নতুন বিপর্যয় সিংকহোল
- শাহরীন তাবাসসুম
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৩১
আমরা প্রাত্যহিক জীবনে বন্যা, সাইক্লোন, খরা, ভূমিকম্প, লবণাক্ততাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে পরিচিত। এ রকমই নতুন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম হচ্ছে সিংকহোল যা তুরস্ক, ইসরাইল এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে।
কোনো একটি স্থানের ভূমি হঠাৎ অথবা ধাপে ধাপে ধসে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া গর্তকে সিংকহোল বলা হয়। ভূগর্ভে থাকা পানি বা শিলা অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে তৈরি হয় সিংকহোল। এগুলো সাধারণত কয়েক ফুট থেকে কয়েক শ’ একর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে যার গভীরতা এক থেকে ২০০০ ফুট পর্যন্ত হয়। এগুলো দেখতে অনেকটা অগভীর বাটি বা বোলের মতো হয়। কিছু সিংকহোলে পানি জমে আবার প্রাকৃতিকভাবেই পুকুর বা ডোবা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবেই তৈরি হচ্ছে সিংকহোলগুলো। বিশ্বের অনেক দেশেই এই হোল বা গর্তগুলো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে আবার ৩০০টিরও বেশি সিংকহোল তৈরি হতে দেখা গেছে। একটি সিংকহোল তৈরি হতে কয়েক দশক এমনকি শতাব্দী পর্যন্ত সময় লাগে। সম্প্রতি এর হার বহু বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিংকহোলের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে ভূগর্ভের পানি ও খনিজের অতিরিক্ত উত্তোলনকেই প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণত দু’টি প্রক্রিয়ায় সিংকহোল হয়ে থাকে (১) বিভিন্ন আকরিক শিলার রাসায়নিক ভাঙন থেকে এবং (২) সাফোসন প্রসেস যেখানে পানি কিংবা অন্য কোনো তরল পদার্থের কারণে ভূগর্ভের মাটি বা শিলা ক্ষয় হয়ে সরে যায়। বৃষ্টির সময় মাটির উপরিতলের পানি ফিল্টার হয়ে মাটির সাবসারফেসে জমা থাকে যাকে আমরা অ্যাকুইফার বলি। এই অ্যাকুইফারে জমাকৃত পানি আমরা বিভিন্ন কাজের জন্য যেমন সেচকাজ, পান করা, গৃহস্থালির কাজ ইত্যাদির জন্য মেশিনের সাহায্যে উত্তোলন করে থাকি। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করে অপচয় করি। অতিরিক্ত এই উত্তোলনের ফলে ভূমিতে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়ে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়। তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়।
ভূতত্ত্ববিদরা বলেছেন, শুধু পানি উত্তোলনের জন্যই নয়, মাটির অভ্যন্তরের কঠিন শিলা উত্তোলনের ফলেও বাড়ছে সিংকহোলের সংখ্যা। যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে সেখানে এসব উত্তোলনের হারও বেশি। সেখানে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজ স্তর থাকে। এই খনিজ পদার্থগুলো অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়ে থাকে। এরপর সেই এলাকার মাটির উপরিতল নিজের ভারেই ধসে গিয়ে তৈরি করে সিংকহোল। এ ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, তীব্র খরা, মাটি ক্ষয়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মিথেন গ্যাসের প্রভাব ইত্যাদি অনেক কারণে সিংকহোল তৈরি হয়ে থাকে। শহরে সিংকহোল বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত ভূগর্ভের সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচের নির্মাণ কাজকে ধরে নেয়া হচ্ছে। সিংকহোলকে ভূমিধস বা ল্যান্ডস্লাইড মনে করা হলেও দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাকৃতিক রূপ।
এক মাসের মধ্যে পাঁচটি দেশে এমন বহু গর্ত তৈরি হওয়ায় ভূতত্ত্ববিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি সিংকহোল নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক। ২০২০ সালে সেখানে সিংকহোলের সংখ্যা ছিল ৩৬০, বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬০০তে উন্নীত হয়েছে। এর জন্য দেশটির পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালাকে দায়ী করা হচ্ছে। ১০-১৫ বছরের খরাজনিত কারণে গমের আবাদের জন্য সেচের পানি হিসেবে ভূগর্ভের পানির উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে কৃষকদের। পূর্বে যেখানে বছরে দু’বার সেচ দিতে হতো খরার কারণে এখন বছরে পাঁচ থেকে ছয়বার সেচ দিতে হচ্ছে। কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে তৈরি হচ্ছে দানবাকার গর্তগুলো। এ অবস্থা বিরাজমান থাকলে অসংখ্য সিংকহোলে তুরস্কে বড় ধরনের দুর্যোগ ঘটাতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সিংকহোল মিসরের কায়রোতে অবস্থিত, যা ১৩৩ মিটার গভীর, ৮০ কিমি লম্বা এবং ১২০ কিমি প্রশস্ত। চিলিতে অবস্থিত ২৭৯০ ফুট গভীর সিংকহোল চুকুইচামাতা সৃষ্টি হয়েছিল ১৯১০ সালে। চীনের চংকিংয়ে অবস্থিত জিয়াওজাই তিয়ানকেং নামক সিংকহোলটি ৬৬২ মিটার গভীর ও ৬২৬ মিটার প্রশস্ত। সাইবেরিয়াতে রয়েছে ১ কিমি জায়গাজুড়ে অবস্থান নেয়া সিংকহোল। এক ভূমিকম্পের পর ক্রোয়েশিয়ায় এক শ’র বেশি সিংকহোল তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও ইতালি, মেক্সিকো, ইসরাইল এমনকি ভারতেও তৈরি হয়েছে এই দানবাকৃতির গর্ত সিংকহোল।
অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো হঠাৎ করেই তৈরি হয়ে যায় না। কয়েক মাস এমনকি বছরও লাগে এর জন্য। আবার কিছু ক্ষেত্রে গর্তগুলো কোনোরকম পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই তৈরি হতে দেখা গেছে। গবেষকগণ দিন রাত পরিশ্রম করছেন এই গর্তগুলোর প্রকৃত গঠন, প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে। এগুলো তৈরি হওয়ার আগে প্রকৃতিতে কিছু পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হয়। দালান বা বাড়ির ফাউন্ডেশনে বা বাড়ির ভেতরে গভীর সিংকহোল সৃষ্টি হতে পারে। গাছপালা মরে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া বা হঠাৎ করেই মাটিতে উপড়ে পড়লেও সেখানে সিংকহোল তৈরি হতে পারে। সিংকহোলের এলাকা থেকে পানি ও অন্যান্য মৌল সরে যাওয়ায় সেখানকার মাটিতে কোনো গাছ বাঁচতে পারে না। এ ছাড়াও টিউবওয়েল বা ট্যাপের পানি হঠাৎ করেই অস্বচ্ছ হলেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বিভিন্ন মিনারেলের সাথে মাটি ও পানি দ্রবীভূত হয়ে এই অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে পানি তৈরি হয়। মাটিতে গোলাকার চক্র দেখা দেয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি স্থান সিংকহোলে পরিণত হতে পারে।
প্রাকৃতিক সিংকহোলগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যেমন লাইমস্টোন বা জিপসাম দিয়ে গঠিত স্তরগুলো পানিতে খুব সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায়। ফলে স্তরগুলো পাতলাতর হয়ে উপরের ভার বহন করতে না পেরে মাটিতে তলিয়ে যায়। এই গঠনের সিংকহোলগুলো প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এবং এগুলো অপ্রতিরোধ্য। মানুষের দ্বারাও কিছু গর্ত তৈরি হয়ে থাকে। ভূগর্ভের পানির অতিরিক্ত আহরণের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে গর্তের গঠন ত্বরান্বিত করে। পানির স্তর বৃদ্ধি বা গ্রাউন্ড ওয়াটার টেবিল রিচার্জের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। পানির অযথা অপচয় কমিয়ে আনতে হবে। খরা প্রতিরোধের যথাযথ নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তৈরি হওয়া গর্তগুলোকে বর্জ্য বা ময়লা ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয়, যা মোটেই কাম্য নয়। কারণ ময়লা থেকে তৈরি হওয়া লিচেট বা পানি অনেকসময় ভূগর্ভের পানির স্তরের সাথে মিশে পানির দূষণ ঘটায়। এর মাধ্যমে নানা রকম রোগজীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। তাই সিংকহোলগুলোকে কোনোভাবেই ভাগাড় বা ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে বার্ষিক ৭.৫ মিটার পানি গৃহীত হয়, যার মধ্যে ৫.৫ মিটার আসে ভূপৃষ্ঠের পৃষ্ঠতল থেকে এবং বাকি ২ মিটারের উৎস হচ্ছে বৃষ্টির পানি। সুতরাং কৃষিতে সেচের জন্য ভূগর্ভের পানি ব্যাপকমাত্রায় উত্তোলন করা হয়ে থাকে এবং ব্যবহারের চেয়ে অপচয় করা হয়ে থাকে ততধিক। ফলস্বরূপ পানির তল ৮ মিটারের বেশি নিচে নেমে গেছে এবং সেই জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে অধিক ঘনত্বের সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। এরূপ অবস্থা চলমান থাকলে বাংলাদেশেও সিংকহোলের মতো বিপর্যয় হানা দিতে পারে। ভূমিকম্প এখন দেশে খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠছে। সিংকহোলের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকম্প অনেকাংশেই দায়ী। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সিংকহোল তৈরি করতে পারে চরম বিপর্যয়। তাই আমাদের সবাইকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে এবং ভূভাগের পানি উত্তোলনের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। গ্রাউন্ডওয়াটার টেবিল রিচার্জের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এভাবে সিংকহোল নামক বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
ই-মেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা