আহমেদ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আজিজ আহমেদের যে তৎপরতা ছিল সে অভিজ্ঞতায় সামনে নির্বাচনে জনগণ কি বিশ্বাস রাখতে পারবে যে, আগামীর সেনাপ্রধান আগের উদাহরণ মনে রাখতে চাইবে না? সেটা না হলে নির্বাচন প্রহসনই হতে পারে। ২০২৩ সালের নির্বাচনের যে রোডম্যাপ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হতে পারে ২০১৪ সালের নির্বাচনের যে ১৫৩ আসন তার সাথে ২০২৩ সালে নির্বাচনে ইভিএম ১৫০ আসনের খুব মিল থাকতে পারে। দু’টিই বেশ কাছাকাছি সংখ্যার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা