২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় জবাবদিহির প্রশ্ন

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় জবাবদিহির প্রশ্ন - প্রতীকী ছবি

তথ্য ও বিনোদন পরিবেশনে বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার বিকাশ লক্ষ করার মতো। তবে তথ্য ও বিনোদন দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে নীতি-নিষ্ঠতার পরীক্ষায় কিংবা নৈতিকতার চর্চায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে মিডিয়ার ভূমিকা। আকারে ও প্রকারে সাংবাদিকতা এগিয়েছে বটে, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নীতিগর্হিত নানামুখী কর্মকাণ্ডের সাথেও নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন। অথচ নীতি-নিষ্ঠতা সাংবাদিকের পেশাদারিত্বের অন্যতম দাবি। তাই সাংবাদিকতায় নৈতিকতার চর্চা ও ধরন নিয়ে আলাপ ও বিতর্ক একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে সাংবাদিকতায় নৈতিকতার বিষয়টি যতটা না প্রতিদিনের চর্চায়, এর চেয়েও বেশি সেমিনারকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিক আলোচনা আর বৈদেশিক অনুদাননির্ভর কর্মশালায় কেন্দ্রীভূত থাকে।

নৈতিকতার মানদণ্ডে সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা হয়। সাধারণভাবে একটি সমাজে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা যে নিয়ম-নীতি মেনে চলেন তাকেই সাংবাদিকতার নীতিমালা বলা হয়। তবে সাংবাদিকতার অন্তর্নিহিত নৈতিকতা আলোচনায় বলা হয়েছে, একজন সাংবাদিক প্রতিদিন তার কাজের মধ্যে তাৎক্ষণিক বর্তমান ও অতীতকে তুলে ধরেন। একই সাথে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের চিত্র দেন। মানুষের সম্মিলিত জীবনের বিকাশের প্রক্রিয়ায় এভাবে সাংবাদিক একটি মুখ্য ভূমিকা রাখেন। একজন সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সত্য উদঘাটন এবং জনগণের কাছে তা তুলে ধরা। সত্য প্রকাশে সংবাদকর্মীরা পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। যেকোনো গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সম্পদ বিশ্বাসযোগ্যতা। যে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা যত বেশি, দর্শক- শ্রোতা এবং পাঠকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি। তাই জনস্বার্থে, সংবাদমাধ্যমের স্বার্থে এমনকি নিজ স্বার্থেই সাংবাদিককে তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নৈতিকতার চর্চা করতে হয়। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা বা বিষয়কে নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার করে তারপরই তা প্রচার বা প্রকাশের জন্য বিবেচনা করেন তারা। নৈতিকতা হচ্ছে একগুচ্ছ ধারণা কিংবা আচরণবিধির মতো কিছু অঘোষিত নীতিমালা, যা সচেতন বা সংবেদনশীল জীব হিসেবে মানব আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সাংবাদিকরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নীতিসচেতন। এটি তাদের হতেই হয়। সব পেশার সব ধরনের মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেন যে সাংবাদিক তাকে নীতিসচেতন না হলে কি চলে? সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে প্রসারিত ক্ষেত্রটিই হচ্ছে নীতিসংশ্লিষ্ট। নীতিভ্রষ্টতা কিংবা কারো নীতিনিষ্ঠা বলতে গেলে সংবাদের প্রধান বিষয়। সুতরাং প্রখর নীতিজ্ঞানই একজন সাংবাদিকের পরশ পাথর, বেশির ভাগ সময় যার ছোঁয়ায় তিনি চিনে নেন কোনটি খবর, কোনটি খবর নয়। ভারতের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছায়াছবিতে চার তরুণ কলকাতা নগর থেকে বহুদূরে পালিয়ে জঙ্গলে গিয়ে সংবাদপত্র পুড়িয়ে ‘সভ্যতার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন’ করেছিল। সাংবাদিকতার নৈতিকতার এসব সঙ্কট সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু নৈতিকতার সঙ্কট দেখে এ ‘নাগরিক দিনরাত্রি’ সংবাদপত্র পোড়ানো সম্ভব নয়, বড়জোর শুদ্ধ করা যেতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকতার নৈতিকতার চর্চায় সাংঘর্ষিক নানা সংবাদপাঠকের মনোজগৎকে নাড়া দেয়। তারা সংবাদ দেখে-শুনে-পড়েন, উপকৃত হন, উৎকণ্ঠিত হন। আলোচ্য প্রবন্ধে এ ধরনের একাধিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, এ সঙ্কট কেবল বাংলাদেশের একার সঙ্কট নয়। যে বিশ্বগ্রামের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থিত, সেই বিশ্বগ্রামে আজ সাংবাদিকতার প্রযুক্তিগত বিকাশের সাথে সাথে নৈতিক পরাজয়ও ঘটছে কখনো কখনো। সাংবাদিকতার নৈতিকতার বৈশ্বিক এবং দেশীয় একাধিক সঙ্কট পর্যবেক্ষণে এটি সুস্পষ্ট যে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতায় অনৈতিক আচরণের পরিণতিস্বরূপ শাস্তি দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকলেও বাংলাদেশে তা প্রায় অনুপস্থিত।

প্রতিষ্ঠানের আদর্শগত অবস্থান, আর্থিক সক্ষমতা, সম্মানজনক বেতন কাঠামো সাংবাদিকের মর্যাদাবোধ তৈরির কাজকে সহায়তা করে। সে কাজের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানেরই। তবে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই পেশা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন-সংগঠনগুলোরও। অগণন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, অনেক সম্পাদক এবং অলিগলিতে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন গড়ে উঠলেও পেশাগত নিরাপত্তা, মানোন্নয়ন ও মর্যাদাবোধ গড়ে তোলা কতটা সম্ভব হয়েছে এ পেশায়? নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকতে হবে। সেখানে নৈতিকতার আদর্শ ঠিক হবে। কী লিখবেন, কী বলবেন না, কী উচিত, অনুচিত, আইনকানুন কী, কে সাংবাদিক হবেন, তার প্রশিক্ষণ কী, আইন কাঠামো তিনি মানবেন কি না, এসব বিবেচনায় নিতে হবে। আরেকটি দিক- ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কি না, ভালো বেতন দিচ্ছে কি না, যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে, সে প্রতিষ্ঠান এগুলো দেখাশোনা করছে কি না, অভিজ্ঞ সম্পাদকের নেতৃত্বে সম্পাদকীয় নীতি গড়ে উঠছে কি না। আর্থিক নিরাপত্তার সাথে পেশাগত মানোন্নয়ন ও মর্যাদাবোধ জড়িত। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘মফস্বল সাংবাদিকদের যদি একটি পরিচয়পত্র ধরিয়ে বলা হয়, এটা দিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা নিতে হবে। তাহলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এসব সমস্যা সরকার ও সাংবাদিক নেতাদের দেখা উচিত।’

দেশের সাংবাদিকতার সামগ্রিক মান বাড়াতে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এতে দেশের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব যেমন বাড়বে, তেমনি সংবাদপত্র শিল্প দেশের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যথাযথ প্রশিক্ষণই একজন সংবাদকর্মীকে যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলে। সাংবাদিকরা মানুষের কাছে দরকারি তথ্য পৌঁছে দেয়ার কাজটি করেন, তাই সব সাংবাদিকেরই দক্ষ, যোগ্য ও পেশার প্রতি আন্তরিক হওয়া উচিত। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ধরন গত দুই দশকে পাল্টেছে। রাজনীতিবিদদের হাত দিয়ে আদর্শিক অবস্থান থেকে যে সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল তার খুব কমই অবশিষ্ট রয়েছে। এখন ব্যবসায়িক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে। ফলে সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য ইতোমধ্যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আদর্শিক সাংবাদিকতার পরিবর্তে হাজির হয়েছে পেশাদারি সাংবাদিকতা। দেশে এখন মুদ্রণ, সম্প্রচার, অনলাইন- নানামুখী সাংবাদিকতার বিস্তার ঘটেছে। তবে ক্রমবর্ধমান গণমাধ্যম শিল্পের এখন একটা গুরুতর সমস্যা হলো পেশাদার ও দক্ষ সাংবাদিকের সঙ্কট। একসময় সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন কেউ অনুভব করতেন না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা শিল্পে পরিণত হয়েছে, মুদ্রণের পাশাপাশি বেতার ও টেলিভিশনে এবং অনলাইনে সাংবাদিকতার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। এসব নতুন ধরনের সাংবাদিকতায় কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান দরকার; যা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেই অর্জন করা সম্ভব। এ ছাড়া রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রতিনিধিরা, যাদের জন্য প্রশিক্ষণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। সংবাদ লেখার কলাকৌশল ছাড়াও সাংবাদিকতার রয়েছে একটি নৈতিক দিক যা তাত্ত্বিকভাবে অধ্যয়ন করা জরুরি।
সংবাদ ন্যায়পালের কার্যক্রম ও কার্যপরিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে একটি নীতিমালা প্রণীত হওয়া প্রয়োজন।

যদিও প্রতিটি সংবাদপত্র কতিপয় নীতিমালার আলোকে পরিচালিত ও পরিবেশিত হয়ে থাকে। কিন্তু দেশে বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের লিখিতভাবে নীতিমালা প্রণীত হয়নি। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের ইতঃপূর্বে ২১ ধারা সংবলিত একটি নীতিমালা নিয়ে সাংবাদিক মহল সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা বলেছিলেন, নীতিমালা প্রণয়নে তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের সময়ের সংবাদ ন্যায়পালের কার্যক্রমকে ফলপ্রসূভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি নীতিমালার খসড়া নিয়ে ইন-হাউজ সাংবাদিকদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার দেশী-বিদেশী শিক্ষকদের সাথে এ বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়। এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সাংবাদিকতার এ নীতিমালা না মেনে কোনো সংবাদ পরিবেশিত হলে তার ব্যাপারে পেশাগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ পেশাগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে যথার্থভাবে নেয়া হয় না; অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়। নীতিমালা না মানার কারণে প্রকাশিত সংবাদের পরিণতিতে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ করতে পারেন; প্রতিকার চাইতে পারেন। প্রতিকার বিধানে সংবাদন্যায়পাল সচেষ্ট থাকবেন। সংবাদ ন্যায়পালের কার্যালয় এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যাবশ্যক। খবর সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিবেদন তৈরি, সংবাদ পরিবেশন, ট্রিটমেন্ট, প্রকাশের জন্য ছবি বাছাই, শব্দ চয়ন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংবাদকর্মীদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিতে হয়। সামাজিক দায়িত্বশীলতার তত্ত্বে বলা হয়, গণমাধ্যম স্বাধীন হবে, কিন্তু সেটি হবে সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতা। সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমালোচনার অধিকার থাকবে গণমাধ্যমের। তবে একই সাথে জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদান এবং সমাজের চাহিদা ও স্বার্থকে লালনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার দায়িত্বও গণমাধ্যমের। সমাজের প্রয়োজনীয়তার প্রতি বাধ্যবাধকতা রয়েছে গণমাধ্যমের। তা যথাযথভাবে পালনের মধ্য দিয়ে সমাজকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে হবে।

রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিকল্প নেই। গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। সুতরাং সাংবাদিকতার মান ও নৈতিকতা বাড়াতে ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতার উৎকর্ষতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিডিয়া প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনকে অগ্রাধিকার প্রদানপূর্বক সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমকে আধুনিকতার নীতিমালায় সংযোজনপূর্বক এ খাতকে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করতে হবে। সর্বোপরি সংবাদমাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের প্রবাহ নির্বিঘœ ও স্বতঃস্ফূর্ত করতে হবে।

লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কলামিস্ট ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement