২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ও এমপিদের মর্যাদা

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতিটা খুব বেশি ঘোলাটে হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ায় রাজনীতিটাকেও আমলারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। বর্তমানে প্রশাসনিক বা পুলিশের কথাবার্তা ও আচার আচরণে বোঝা যায় না, সরকার আমলা-পুলিশ মিলে চালাচ্ছে নাকি মন্ত্রী-এমপিরা? সংসদে এমপিদের আহাজারি দেখে মনে হয় পুরো রাজনীতিটাই এখন আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। ইদানীংকালে আবার পুলিশ কমিশনারও রাজনৈতিক কায়দায় বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের নানা ছবক দেয়ার চেষ্টা করছেন। বক্তৃতা বিবৃতিতে মনে হয়, তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী নন।

রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের প্রভাব কতটা হলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদকেও সংসদে উষ্মা প্রকাশ করে বলতে শোনা যায়, আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা ম্লান’ হয়ে যাচ্ছেন। আগে যেখানে জেলার উন্নয়ন তদারকির জন্য জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রীদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত এখন জেলায় জেলায় মন্ত্রীদের পরিবর্তে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। তোফায়েল আহমেদ আক্ষেপের সুরে বলেন, রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের খবরদারির কারণে একটি রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়। আগে মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসত। মন্ত্রীরা গ্রামেগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সে দিনগুলো হারিয়ে গেছে।

জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদও একই সুরে বলেন, ‘আজকে দেশে কোনো রাজনীতি নেই। তোফায়েল আহমেদ যথার্থ বলেছেন। দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতি শূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই। প্রত্যেকটা জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সচিবদের। ‘প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সাথে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। তার পর বলে ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সাথে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎশেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছে রাজনীতিবিদরা।’

তোফায়েল আহমেদ আরো বলেন, ‘এমপিদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, দ্য এমপিস আর এবাভ দ্য সেমিট্রিস। এ জিনিসটা খেয়াল করতে হবে।’ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এমপিরা পদমর্যাদার ক্রমধারার ১৩ নম্বর, সিনিয়র সচিবরা ১৫ ও সচিবরা ১৬ নম্বর প্রটোকল পেয়ে থাকেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স হলো একটি প্রটোকল তালিকা বা রাষ্ট্রের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদগুলোর ক্রমবিন্যাস। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কে কোথায় বসবেন তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে গেলে প্রটোকল দেয়া হয়; তখন কে কোথায় দাঁড়াবেন তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আলোকে ঠিক করা হয়।

অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তিদের মন্ত্রী, এমপি বানালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার পরোক্ষভাবে আমলাদের ওপরই বর্তায়। তারাও সুযোগ বুঝে কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমলাদের প্রভাব নতুন কিছু নয় তবে এর মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে একটি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার ভারও আমলাদের ওপরই ছিল। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বলেছিলেন, ‘...নির্বাচনের সময় আমি তো প্রতিটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সাথে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ (ডয়চে ভেলে, ১৫. নভেম্বর ২০১৪)। এ ধরনের নির্বাচন করে যখন কেউ এমপি, মন্ত্রী হন তাদের কেন আমলারা মর্যাদা দিতে যাবে?

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তোফায়েল আহমেদ ও কাজী ফিরোজ রশিদ সাহেবও তো ওই আমলাদের সহযোগিতায় নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসেছেন। এখন কেন নিজেদের মর্যাদা নিয়ে এত আক্ষেপ?

ডিসি, এসপি দূরে থাক, থানার একজন ওসিও কোন এমপি-মন্ত্রীকে পাত্তা দিতে চায় না। কারণ ওসি জানেন তার কারণেই আজকে উনি এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জনগণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে থাকে। আমলাদের নয়। একটি প্রতিযোগিতামূলক ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত না হয়ে শুধু প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচিত হওয়ায় সরকারপ্রধানও জনপ্রতিনিধিদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই আমলাদের দায়িত্ব দিচ্ছেন। আর এই সরকার টিকেও আছে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। তাই আমলাদের গুরুত্ব এত বেশি।

সংবিধান অনুসারে দেশের ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। সংবিধান অনুসারে তাদের সুনির্দিষ্ট কাজও থাকে। তবে সরকারি কর্মকর্তা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উভয়েই রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এমপিদের দায়িত্ব আইন তৈরি করা। তবে তারা রাষ্ট্রের সঠিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রশাসনিক কাজে অযথা হস্তক্ষেপ না করে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে পারেন। কারণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং নিয়োগকৃত সরকারি কর্মকর্তা উভয়েরই সরকার পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট ভ‚মিকা রয়েছে। তবে বর্তমান সরকার প্রশাসনিক আমলা এবং পুলিশের ওপর নির্ভর করে একটি অস্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকায় এমপি কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা পুলিশ প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

জনমতের প্রতিফলন না হওয়ার সুযোগে টাকার বিনিময়ে প্রশাসন এবং পুলিশকে ব্যবহার করে অনেক সুবিধাবাদী অযোগ্য, অরাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক শ্রেণীর ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়ায় ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাজনীতির শক্তির জায়গাটা লুপ্ত হতে চলেছে। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশে এই শ্রেণীর লোকেরা বেশি মাত্রায় নির্বাচিত হওয়ায় তারা ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজনীতিকে ব্যবহার করতে গিয়ে অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাবে সরকারি কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই ২০১৪ সালের পর থেকে সরকারি কর্মচারীরা রাজনীতিবিদদের যথোপযুক্ত সমীহ করে না। আসল কথা হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারছে না বিধায় অরাজনৈতিক এবং অদক্ষরা রাজনীতিবিদদের জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে। ফলে রাজনীতি এখন দেউলিয়া হয়ে পড়ছে যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে ‘আমলাতন্ত্র’ কোনো দলের না। এটা হলো রাষ্ট্রের। তারা নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের কাছে প্রতিশ্রæতি দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে আসেন। কাজেই জনগণের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পলিসি ঠিক করবে রাজনীতিবিদরা, বাস্তবায়ন করবে আমলারা।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি, সৎ, দক্ষ ও ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় পরিচালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে রাজনীতিবিদরা তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন এবং আমলারাও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মেনে তাদেরকে সমীহ করতে বাধ্য থাকবে।

আমাদের রাজনীতি কতটা দেউলিয়া তা বোঝা যায় যখন একজন পুলিশ কমিশনার একজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করে কথা বলতে পারে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা নাকি সত্য কথাও বলতে পারে না। তাই কিভাবে সত্য বলতে হয় তিনি তা শিক্ষা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ভায়োলেট করে একজন সরকারি কর্মকর্তা কি কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলতে পারে? এ ধরনের শিষ্টাচারবহিভর্‚ত, চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার জন্য কি ওই পুলিশ কমিশনারকে জবাবদিহি করতে হয়েছে? না, হয়নি! কার কাছে জবাবদিহি করবে? পুলিশ-আমলারা বুঝে গেছে, রাজনৈতিক নেতাদের জনসমর্থন নেই। থাকলে তো আর পুলিশ-আমলা দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হতো না। তাদের সহজবোধ্য ধারণা হলো, এমপি, মন্ত্রি তো তারাই ভোট কেটে বানিয়েছে, কাজেই নেতার দাপুটে নেতাগিরি তো পুলিশ-আমলাদের কাছে খাটবে না। তাই এমপি-মন্ত্রীদের বলতে চাই, জনগণের ভোটের পরিবর্তে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, পুলিশ-আনসারসহ আরো নানা জাতের আমলাদের সাহায্যে যদি আপনারা ক্ষমতায় থাকতে চান তাহলে তারা কেন আপনাকে স্যার স্যার বলে লুটে পড়বে?

সহজ কথা হচ্ছে, পিতার ওপর পুত্রের কর্তৃত্ব যেমন খাটে না তেমনি যে আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার ওপরও আপনার কর্তৃত্ব টিকবে না। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী কর্তৃত্ব করতে হলে জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এলেই কারো দ্বারা সম্মানহানির সম্ভাবনা থাকবে না। সম্মান যায় যায় বলেও সংসদে চিৎকার করে কাঁদতে হবে না।
harun_980@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement