২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের ভূমিকা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের ভূমিকা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা - প্রতীকী ছবি

১৬ ডিসেম্বর মহান দিবস। ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। বাংলাদেশের এ বিজয়ের রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি। যার শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বরং এরও আগে স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত আরম্ভ হয় ইংরেজদের উপমহাদেশীয় ঔপনিবেশিক জুলুমের শাসনের বিরুদ্ধে ১৮০৩ সালে শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর ঐতিহাসিক দারুল হারব ঘোষনার মধ্য দিয়ে।

এরপর ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমাদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদের নেতৃত্বে রচিত বালাকোটের রণাঙ্গন, ১৮৫৭ সালে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সিপাহী বিপ্লব, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ., মাওলানা কাসেম নানতাভী রহ. ও মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী রহ. -এর নেতৃত্বে শামেলীর ময়দান, ১৯১৪ সালে শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.-এর নেতৃত্বে তাহরীকে রেশমি রুমাল, ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী, শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী, যফর আহমাদ উসমানী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি, এরপর ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদ জব্বার রফিক, সালাম ও বরকতের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে পরাধীনতা, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের অনেক বছর। বীর বাঙালির হৃদয়ে ক্ষতদাগ কেটে আছে ভাষা আন্দোলনসহ ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। নিরস্ত্র বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তানী হায়েনাদের অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা। মুক্তির লক্ষ্যে শুরু হয় মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজকের ১৬ ডিসেম্বর সেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল।

১৯৭১ সালের বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশীরা পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে অর্জন করেছে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে সগৌরবে সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নতুন ভূখণ্ড। সবুজের গালিচায় রক্তের ফোঁটা পড়ে স্বদেশ যালিম ও শোষণমুক্ত হয়েছে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বপ্নের নতুন ঠিকানা।
আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, স্বাধীনতার পঞ্চাশ পূর্ণ হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যার নেতৃত্ব ও ত্যাগে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, তিনি হলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিলো জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। আর এই ঈমানী দায়িত্ব পালনার্থেই ইতিপূর্বের আন্দোলন সংগ্রামের মতো এবারো দেশের আলেম সমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের নেতৃত্ব দিয়ে মানুষকে পাকিস্তানি জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করতে সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাসে এজন্য ভাস্বর হয়ে আছেন মাওলানা আব্দুল হামীদ খান ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী, শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান, মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী, মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফিজ্জী, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম। আজকের এই দিনে সব বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দোয়া।

আজকের এদিনে শরীয়ত অনুমোদিত আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে অবিকৃত প্রকৃত ইতিহাস উপস্থাপন পূর্বক জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরী। পাশাপাশি দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহীদকে স্মরণ করে দোয়া মোনাজাত করা দেশের প্রতিটি মুসলমান নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব।

একজন আদর্শ মুসলিম নাগরিকের জন্য দেশ প্রেমের কোনো বিকল্প নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রচারের কারণে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরত করেছিলেন মদীনায়। দীর্ঘ ১০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর সফলতার সাথে নিজ মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরী স্বাধীন করেন। অর্জন করেন মহান স্বাধীনতা ও বিজয়।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেশ ত্যাগের সময় বার বার অশ্রুসিক্ত নয়নে জন্মভূমির দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়েছিলেন আর বলেছিলেন- ‘হে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার অধিবাসীরা যদি আমাকে অত্যাচার-নির্যাতন করে বিতাড়িত না করত; আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যেতাম না।’

দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর বিজয়ে প্রথম আনন্দে তিনি আদায় করেছেন ৮ রাকাআত নামাজ। প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘যারা কাবাঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নেবে; তারা যত অত্যাচার নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিল প্রিয়নবীর মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা। সূরা নাসরের অর্থের ব্যাপকতার বিবেচনায় মহান বিজয় দিবসে তাসবীহ, তাহমীদ, ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাওবাহও দেশের প্রতিটি মুসলিম নাগরিকের একটি নেক আমল হতে পারে । আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘(হে নবি!) যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে; আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন,তখন আপনি আপনার পালনকর্তার সপ্রশংস তাসবীহ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা নাসর)

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরপরাধ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করব। দেশের উন্নয়নে তার কাছে সাহায্য চাইব। নিজেদের পরিশুদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও তার সাহায্য চাইব। নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করব। নিজেদের দেশের সেবায় উৎসর্গ করব। এটাই বিজয় দিবসের ধর্মীয় দিকনির্দেশনা।
বিজয় দিবসে এদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো- বিজয় দিবস উদযাপনের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য আত্ম ও অঙ্গদানকারী বীর সন্তানদের যথাযথ স্মরণ করা। স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়া বীরসেনাদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা। তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেয়া। তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো। এর পাশাপাশি যেকোনো ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এবং দেশকে নতুন কোনো উপনিবেশের জাতাকলে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সদা সজাগ ও জাগ্রত থাকা।

মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত (মুসলিম দেশের) সীমানা পাহারা দেয়া এক মাসব্যাপী রোজা পালন ও মাসব্যাপী রাত জাগরণ করে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। এ অবস্থায় যদি ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে; তবে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে; কবর ও হাশরে ওই ব্যক্তি ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে।’

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক-মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ ঢাকা।
মুহাদ্দিস-জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, মুহাম্মদপুর ঢাকা।
খতিব-চাঁদতারা জামে মসজিদ, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement