২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কী পরিকল্পনায় ছিল পাকিস্তান

-

বিস্বাদের সমাপ্তি
ক) ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমেরিকার রাষ্ট্রদূত রাওয়ালপিন্ডি থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রসঙ্গে পাকিস্তানি জনমতের প্রেরিত রিপোর্টে বলেছেন যে, ‘One hears talk of possible secession by East Pakistan but the Pathans... getting rid of the troublesome Bengali.’ (পূর্ব- পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতার কথা শোনা গেলেও সেটি পাকিস্তানের জন্য কোনো দুঃখজনক আঘাত বলে পাঠানরা সার্বজনীনভাবে মনে করে না। বিরক্তিকর বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় এমনকি অনেকে আনন্দিত)। (তথ্য-পূর্বোল্লিখিত The American Papers, 1965-1973, p-309)

খ) বইটির ৩৮২ পৃষ্ঠা মতে, ১৯৭০ সালের ১ জুন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এক সম্মেলনে খান আবদুল কাইউম খান আফগানিস্তান ও ইরানের সাথে পাকিস্তানের কনফেডারেশন করার পক্ষে বক্তব্য দেন। ফলে শেখ মুজিব একে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। দৃশ্যত তার বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি-উত্তরে কাইউম খান বলেন, ‘আমরা সর্বক্ষেত্রেই পরস্পরকে অধিকতর সহযোগিতা করতে পারি।’

গ) নিউ ইয়র্কের The Capital Express পত্রিকার সম্পাদক বি. জেড খসরুর ‘Myths and Facts, Bangladesh Liberation War’ বইটির ৫৯ পৃষ্ঠায় : আসন্ন নির্বাচন ও পূর্ব পাকিস্তান প্রসঙ্গে বেলুচিস্তানের গভর্নর গাউস বকশ বিজেনজোর এক প্রশ্নোত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘Sooner or later East Pakistan will have to be amputed. And, if at all that is to happen, why let them suck our blood for two or three more years?’ (আজ হোক বা কাল, পূর্ব পাকিস্তানকে কর্তন করতেই হবে। যদি তাই হয় তবে আরো দুই বা তিন বছর কেন তাদেরকে আমাদের রক্ত চুষতে দেবো?)

ঘ) Richard Sission and Leo E. Rose লিখিত War and Secession, Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh বই-এর ১৫০-১৫১ পৃষ্ঠার তথ্য মতে, ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে কোনোভাবেই ভারতকে না জড়ানোর প্রকাশ্য পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রবীণ নেতা রাজা গোপালাচারী, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম. করুণানিধি এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল কারিয়াপ্পা। ভারতীয় কিছু কর্মকর্তারও মতামত ছিল, ‘Indian interests were better served by an East Pakistan that was, in fact, ‘captive’ to India, and thus a complication to decision making in Islamabad, than they would be by a seeond large Islamic state in the subcontinent.’ (উপমহাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার চেয়ে ভারতীয় স্বার্থ বেশি রক্ষিত হতো পূর্ব পাকিস্তানে, যা বস্তুত বন্দিরূপে ভারতে আবদ্ধ থাকার জন্য ইসলামাবাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হতো)

ঙ) ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত সেনা অগ্রসর করানোয় ইংল্যান্ডের ডেইলি মিরর পত্রিকায় জন পিলজার ভারতকে প্রথম আক্রমণকারী বলে অভিহিত করেন। প্রতি-উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ÔIf any country thinks that calling us aggressor it can press us to forget our national interest, then that eountry is living in its own fool’s paradise.’ (যদি কোনো দেশ আমাদেরকে প্রথম আক্রমণকারী বলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভুলাতে চাপ দিয়ে থাকে, তবে সে দেশ তারই বোকার স্বর্গে বাস করছে)। (পূর্বোল্লিখিত Bangladesh Documents, v-2, p-224))

চ) রাশিয়া ঐ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও, পাকিস্তানের পরাজয়ের অবস্থায় ১২-১৪ ডিসেম্বর আফগান বাদশাহ জহির শাহ অনিমন্ত্রিতভাবে মস্কো গিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত করার অনুরোধ করলে রাশিয়া অসম্মতি জানায়। অবশ্য এর কারণ তার গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়ের অপেক্ষা। অর্থাৎ এর মাত্র সাত বছর পরেই ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরানের শাহানশার দেশ ত্যাগ এবং ২৭ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু।

ছ) ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর মোটামুটি একটি আপস-রফার রাশিয়ান সমর্থিত প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ড কর্তৃক উত্থাপিত হলে ভুট্টো এর অনুলিপি ছিঁড়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় কক্ষ থেকে দ্রুত বের হয়ে যান। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় পরের দিন ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে সেনারা আত্মসমর্পণ করেন। (তথ্যে বলা হয়, ৩৪ হাজার নিয়মিত সেনা+১১ হাজার মিলিশিয়া ও বেসামরিক পুলিশ। শিশু ও মহিলাসহ বেসামরিক নাগরিক আরো ৪৭ হাজারসহ মোট সংখ্যা ৯২ হাজার)

জ) অবশ্য এদেরকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিতে পারার মতো ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছিল। পাকিস্তানের অতি গোপন সহযোগিতা ও মধ্যস্থতায় চীন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই পাকিস্তান থেকে চীনে গিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। ২৫ অক্টোবর জাতিসঙ্ঘ থেকে তাইওয়ানকে বহিষ্কার করিয়ে তার সদস্য পদ দেয়া হয় চীনকে, যার সময়মতো বারংবারের ভেটোতে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার আলোচিত হয় ও জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি আটকে যায়। অবশেষে ভারতের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদান এবং ভারতের জিম্মায় বন্দী থাকা ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ সব সৈন্য প্রত্যাবর্তনে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু, বাংলাদেশকে তার ন্যায্য ভাগ না দেয়ার উছিলাগত যুদ্ধে যেন চিরস্থায়ী দায়মুক্তি নিয়ে গেল পাকিস্তান।

ঝ) অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘A Legacy of Blood’ বই-এর ৮৭ পৃষ্ঠা মতে, ১৯৭৫-এর শেষদিকে খন্দকার মোশতাক আহমদের ক্ষমতা গ্রহণের পরে পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বা এমনকি পুনঃএকত্রীকরণে অনেকের প্রচেষ্টায় ভুট্টোর ছিল আপত্তি। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহামদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক বা আরো একটু বেশি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতি উৎসাহী কিছু লোক আছে যারা বেশি কিছু চায়; কিন্তু তাদেরকে উৎসাহিত করছি না, বরং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’

ঞ) সম্ভবত, সালটি ১৯৮০ বা ’৮১। বাংলাদেশের সাথে উন্নত সম্পর্ক স্থাপনে করাচিতে একটা প্রবল জনমত প্রকাশ পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশের প্রভাবশালী দৈনিক জং পত্রিকায় জনৈক রাশেদি অথবা কোরেইশি নামীয় এক রাজনৈতিক নেতার কলাম প্রকাশিত হয়। ওই দিনই প্রবাসে এক সহকর্মী আমাকে সেটি পড়ে শোনান। এটাতে লেখকের সার কথাটি ছিল, ‘আইউব খান পূর্ব পাকিস্তানকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই যা হওয়ার, সেটিই হয়েছে; আবার কী?’ ‘আসসালামু আলাইকুম, খোদা হাফেজ’ বলে লেখায় ইতি টানা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement