০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১, ৫ শাবান ১৪৪৬
`

আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন

-

‘আধুনিক’ শব্দটি তুমুল উচ্চারিত! বহুল ব্যবহৃত। সুশীলসমাজে এর বেশ কদর। তারুণ্যের মুখে যখন তখন সমাদৃত। কথার সাথে আধুনিক। কাজের সাথে আধুনিক। চিন্তাচেতনায়ও আধুনিকতায় বাজিমাত। কৌশলের সাথে, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতিতে এবং উপস্থাপনেও আধুনিক শব্দটি ওতপ্রোত। কী আছে শব্দটির ভেতর! কেন শব্দটি এত এতভাবে উচ্চারিত।

কেন কথায় কথায় আধুনিক হবার গল্প ফাঁদতে হয়। আসলে শব্দটির মধ্যে একধরনের কেষ্ট কেষ্ট ভাব আছে। আছে খানিক সাবালকী গন্ধ। যোগ্য যোগ্য এক অনুভূতি। অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সময়ের সাথে সামঞ্জস্যের প্রবণতা। আধুনিক মানেই সমসাময়িক। সমকালে মানানসই। সমধারার পথিক। যুগান্তরের যাত্রী। এই অর্থে প্রতিটি মানুষই তার সময়ে আধুনিক। আগের মানুষের চেয়ে পরের মানুষ আধুনিক। গতকালের তুলনায় আজ আধুনিক। আজকের চেয়ে আগামীকাল আরো আধুনিক। সত্যি অর্থে আধুনিকতার চাকাটি সময়ের সাথেই ঘোরে। কখনো কখনো সময় থেকেও এগিয়ে গল্প হয়। একে বলে অতি আধুনিক। কিছুটা জৌলুশময় হলে বলা হয়- অত্যাধুনিক। এই আধুনিক, অতি আধুনিক এবং অত্যাধুনিক ছাপিয়ে কেউ কেউ মহা আধুনিকও উচ্চারণ করেন। সেরা আধুনিকও শোনা যায়। এতসব অভিধায় ঝলকিত শব্দটি এখন নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের জীবন।

তবে সব মানুষ কি আধুনিক? সবাই ধারণ করে কি আধুনিকতার উত্তাপ। আধুনিকতার উচ্চগ্রামে আরোহণের সিঁড়ি কি পায় সবাই! সবাই কি বোঝে কী করে মাখতে হয় আধুনিকতার রঙ! না সবাই মাখতে জানেন না। সবাই আধুনিক নন। কেউ কেউ থেকে যান আধুনিক স্রোতের বাইরে। সমকালে থেকেও তারা বসত করেন অতীতে। আজকের হয়েও তারা গতকালের। কেননা সময়ের পায়ে পা রেখে সবাই চলতে পারেন না। সময়ের চাকায় মেলাতে পারেন না জীবন চাকা! পারেন না এটিই সত্যি। যদি পারেন না তো তিনি কি আধুনিক? কিভাবে আধুনিক! সময় থেকে পিছিয়ে এরা। আজ এবং আগামীকাল আসে না এদের জীবনে। অবশ্য এ নিয়ে তেমন ভাবনাও নেই এই শ্রেণীটির।

বলছিলাম উষ্ণতার কথা। কেউ কাউকে যখন বলে-
আরে তুমি তো বেশ আধুনিক! তখন একধরনের উষ্ণতা তাকে চঞ্চল করে তোলে। এক ধরনের উদ্যম খেলে যায় তার ভেতর। অকস্মাৎ সিনা উঁচু হয়ে ওঠে। বুক টানটান করে দেহের ডানে বাঁয়ে চোখ ফেলে। নগদে একবার নিজেকে পরখ করার তীব্র বাসনা জেগে ওঠে। চকচক করে ওঠে দৃষ্টির উঠোন। তারপর হাসির রেখা দীর্ঘ হয়ে ওঠে। সুখ সুখ ঝিলিক ছড়ায় সারা মুখের অঙ্গনে। খুব প্রমাণ দিতে থাকে- সে যে আধুনিক!

এভাবেই আধুনিক শব্দটি উদ্যম ছড়িয়ে জাগ্রত করে মানুষের ভেতর জগৎ।

আধুনিক শব্দের ব্যবহারও বিভিন্ন আঙ্গিকে হয়- আরে তুমি তো এখনো আধুনিক হওনি। কাজটি আধুনিক হয়নি। এটি আধুনিকভাবে করতে হবে। ওকে আধুনিকতা বোঝাতে হবে। ও তো আধুনিকতা কী জিনিস জানেই না। এরা আধুনিক যুগের ছেলেপেলে। এর মধ্যে বেশি উচ্চারিত- এখন সবাই আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত!

হ্যাঁ, তাই তো! সবাই আধুনিক জীবনই বেছে নেন! জীবনযাপন পদ্ধতি শুধু আধুনিক নয়, সর্বাধুনিক হওয়া চাই। হচ্ছেও এবং খুব হচ্ছে। কিন্তু এই আধুনিক ঝকমকে আয়োজনে ব্যক্তিগত জীবন কেমন আছে!

আধুনিক জীবন মানেই গতির জীবন। আধুনিক জীবন মানেই ক্রমাগত ছোটার জীবন। আধুনিক জীবন মানেই নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে ওঠার জীবন। একই সঙ্গে আধুনিক জীবন কঠিন প্রতিযোগিতার জীবন। আধুনিক জীবন চ্যালেঞ্জের জীবন। কে কাকে পিছে ঠেলে যাবে। কিভাবে যাবে এবং কত দ্রুত যাবে এমনই তীব্রতার জীবন।

একটি ধাবমান ঘোড়ার কথাই ভাবা যাক। সে যদি কেবলই ছুটতে থাকে। ছুটতেই থাকে তো কে তাকে থামায়। যদি না-ই থামল, তাকে একান্তে পাওয়ার আশা কী করে করা যায়! এমন ধাবমান ঘোড়ার নামই আধুনিক জীবন।

আধুনিক জীবন এনেছে নগর সভ্যতা। কিংবা নগর সভ্যতা দিয়েছে আধুনিক জীবনের উন্মাদনা। ফলে পৃথিবীর মহানগরীগুলোর দিকে নজর দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার। মহানগর কেন যেকোনো নগরীর কথাই তোলা যায়। ইস! কী ভীষণ গতিতে ছুটছে মানুষ। কী বিস্ময় গতিতে ধেয়ে যাচ্ছে যে যার উদ্দেশ পানে। কেউ যাচ্ছে। কেউ আসছে। কারো যাত্রা। কারো ফিরতি। কারো খোলা। কারো বন্ধ। কেউ ধরে। কেউ ছাড়ে। ঘরের দরোজামুখী কেউ। কেউ দরোজা সেঁটে বাহির দিকে। এভাবেই আধুনিক জীবনের ছোটাছুটির বিস্ময়।

গাড়ির শীতল আয়েশে কেউ। কেউ ছোট যানের ধকলে। দু-পায়ে চলমান কেউ কেউ। কেউবা ধীর লয়ের কদমে।

কোথায় ছুটছে মানুষ! কেন ছুটছে! কেন এমন গতির ঘূর্ণিতে মানুষ! এর জবাব সবার জানা। এই গতির সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের পারিবারিক জীবন। অর্থনৈতিক জীবন। সামাজিক ও সাংগঠনিক জীবন।

আনুষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক জীবন। এসব কিছুর ভেতর গুলিয়েছে আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন।

পারিবার থেকে রাষ্ট্র অবধি সব আয়োজনে বেড়েছে জাঁকজমক। কিন্তু নির্মমভাবে অন্তঃসারশূন্য! সব আয়োজন লোক দেখানো। সব আয়োজনে বাইরের চেয়ে ভেতর বড় রহস্যময়! ভেতর থেকে বাহির বড় তুচ্ছ! কাজের শরীরে প্রতারণার জাল। প্রচারণা ছাড়িয়ে ওঠে প্রপাগান্ডার ঢেউ। ঘটনার চেয়ে রটনা বৃহৎ! বিশালত্বের শরীরে ক্ষুদ্রতার ছোপ! সম্পদ অর্জন নয় আত্মসাতে উদ্বুদ্ধ। সততা ঠেলে ক্ষমতার মত্ততায় নৃশংস। কোনো কিছুতেই নেই নেতিকতার ঘ্রাণ। মনের কথা মুখে নেই। মুখের কথাও নেই মনের কাছে। যা বলে তা করে না। যা করে তা বলে না। পৃথিবীজুড়ে আধুনিকতার নামে প্রতারিত মানুষ। রূপ যৌবন ভয়াবহভাবে পণ্য হয়ে উঠেছে। মানবীর লাবণ্য বিক্রি হয় খুব কম মূল্যে।

হ্যাঁ, আধুনিকতা মানুষকে বিশ্বগ্রাম দিয়েছে। যোগাযোগের দ্রুততা দিয়েছে। কম্পিউটারের মেমোরি দিয়েছে। চাঁদের ঠিকানা দিয়েছে। মঙ্গল গ্রহের সংবাদ দিয়েছে। দূরের পথকে কাছে এনেছে। পলকে খবর পৌঁছানোর আয়োজন করেছে। নিজের অঙ্গভঙ্গি মুহূর্তে প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছে। সমগ্রতাকে এনেছে হাতের মুঠোয়। একটি ক্ষুদ্র জানালায় বিশ্ব দেখার আয়োজন করে দিয়েছে।

কিন্তু আধুনিক জীবন খণ্ডিত জীবন। সীমাবদ্ধও। সীমিত করেছে জ্ঞানের রাজত্ব। নাম না তুলেও বলা যায়- একদা একজন ব্যক্তির ভাণ্ডারে ছিল জ্ঞানের চতুর্মুখী সম্মিলন। বিজ্ঞান জানতেন। ভূগোলও। চিকিৎসা থেকে আকাশ বিদ্যা। সাহিত্য থেকে ইতিহাস সবই ছিল একটি থলের ভেতর। এখন? শরীরের প্রতিটি অঙ্গের বিশেষজ্ঞ আছেন। কিন্তু এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গের এতই দূরত্ব যে প্রতিটি অঙ্গের জন্য আলাদা দক্ষতা দরকার। শিক্ষাবিদের গল্পও তেমনই।

নিজেকে নিয়েই ব্যস্ততা দিয়েছে আধুনিক জীবন। ব্যক্তি তো বটেই। নেতা কিংবা দায়িত্বশীল অথবা পরিচালক যে-ই হোন নিজের তৃষ্ণা নেভান আগে। নিজের পেট আগে ভরানোর কাহিনী বড় বিস্ময়ের! ছড়ি ঘোরাবেন, দায় নেবেন না! এমনই আধুনিক! এত সামষ্টিক জীবনের আয়োজন।

কিন্তু ব্যক্তিজীবন!

রূঢ় হলেও বিষয়টি দারুণ সত্যি- আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন বলে তেমন কোনো জানালা নেই। যে জানালায় উঁকি দিলে জীবনের সুখ দুঃখের মুখ দেখা যায়। আধুনিক জীবন কেড়ে নিয়েছে মানুষের শৈশব। ডাকাতি করেছে কৈশোর। লুট করেছে আবেগ।

একদা জীবন ছিল- ‘আমাদের’! এখন হয়ে গেছে- ‘আমার’। একদা ছিল- ‘আমরা’। এখন- ‘আমি’।

বড়দের সম্মান ছিল। ছোটদের ছিল স্নেহের পরশ। এখন সম্মান ক্ষমতা ও সম্পদের। বয়সী মানুষেরা অবজ্ঞার শিকার। ছোটরা বেড়ে ওঠে আদবহীন। জ্ঞানীরা মূল্যহীন। সর্বত্র অজ্ঞদের বাজার। এই যখন সমাজচিত্র! সেখানে কী করে সুস্থ থাকে ব্যক্তিগত জীবন।

ব্যক্তিগত জীবন এখন ভোগের তাণ্ডবে উদ্ভ্রান্ত! একাকিত্বের শূন্যতায় হতাশ! স্বার্থপরতার উৎকটে সংকীর্ণ! বস্তুর অঢেলতায় আবেগহীন! চিন্তার সীমাবদ্ধতায় অস্থির। আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নেই- এ সত্যটি উচ্চারণ করা এখন জরুরি।

আধুনিক জীবন মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। ক্রমাগত একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। এক ছাদের নিচে পাঁচজন। পাঁচজনের হাতে পাঁচটি মুঠোফোন। মোবাইল নামে খুব নাম ডাক তার। গোটা বিশ্ব থেকে ফিরিয়ে চোখ এখন ছোট্ট একটি মোবাইল স্ক্রিনে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একটানা দীর্ঘ সময়। ক্ষয়ে যায় দিন। পৃথিবীতে রাত নামে। অথচ ব্যক্তিজীবনে রাত বলে কিছু থাকছে না। জগতের রাত দীর্ঘ হয়। আধুনিক মানুষের চোখে ছোট হয়ে ওঠে রাত। চোখে ঝলসায় আলোর বোতাম! পাঁচ হাজার বন্ধু ও আছে কারো কারো! অথচ বেলা শেষে একাকিত্বের দহনে দগ্ধ! ফেসবুকে দহরম খুব। বাস্তবে ছেঁড়া সুতো। বিশাল বন্ধু! আদতে ভীষণ ক্ষুদ্র! দুর্ঘটনায় মুমূর্ষু মানুষ! সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে সেলফিতে মশগুল। আপন বোন কিংবা ভাই অথবা মা কিংবা বাবাকে কবরে রাখার সেলফি যখন প্রকাশ পায়! তাকে পৃথিবীর কোনো করুণ দৃশ্য স্পর্শ করবে কি! কারো দিকে কারো চোখ নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রা নেই। কারো প্রতি কারো মমতার নজর উজায় না। নিজেকে নিয়েই হুলুস্থূল! নিজেকে দেখানোর উৎসব! প্রদর্শনের বিস্ময় তামাশা! ছবির সেকি ভঙ্গি! নরম গরম মুহূর্তের চিহ্ন। খাওয়াদাওয়ার রকমারি। দামি পোশাকের শরীর! কালো চশমার চোখ! খ্যাতির পিপাসা আধুনিক মানুষের ভেতর জগৎকে গরিব করে তুলেছে।

ভেতর থেকেই ক্ষয়ে যাচ্ছে আধুনিক জীবন! সব কিছু পেতে চেয়ে দিয়ে দিচ্ছে নিজের সব! যা পায় তার কোনো ভার নেই। যা হারায় তা বড়ই ওজনদার! কী করবে আর কী করবে না! কেন করছে আর কেন করছে না! এর কোনোটিই যেন বিবেচনার নয়! ছোটার আছে, ছুটছে। পরার কাজ, পরছে! যাচ্ছে-আসছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে। উঠছে-বসছে। কেন? এর কোনো গাম্ভীর্যপূর্ণ জবাব নেই। সব কিছুতেই আনন্দ শিকার করার গুলিটি তাক করে রাখা। অথচ অর্থপূর্ণ জীবনের কোনো গন্ধে তারা নাক ডোবায় না।

আধুনিক শব্দের আরেক অর্থ সত্য আবিষ্কার। সত্যের দিকে থাকা। সত্যের সঙ্গ নেয়া। সত্যকে গ্রহণ করা এবং সত্য মান্য করা। সত্য মান্য করা জীবন- অর্থপূর্ণ। সত্য ধারণ করা জীবন- শঙ্কাহীন। তার বুকে থাকে আশার কল্লোল। তার হৃদয়ে থাকে প্রশান্তির আকাশ। সত্য যখন জীবনের বন্ধু হয়, সে জীবন সবসময় আধুনিক। তখন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন।

লেখক : কবি, উপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement