২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হত্যার রাজনীতি : আবরার ফাহাদ

-

বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যামামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বর। রায়ে ২০ জনের ফাঁসি আর পাঁচজনের যাবজ্জীবনের রায় দিয়েছেন বিচারক। রায় পেয়ে সাধারণ মানুষ অনেকটাই খুশি। ফাহাদের পরিবার আংশিক খুশি। তারা বলেছেন, ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তারা পুরোপুরি খুশি, এটি বলবেন না।

তারা সেটি বলতেই পারেন। কিন্তু আমরা তো তালিয়া বাজানোর লোক। খুশির চোটে তালিয়া বাজিয়ে বলব, রায়ে আমরা খুশি। ন্যায়বিচার হয়েছে। যেমনটি বলেছেন আইনমন্ত্রী, তিনি খুশি। তিনি আইনের পেশাজীবী ছিলেন, এখন মন্ত্রিত্বের জন্য প্র্যাকটিস করেন না। তবে জানেন কত ধানে কত চাল হয়। ন্যায় রায় হওয়ার পেছনে আইনজীবীদের বড় ভ‚মিকা রাখতে হয়। আবার রায় অন্যায় হয়েছে এমনটি বলা রেওয়াজসম্মত নয়। রায় নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলা আদালত অবমাননার শামিল বা অবমাননা। তাই ঠোঁটকাটারাও আদালতের রায়ের প্রতি কদাচ কটাক্ষ করেন।

রায় ঘোষণার পর অনেকেই আফসোস করেছেন এমন সম্ভাবনাময় একটি; ফাহাদ ও আসামি ২৫টি জীবন বরবাদ হয়ে গেল। ২৬টি পরিবারের আশা-আকাক্সক্ষা চিরদিনের জন্য ধূলিসাৎ হয়ে গেল। এ কথার বিপরীতে কেউ বলবেন, কেন তারা হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ করল? সেই অপরাধের জন্যই তো আজকের এ রায়।
আমি ভেবেছিলাম, ‘আমার ছেলেটি’ রায়ের পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে? মনে হয়েছিল ফাহাদ আমারই আত্মজ।

হাস্যকর এ চিন্তার পর উদিত হলো আরেকটি চিন্তা, যদি এটি না হয়, তা হলে এই আইন এই আদালত, এই বিচারব্যবস্থার উপকারিতা কী? আমরা জানি এবং বহুবারই এই গীত শুনেছি যে, এরকম ন্যায়বিচার ও রায় সমাজে ইতিবাচক ফল দেবে বা দেয়। যদি তেমনটাই হতো তা হলে ৫০ বছরে অব্যাহতভাবে মানুষ হত্যা চলছে কিভাবে? রায় তো আমরা বহুবারই ন্যায়সঙ্গত পেয়েছি, কিন্তু তার সুফল তো কেবল আশার মতো এক বায়বীয় কল্পনার মগডালে উঠে বসে আছে।

আশা পূরণ না হলেও আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি আইন-আদালত আর বিচারকদের ওপর। তারাই সমাজের অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতে সহায়ক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের সব থেকে বড় প্রবহমান অংশ রাজনীতি এবং সেই রাজনীতির অংশীদার বা নেতাকর্মী তাদের রাজনৈতিক মনন-মনীষায় যে অপরাধ স্থায়ী হয়েছে, আইন-বিচারক-রায় কি রাজনৈতিক কাঠামো ও আদর্শকে নতুন দীক্ষায় উজ্জীবিত করতে পেরেছে?

জবাব এক কথায়, না পারেনি। আইনের শাসন বলে যে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কল্পনা আমরা করি বা আমাদের মনে-মননে-মানসে ও প্রজ্ঞায় রয়েছে, তা রাজনৈতিক চরিত্রে নেই। রাজনৈতিক চেতনায় যখন মানুষ ও মানবতা থাকে না, তখনই হত্যার মতো নৃশংসতার ঘটনা ঘটে বা ঘটতে থাকে। মানুষের লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ ঝুঁকে থাকে তার স্বার্থের দিকে। এই লোভ রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান প্রবাহ। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই সহমর্মিতা। তারা অন্য দলের রাজনীতিকদের সহকর্মী ভাবেন না, তাদের জ্ঞান ‘শত্রæ’তে সীমায়িত। এই শত্রæতা ব্যক্তিগত স্তরে নেমে এসেছে আজ। আর সেই কারণেই আবরার ফাহাদ হত্যার শিকার হয়েছে বুয়েটের মতো প্রকৌশলের ছাত্রদের হাতে। ছাত্রলীগের ওই সব ছাত্র এসেছিল প্রকৌশলী হতে, রাজনীতিকদের রাজনীতির খপ্পরে পড়তে নয়। বাবা-মা তাদের স্বপ্ন বাস্তব করতেই সন্তানদের তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি তাদের জ্ঞানের মিছিল থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে রাজনীতির অন্ধকার গলিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যার শেষ মাথায় আজ তারা দেখতে পাচ্ছে কেবলই অন্ধকার, ফাঁসির রজ্জু।

কেন তারা হত্যার মতো নির্মম কাজ করতে গেল? কেন তারা তাদেরই এক ছাত্রবন্ধুকে ভিন্নমতের অপরাধে, যা তাদের এখতিয়ারের বাইরে, পিটিয়ে হত্যা করতে গেল? তাতে তাদের কী লাভ ছিল? কে বা কারা তাদের হত্যা করতে উসকে দিয়েছিল? কেন তারা এটি মনে করেনি যে, হত্যামামলার আসামি হিসেবে তাদের ফাঁসি হতে পারে, যাবজ্জীবন হতে পারে?

মনে পড়েনি, কারণ হুকুমদাতা নিশ্চয়ই আশ্বস্ত করেছেন, দল এখন ক্ষমতায় অতএব ভিন্নমতাবলম্বীর কোনো অধিকার নেই সরকারের সমালোচনা করার। আর তাকে হত্যা করলেও কোনো বিচার হবে না। বিচার হলেও তারা ছাড়া পাবে নির্দোষ হিসেবে। সূত্রের বর্ণনায় জানা গেছে, ফাহাদকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়েছে আগের দিন। পরদিন তাকে হত্যা করেছে ২৫ জনে মিলে। যে ক’জন ছাত্রলীগ কর্মী হত্যার ভয়াবহতা টের পেয়েছে, তারা গা-ঢাকা দিয়েছে এবং পালিয়ে গেছে বিদেশে। যারা রাজনৈতিককর্মী, আইন-আদালতকে নয়, বিশ্বাস করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়, তারাই ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে এবং তারাই আজ কারাবন্দী। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করবে। আপিলের রায়ের পর বোঝা যাবে শেষ রায় কী। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

২.
রাজনীতিতে গুণ্ডামির সংস্কৃতি বহু পুরনো। বিশেষ করে পাকিস্তানি আমলেই এর সূচনা বলতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের এনএসএফ গুণ্ডাদের আধিপত্য ছিল। তাদের কেউ গলায় সাপ নিয়ে ঘুরত, কারো কাছে থাকত ড্যাগার। ওই ড্যাগার শব্দটি স্বাধীনতার পর হারিয়ে গেছে। তার জায়গায় এসেছে পিস্তল/রিভলবার/কাটা রাইফেল ইত্যাদি। আরো যুক্ত হয়েছে চাপাতি। আরো পরে একে-৪৭ রাইফেল এক সংসদ সদস্যের হাতে দেখা গেছে। আর রাজনীতিকদের কারো কারো বাসা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে দীর্ঘ বয়ানের প্রয়োজন নেই। তবে স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সামরিক শাখা ‘গণবাহিনী’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের ভীতি ও হত্যার মাধ্যমে সরকার পতনের অপচেষ্টা চালিয়েছিল। মূলত ও মুখ্যত বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব রাজনীতিতে হত্যার রাজনীতির সূচনা সেখান থেকেই। দেশের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সূচনা সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির, দ্বিতীয় স্থানে জাসদ। গণবাহিনী ঈদের জামাতেও ব্রাশ ফায়ার করে চিহ্নিত ব্যক্তি ছাড়াও হত্যা করে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে। সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু এসব হত্যার কোনো বিচার হয়নি।

৩.
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তারই সহকর্মীরা ক্ষমতায় বসে এবং ওই হত্যার জন্য তারা অনুতপ্ত হয়নি; বরং তারা ইনডেমনিটি করে ওই হত্যার বিচার বন্ধ করেছিল। কারা সেই হত্যার নির্দেশদাতা জাতি আজো তা জানতে পারেনি। কেবল মোশতাকের নাম বলা হয়, কিন্তু তার চার পাশে যারা ছিলেন, যারা মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, তারাও কি জড়িত ছিলেন না? শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ওই হত্যার বিচার করেছেন। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা ওই নির্মম হত্যার পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা সেসব রাজনৈতিক লোকেরা আইন ও বিচারের বাইরেই রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার, অভ্যুত্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা ও জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচার হয়নি। জেনারেল/ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ হত্যার বিচার হয়নি। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টারও বিচার হয়নি। সন্দেহ করে কয়েকজনকে আটক করা ছাড়া আজো এ অপরাজনীতির দোষীদের চিহ্নিত করা হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার বহু চেষ্টার কথা সংবাদপত্রে এসেছে। তার গাড়িতে গুলি চালানো, গাড়িবহরের লোকদের ওপর চড়াও হয়ে হত্যার চেষ্টারও কোনো সুরাহা হয়নি। মনে করা হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষই ওই সব অপরাধের কাজ করেছে। পুলিশের প্রতিদিনকার অপরাধ যদি ধরা হয় তা হলে ময়লা বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। এ সব ব্যাপারে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ চলে যাওয়ার পরও পুলিশ দায়িত্ব পালন করেনি বা করতে দেয়া হয়নি। এভাবেই রাজনীতি ও রাজনৈতিক অপশাসন দেশের সার্বিক পরিবেশ নস্যাৎ করেছে। প্রশাসনকে রাজনীতিকরণের ফলে দুর্নীতির মতো নৃশংসতা বেড়েছে। দুর্নীতিকে হত্যার মতোই নির্মম বলে মনে করি আমরা। দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন দেশের কোনো উন্নয়নে লাগে না। আজকে যেসব উন্নয়নের চেহারা দেখতে পাচ্ছি, এর পেছনে দুর্নীতি প্রচণ্ডভাবে সক্রিয় বিধায় কোনো প্রজেক্টই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয় না। এটাও হত্যার রাজনীতি ও অবৈধ ক্ষমতারই বিষফল।

এসব বিচারহীনতাই রাজনীতিতে হত্যার ধারা প্রবল করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধী দল দমনের নামে গুম, খুন, হত্যা, পাচার ইত্যাদির কারণে আমাদের রাজনৈতিক জীবন ভয়াবহ। সমাজে বিরাজ করছে ভয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই রাজনৈতিক ভীতির জন্মদাতারা ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে সক্রিয়। দেশের মানুষ সরকারের কোনো কাজেরই সমালোচনা করতে পারে না। তারা ভয় পায় কখন আবার কারা এসে ধরে নিয়ে যায় এবং নিখোঁজ করে দেয়।

আবরার ফাহাদ ওই ভয়কে জয় করতে গিয়েছিল। তার অপরাধ সে সরকারের রাজনীতির, কাজের সমালোচনা করেছিল যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। একটি ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে সমালোচনা করার অপরাধে একজন শিক্ষার্থীকে খুন করতে হবে এই রাজনীতি যারা শেখায়, যারা করে, তারা ভয়ের রাজনীতির চালক, বরকন্দাজ। তাদের বিচার কে করবেন, কোন আদালতে হবে? গত ৫০ বছর ধরে এই ভয়ের রাজনীতি, হত্যার রাজনীতি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে চালু, তবে তার কোনো নিরাময়ের কথা কেউ বলেন না।

রাজনীতি শুদ্ধ করার কেউ নেই। রাজনীতি যে কলুষিত এটি বিশ্বাস করলেই কেবল তা পরিশুদ্ধ করার কথা আসে। আইন প্রয়োগে রাজনীতি পরিশোধিত হবে না। এর জন্য চাই রাজনৈতিক দর্শন, চর্চা ও সুপ্রয়োগ। এটি করতে হলে রাজনীতিকদের নেমে আসতে হবে রাজপথে এবং বলতে হবে- আমরা পরিশুদ্ধ হতে চাই, আমরা পরিশুদ্ধ হবো এবং এমন এক রাজনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করব যেখানে প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকবে, কিন্তু সেখানে জীবন হানিকর কোনো উপাদান থাকবে না। এ পথে চলতে হলে রাজনীতিকদের গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে হবে। রাজনীতি রাজপথে নেই, জ্ঞান ও তার চর্চায় নিহিত। একটি জাতির সার্বিক উন্নতি জ্ঞান ও তার চর্চার ওপরই নির্ভরশীল, ধুন্ধুমার, সহিংস ও উত্তেজিত স্লোগানের মধ্যে তার জায়গা নেই। ওই রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং রাজনীতিকে মানবিক স্পেসে নিয়ে আসতে হবে- সহনশীল, পরমতসহিষ্ণুতায় নিয়ে আসতে হবে।

দয়া করে ফাহাদদের হত্যার মতো রাজনৈতিক অপরাধ আর করবেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বজনহারার বেদনায় নীল হয়ে আছেন বলেই ফাহাদ হত্যার বিচার করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। একটি আইনি সমাধান আমরা পেয়েছি। তিনি বুয়েটে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি যদি বুঝে থাকেন যে, ছাত্ররাজনীতি দেশের শিক্ষা খাতকে রক্তাক্ত করছে, তা হলে ছাত্ররাজনীতি চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে জাতিকে নতুন প্রণোদনার জানালায় নিয়ে আসতে পারেন। আমরা চাই সরকার আইন করে নিষিদ্ধ করুক রাজনীতির বিষকাঁটা।


আরো সংবাদ



premium cement