২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

জামালপুরে দ্রুত কমছে কৃষিজমি

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ইটভাটা ও আবাসন ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনে জামালপুরে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। তিন ফসলি কৃষি জমি ধ্বংস এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা, হাউজিং প্রকল্প, সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। জমি ব্যবহার করা হচ্ছে অকৃষিজ নানা কাজে। কৃষকের আয়ের উৎস কৃষি জমি সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ইটভাটা ও ভূমি ব্যবসায়ীরা জমি অধিগ্রহণ করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে কৃষি জমির ওপরই। বাদ যায়নি খাল বিল পুকুর নদীনালাও। সেখানে শোভা পাচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা, পাকা, আধাপাকা ভবন, দোকানপাট ও নানা রকমারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে।

কৃষি জমিতে ইটভাটা দেদারছে গড়ে তুলতে কোনো বাধা নেই । জেলার সাতটি উপজেলায় গড়ে ওঠা ইটভাটার বেশির ভাগেরই লাইসেন্স নেই। প্রশাসনের ধাপে ধাপে টাকা খরচ করে এসব অবৈধ ইটভাটা চালু রেখেছে প্রভাবশালী মালিকরা। লোকালয়ের আশপাশেও রয়েছে অসংখ্য ইটভাটা। জমির উপরিভাগের মাটি কিনে নিয়ে ইট বানানোর কাজে ব্যবহার করছে। এতে কমে যাচ্ছে মাটির উর্বরতা।

ইটভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি দূষিত হয় বাতাস। গাছ, গাছের ফলমূল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষ সর্দি-কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ভাটায় ইট পোড়ানো কয়লা থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর কার্বন-মনোক্সাইড নির্গত হয়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আবার ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও বেশি লাভের আশায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। নিধন করা হচ্ছে গাছপালা, সবুজ প্রকৃতি।

জামালপুর জেলা শহরের শেখের ভিটা এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, চোখের সামনে যা দেখছেন তা ছিল দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। ফাঁকে ফাঁকে ছিল হাতেগোনা গোটা দশেক গাড়িয়াল বাড়ি, দুই-একটি গৃহস্থ বাড়ি। শেখের ভিটা গ্রামের বাসিন্দাদের প্রধান পেশা ছিল গরুর গাড়ি চালনা। গাড়িয়ালপাড়া নামেই অতীতে এ গ্রামটি চিনতো সবাই। আগ্রাসী জমি ব্যবসায় বদলে গেছে শেখের ভিটা গ্রামের দৃশ্যপট। সড়কের দুই পাশে বেশ ক’টি বেসরকারি ক্লিনিক থেকে শুরু করে নানা ধরনের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দেখে মনে হয় বাণিজ্যিক এলাকা। ভেতরে তিন ফসলি আবাদি জমির ওপর গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এই এলাকায় মানুষ বাড়লেও স্থানীয় লোকের দেখা মেলা ভার। এক সময়ের কৃষিপ্রধান শেখের ভিটা এলাকায় কমেছে কৃষিকাজ। কৃষি জমি সঙ্কুচিত হয়ে প্রসারিত হচ্ছে নগরের সীমা।

নতুন বাইপাস সড়ক ও মেডিক্যাল কলেজ হওয়ায় শেখের ভিটার মতো চন্দ্রা, মনিরাজপুর, পলাশগড়, যোগীর ঘোপা, ছোটগড়, বামুনপাড়া ও রামনগর এলাকায় জমির দাম হঠাৎ করে আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। ফলে কৃষিজমি কেনাবেচারও হিড়িক পড়েছে।

এ দিকে বেশি মুনাফা হাতিয়ে নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জমি ব্যবসায়ী একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। কৃষি জমি কিনে মাটি ভরাট করে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্লট তৈরি করছে তারা। প্লট বিক্রি করে তারা পাচ্ছে জমির দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি টাকা। এই আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদাও করছেন অসৎ পথে উপার্জন করা টাকাওয়ালারা।

কৃষিজমি, বিল, ডোবা, নালার জমির কদর রাতারাতি বেড়ে গেছে। উচ্চ মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা ভরাট করছে খাল বিল ডোবা নালা। আবার অনেকের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের ভয়ে মুখ খুলতেও সাহস পান না বেহাত হওয়া ভূমির মালিকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী বেশ ক’জন জমির মালিক জানান, আবাদি জমি বিক্রি করার জন্য আমাদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল প্লট ব্যবসায়ীরা। ফসলি জমি বিক্রি করব না বলার পরও তারা গায়ের জোরে মাটি ভরাট অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের এনে পাহারায় বসিয়েছে। ফলে গত কয়েক মৌসুমে এই জমিগুলোতে কোনো ধরনের চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আইন না মেনে ফসলি জমি ভরাট হলেও সংশ্লিষ্ট কোনো দফতর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টো প্রতিবাদ করা জমির মালিকরা মিথ্যা মামলার শিকার ও অব্যাহত হুমকিতে দিনযাপন করছেন বলে অভিযোগ জানান তারা। কৃষি জমিতে চাষাবাদের বদলে শোভা পাচ্ছে বাসাবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনার নির্মাণকাজ। আবার জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা গড়ে উঠছে কৃষি জমিতেই। অপরিকল্পিত শহরায়ণ ও আবাসন শিল্পের কারণেই আশঙ্কাজনকভাবে কৃষি জমি কমছে।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৃষি বিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, আইনের মাধ্যমে কৃষি জমি রক্ষা করতে হবে এবং কোনোভাবেই তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। কৃষিজমি নষ্ট করে আবাসন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনুর্বর, অকৃষি জমিতে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা বলা হয়। যেকোনো শিল্প-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভবন, বাসস্থান এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমির ঊর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য থাকবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। কৃষিজমি যে কেউ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারলেও তা আবশ্যিকভাবে শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহার করতে হবে। একাধিক ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে আবাসিক উদ্দেশ্যে কৃষিজমি ক্রয় ও ব্যবহার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় এক শতাংশ চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমি কমে যাওয়ার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্পায়ন ও আবাসন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত জামালপুরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের’ যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement
আফগান সীমান্তের কাছে গুলি, ৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে নিহত ৪, ১৪৪ ধারা জারি রাজধানীতে সংঘর্ষে ২ যুবক নিহত জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু তোফাজ্জল হত্যা : ঢাবির ৬ শিক্ষার্থীর দায় স্বীকার কুমিল্লা-১০ বিনির্মাণে আমাদেরকে কাজ করতে হবে : ইয়াছিন আরাফাত উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতেছিল আ’লীগ : হামিদ আজাদ ভাইকে হত্যা করাতে ১৪ মাসের ষড়যন্ত্র ভান্ডালজুড়ি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে খুলনায় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

সকল