১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১, ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জাকাত : মানবিক সমাজ গড়ার হাতিয়ার

- ছবি : সংগৃহীত

নামাজ-রোজার মতোই জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। জাকাত হচ্ছে অর্থের ইবাদত। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। আর্থিক সচ্ছলতার কোন অবস্থায় জাকাত আদায় করতে হবে সেটি ইসলাম স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। কী পরিমাণ জাকাত একজন মানুষকে আদায় করতে হবে, সেটিও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। জাকাতের পরিমাণ হিসাবের ফর্মুলা এবং জাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে সেটিও নির্ধারণ করা আছে।

জাকাত একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ পবিত্রতা, প্রাচুর্য, ক্রমবৃদ্ধি এবং প্রশংসা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায়, জাকাত হলো সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যা নিঃস্বার্থভাবে কোনো অসহায় মুসলমানকে দান করা হয়। জাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যবিমোচনের মূল হাতিয়ার। জাকাত হলো একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলার হাতিয়ার। মানবকল্যাণই জাকাতের মূলমন্ত্র। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই জাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যার সমাধান হয়। জাকাত হলো ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তিটি বাধ্য। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে সালাত আদায়ের সাথে সাথে জাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনে মোট ৩২ বার জাকাত আদায়ের নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ এককভাবে সাতবার আর সালাতের সাথে ২৫ বার জাকাত আদায়ের কথা বলেছেন।

ঈমান আনার পর ইসলামের বিধিবিধান পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ ও পালন করতে হবে। আপনি কিছু বিধান পালন করলেন আর কিছু বিধান পালন করলেন না- এমন সুযোগ ইসলামে নেই। স্বাভাবিকভাবেই নামাজ আদায়ের মতো জাকাতও আদায় করতে হবে। জাকাত আদায়ের পর সেই অর্থ ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত খাতগুলোতে ব্যয় করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত জাকাত আদায় সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত দেখে নেয়া যেতে পারে : ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।’ (বাকারা-৪৩) ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ।’ (মুজাম্মিল-২০) ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর।’ (মুজাদালাহ-১৩)। যারা জাকাত দেয় না তাদের সম্পর্কে বলেছেন : ‘যারা জাকাত দেয় না, তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী কাফির।’ (হা-মীম সাজদা-৭)। এই কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা সহজেই জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুসলমানরা জাকাতের গুরুত্ব এখনো ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি অথবা বোঝার চেষ্টা করেনি। এ কথাটি সত্য বলেই মুসলমান সমাজে সঠিকভাবে এখনো জাকাত আদায় হয় না এবং আদায়কৃত জাকাত সঠিকভাবে ব্যয়ও হয় না।

মনে রাখতে হবে জাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। এটা বঞ্চিতদের প্রতি ধনীদের কোনো করুণা বা অনুগ্রহ নয়। আবার এটা দানও নয়। এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবদের এমনই একটা অধিকার, যেটা ধনী ব্যক্তিরা প্রতি বছর গরিবদের দিতে বাধ্য এবং সেটা গরিবদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটাও ধনীদের দায়িত্ব।

জাকাত প্রদান আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন যাতে এর মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করবে, অন্য দিকে এই অর্থ দিয়ে সমাজ থেকে দারিদ্র্য এবং সমস্যা দূর হবে। এভাবে জাকাত সিস্টেমের মাধ্যমে ইসলাম সার্বজনীন এবং কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমেই কেবল একটি আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।

অর্থের প্রতি মানুষের লোভ আদিকাল থেকেই চলে আসছে। মানুষ সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করতে চায় না। তাই অনেকে ঠিকভাবে জাকাত আদায় করে না। অনেকে মনে করে জাকাত আদায় করলে সম্পদ কমে যাবে; কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা ঠিক উল্টো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, জাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে জাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত হয়।’ (রূম-৩৯)।

একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন একজন মানুষ সুদ খায় সম্পদ বাড়ানোর জন্য; কিন্তু বাস্তবে সুদখোরের সম্পদ বাড়ে না। কারণ সুদ ব্যবস্থায় গরিবের টাকা ধনীর হাতে চলে আসে বটে; কিন্তু যারা সুদ দেয় তাদের হাতে টাকা থাকে না। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতাও থাকে না। এ অবস্থায় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় এবং সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। অন্য দিকে জাকাত আদায়ের ফলে ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের হাতে যায়। ফলে গরিবদের হাতে টাকা থাকে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সমাজে দরিদ্রের সংখ্যা কমে এবং সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমে। সমাজে সাম্য সৃষ্টি হয়। এভাবে জাকাত ব্যবস্থার কল্যাণে সমাজ উন্নত হয়।

সুদ গ্রহণকারীরা আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে। আর জাকাত প্রদানের ফলে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। আর জাকাত প্রদানের ফলে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল- উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে। জাকাতের অর্থ যেনতেন খাতে ব্যয় করার সুযোগ নেই। কারণ জাকাত প্রদানের আটটি খাত আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সদাকা হচ্ছে (জাকাত পাবে আট প্রকার লোক) ১. ফকির, ২. মিসকিন, ৩. ওই সব লোক যারা সদাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত, ৪. ওই সব কাফির, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, ৫. দাস মুক্ত করা, ৬. ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা, ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী এবং ৮. মুসাফিরদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। সুতরাং জাকাতের অর্থ এসব খাতেই ব্যয় করতে হবে।

হিসাব করে যত টাকা জাকাত নির্ধারিত হয় তার পুরোটাই দিয়ে দেয়া বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে আংশিক জাকাত আদায়ের সুযোগ নেই।

আসুন সবাই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে নির্ধারিত হারে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি। সেই সাথে সমাজ থেকে দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ভ‚মিকা রাখি। যে কেউ নিজের জাকাতের অর্থ দিয়ে একটি জাকাত ফান্ড গঠন করতে পারেন। সেই ফান্ড থেকে জাকাতের টাকা সমাজের অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধানে ব্যয় করতে পারেন। প্রতিটি ধনাঢ্য পরিবারের কর্তারা যদি জাকাতের টাকা দিয়ে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নেন তাহলে সমাজ খুব সহজেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। একইভাবে দেশের প্রতিটি ব্যবসায়ী এবং শিল্প গ্রুপ যদি তাদের তত্ত্বাবধানে একটি জাকাত ফান্ড পরিচালনা করে এবং সেই জাকাত ফান্ডের টাকা দিয়ে সমাজের অসহায়-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজ আপনা-আপনিই উন্নত হয়ে যায়।

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবকল্যাণই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলাম তার যাবতীয় কর্মই মানবকল্যাণের সাথে সংযুক্ত করেছে। জাকাত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জাকাতের মাধ্যমে গরিবের প্রতি ধনীদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজে সাম্য, সম্প্রীতি এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাকাতের অর্থ সারা বছর ধরেই বিতরণ করা যেতে পারে। তবে ঈদুল ফিতরের আগেই বছরের সব জাকাত পরিশোধ করা উচিত।

আপনার ওপর নির্ধারিত সম্ভাব্য পরিমাণ জাকাতের টাকা থেকে অসহায় মানুষের কল্যাণে বছরজুড়েই অর্থ ব্যয় করুন এবং জাকাতের চূড়ান্ত হিসাব শেষে বাকি টাকা ঈদুল ফিতরের আগেই পরিশোধ করুন। তাহলে সব বঞ্চিত, অসহায় এবং গরিব মানুষের মুখে ঈদের হাসি ফুটবে এবং তাদের ঘর ঈদের খুশিতে আলোকিত হবে। আর এটাই মানবজীনের সার্থকতা এবং সৌন্দর্য। মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও কিন্তু জাকাতের সিস্টেমে গরিবদের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। কারণ এই অর্থ তো মানবকল্যাণেই ব্যয় হবে। আসুন এর মাধ্যমে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং অভাব দূর করি আর মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করি।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।
ই-মেইল: omar_ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement