২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভাঙনের শব্দ শুনি

-

গত ২০ থেকে ৫০ বছরে বিশ্বে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও শিল্পবিপ্লব- উন্নতি সবই হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে দ্রুত একটি অগ্রসরমান সামাজিক বিপর্যয় সবার অগোচরে ঘটেছে। এটি উইপোকার মতো আমাদের সমাজকে গিলে খাচ্ছে। ভাঙছে পরিবার ও সমাজ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত সাত বছরে আমাদের দেশে বিয়ে বিচ্ছেদ প্রায় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে, যা বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় একটিতে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টির আড়ালে ঘটনাগুলো ঘটছে বিধায় আমরা তা টের পাচ্ছি না। এ প্রবণতা এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছর পর আমাদের পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে যেতে পারে। পরিবার প্রথা ভেঙে গেলে কী হয় সেটি পাশ্চাত্যকে দেখে বুঝতে পারি। ভাঙা পরিবারে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি শিশুদের মানসিকভাবে প্রচণ্ড রকমের আঘাত করে। এসব শিশু কখনো স্বাভাবিক কিংবা মানসিক ভারসাম্য নিয়ে বড় হতে পারে না। তাদের ভেতরে একটি হীনম্মন্যতাবোধ এবং অপরাধপ্রবণতা কাজ করে। ফলে পরবর্তী সময়ে তারা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

আমাদের সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদের হার কেন বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি বৈকি। অনেকেই এটি নারীর ক্ষমতায়ন বলে মনে করেন। তাদের কথা হচ্ছে- নারীরা বুঝতে শিখেছেন, জানতে শিখেছেন। ফলে এটি হচ্ছে। এটি বলে তারা আত্মতৃপ্তিবোধ করতে পারেন। কিন্তু এর ফলে আমাদের পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, পারিবারিক কলহের জন্ম হচ্ছে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, শিশুরা প্রভাবিত হচ্ছে। এটি আমরা করতে পারি না। এটি কিন্তু ভাববার বিষয়। আমরা যদি এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খতিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাবো- মহিলারা বেশি হারে তালাক দিচ্ছেন এবং বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত এবং বিত্তশালী পরিবারে এ প্রবণতার হার বেশি। গ্রামের চেয়ে শহরে এ হার বেশি।

মিডিয়ার বিপ্লবের ছোঁয়ায় মহিলারা বুঝতে শিখেছেন যে, স্বামী না থাকলেও চলে। কিছুদিন আগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মালালা ইউসুফজাই বির্তকিত একটি মন্তব্য করেছেন। তার মতে, কাগজ-কলমে বিয়ে করা ছাড়াও দু’জন মানুষের মধ্যে আজীবন পার্টনারশিপের সম্পর্ক হতে পারে। তার এ মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিচ্ছেদ নিয়ে এত কথা বলছি কেন? আর বিচ্ছেদ হলে আমাদের অসুবিধাটা কোথায়? এমন প্রশ্ন কেউ উত্থাপন করতেই পারেন? কিন্তু বুঝতে হবে আমাদের একটি পরিবার ও সমাজ আছে। পারিবারিক একটি ভিত্তি আছে। এখানে নৈতিকতা ও দায়দায়িত্ববোধ আছে। এখানে দু’জনের ভেতরে বোঝাপড়া ও সহযোগিতার ব্যাপার আছে। সবাই মিলে একটি পরিবার বা সমাজকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আছে। কিন্তু যখন একটি পরিবার ভেঙে যায় তখন এগুলো সব হারিয়ে যায়। আর হারিয়ে গেলে তখন কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকায় না। সবচেয়ে নেতিবাচক হচ্ছে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারিয়ে যায়।

ইদানীং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এর সাথে কিন্তু বিয়ে বিচ্ছেদের ব্যাপারও জড়িত। আত্মহত্যা কিন্তু বৃদ্ধরা করে না। যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত তারা করছেন না। করছে যুবক শ্রেণীর ছেলেমেয়ে। বয়ফ্রেন্ড ও গালফ্রেন্ডের মধ্যে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে সামান্য মনোমালিন্য হলেই আত্মহত্যার মতো সর্বনাশা পথ বেছে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তরুণরা আমাদের সম্পদ। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে আমরা পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কোনো শিক্ষাই দিতে পারিনি। এমনকি তাদের পাঠ্যজীবনেও শিক্ষা দিতে পারিনি। ফলে তারা উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ জীবনাচারের দিকে অগ্রসরমান। সুতরাং এখানে শিক্ষার একটি ব্যাপার আছে। একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই কিন্তু অধিকার ও কর্তব্যবোধ আছে। কিন্তু আমাদের তা শেখানো হয় না। সুতরাং যখন তারা প্রথম সংসার শুরু করে তখন তাদের অধিকার নিয়ে তাদের ভেতর সঙ্ঘাত শুরু হয়। এ সঙ্ঘাত অনেকসময় বিচ্ছেদে পরিণত হয়।

নারী অধিকার আর নারীর দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। অধিকারের সাথে দায়বোধ আছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে যা শেখানো হয় তা হলো অধিকার আছে কিন্তু দায়বোধ নেই। এ অধিকার কিন্তু ভিন্ন খাতে মানুষকে প্রভাবিত করে। যার নমুনা আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখি। এখন আমাদের দরজা-জানালা সবই খোলা। এ খোলা দরজা জানালা দিয়ে যা কিছু আসে তা তরুণ মনকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। ১৫ কিংবা ১৭ বছরের ছেলে বা মেয়েরা অসামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এর সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানি না। কিন্তু এটি যে ভীতিকর পর্যায়ে আছে তা বোঝা যায়। স্বামী অনেকসময় দুর্ব্যবহার করেন, নেশা করেন। স্বামী বহুদিন প্রবাসে থাকেন। এ কারণেও কিন্তু বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। এগুলো যদি আমরা সঠিকভাবে মোকাবেলা না করি, তাহলে এটি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। পণপ্রথা এখনো সমাজে বিরাজমান। আইন করে আমরা পণপ্রথা বন্ধ করতে পারিনি সচেতনতার অভাবে। এটিও বিয়ে বিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ। এটি এখনো আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ ব্যাপারে সচেতনতার সাথে সাথে কঠোর আইন প্রয়োগ দরকার।

উন্মুক্ত মিডিয়ার জন্য বহুগামিতা বেড়েছে। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সমাজের উচ্চবিত্ত, উঁচুস্তর ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী বেকার, প্রেম করে বিয়ে করেছেন। বউ চাকরি পেয়েছেন। স্বাবলম্বী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য না থাকায় পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের দায়িত্ববোধ আছে। সব দোষ শুধু বউয়ের ওপর দিলে হবে না। অনেকেই আছেন স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, এমনকি গায়ে হাতও তোলেন। এটিও বিচ্ছেদের একটি কারণ। এ কারণগুলো শোধরানোর ব্যবস্থা না করে নারী অধিকারের কথা বলে, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে আমরা কোনোদিন বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারব না। মিডিয়ার ব্যাপারে একটি কার্যকর বিধিমালা থাকা প্রয়োজন। যেন গঠনমূলক অনুষ্ঠানমালার ব্যবস্থা থাকে। সমাজকর্মী, মসজিদের খতিব, ইমাম, ধর্মীয় ব্যক্তি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এ প্রবণতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসত পারব। এখানে সরকারি নীতিমালার বিশেষ ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে- বিয়ে বিচ্ছেদ একটি সামাজিক ব্যাধি। এর মোকাবেলায় সমাজের সর্বস্তরের সচেতনতা অপরিহার্য।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement
আ’লীগ ইসলামী আদর্শকে জঙ্গিবাদ বলে এখন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে : আলাউদ্দিন সিকদার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কঠোর হয়ে দমন করতে চাই না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শরণখোলা প্রেসক্লাবের নির্বাচনে আলী সভাপতি-আনোয়ার সম্পাদক রিমান্ড শেষে কামরুল-জ্যাকবকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ সংবিধানে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিলো বিএনপি যমুনা রেল সেতু উদ্বোধন জানুয়ারিতে, ট্রায়াল ট্রেনের যাত্রা শুরু চিন্ময়ের মুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করতে ভারতকে অনুরোধ ইসকনের শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে হেফাজতের অভিযোগ চিন্ময় কৃষ্ণের জামিন নামঞ্জুর আশুলিয়ায় মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ বিদেশী শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফেরার পরামর্শ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর

সকল