কেন এমন হলো আফগানিস্তানে
- আবু সাঈদ মাহফুজ
- ০১ অক্টোবর ২০২১, ২১:০৪
পর্ব : দুই
কমিউনিস্ট-পরবর্তী আফগানিস্তান। আরেক নতুন খেলা। আগের আলোচনায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত যুগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেটি বিশেষভাবে আলোচনা করেছিলাম এ জন্য যে, কয়েকটি আলোচনা দেখেছি যাতে কেউ কেউ বোঝাতে চেয়েছেন আফগানিস্তান একটি ‘ক্যাওটিক’ বা একটি ‘ভেজাইল্যা’ দেশ। সমস্যাগ্রস্ত দেশ। এরা গোঁয়ার বা অসভ্য। কিংবা কেউ কেউ ইসলামের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই এটি স্বভাবতই আলোচনার দাবি রাখে যে, আফগানিস্তানের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? শুধু আফগানিস্তান নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কে কিভাবে কার ছত্রছায়ায় কী করছে, তা জানা ও বোঝা খুবই জরুরি। শয়তান অনেক সময় খুব সুন্দর লেবাসেই আসে। সুন্দর বাণী নিয়েই আসে। মাকাল ফল শুধু মার্কসবাদী উদাহরণ নয়, সব শয়তানই দেখতে মাকাল ফলের মতো। সুন্দর চেহারা আর মুখে মধুর বাণী নিয়েই শয়তানরা আসে।
একটা ডায়াগ্রাম দিয়েছি, যা একনজরে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র। অনেকটাই স্পষ্ট। আফগানিস্তানের পটপরিবর্তনকে প্রধানত পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছি। এসব ভাগ হলোÑ ১৯৭৩ সালের পূর্ব যুগ; ১৯৭৩-৯২ যুগ; ১৯৯২-২০০১ যুগ; ২০০১-২১ যুগ এবং ২০২১-পরবর্তী ভবিষ্যৎ। তার মধ্যে কিছু উপ-ভাগও রয়েছে। আজকে মূলত তৃতীয় পর্যায় বা সোভিয়েত-পরবর্তী সময় তথা ১৯৯২ থেকে ২০০১ সালের ওপর কিছুটা আলোচনা করব।
সম্প্রতি পিনাকি ভট্টাচার্য তার এক ভিডিওবার্তায় আফগানিস্তান ও তালেবানের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে একটি বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, পিনাকি ভট্টাচার্য একজন বিদগ্ধ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি, বিশেষভাবে তিনি তালেবানের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে অসাধারণ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। ভট্টাচার্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোর মধ্যে ছিল- James Fergusson-এর লেখা একটি বই, `Taliban : The Story of the Worlds Most Feared Guerrilla Fighters'.
এই বইয়ের রেফারেন্সে তার সেসব তথ্য যাচাই করা ছাড়াও তালেবান সম্পর্কে আমার আরো জানার জন্য আমি নিজে বইটি পড়ার প্রয়োজনে অর্ডার দিতে চাইলাম; কিন্তু বইটি মার্কেটের বাইরে এবং ছাপানো বন্ধ। তাই অ্যামাজনের মাধ্যমে অন্যের ব্যবহার করা পুরনো বইয়ের অর্ডার দিলাম, হাতে এলে পড়ে আশা করি আরো তথ্য সরবরাহ করা যাবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা দরকার। সেটি হলো- আফগানিস্তান সম্পর্কে পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে প্রচার করে, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। হ্যাঁ, আগের আলোচনায়ই যেমন বলেছিলাম বা আমরা অনেকেই জানি, আফগান ও পশতুনদের সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। আমি ১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়া থাকাকালে এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলাম সে সময়কার পাক্ষিক পালাবদলে প্রকাশিত এক লেখায়। কোনো আফগানকে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনারা ভাইবোন কতজন? তখন উত্তর পাবেন ‘আমরা পাঁচ ভাই’। আপনি যদি ফের প্রশ্ন করেন, বোন কতজন- তখন আপনার ভাগ্য যদি খারাপ হয় তবে আফগান লোকটি ধপাস করে আপনার গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারে। আর আপনার ভাগ্য যদি ভালো হয় তা হলে আফগান লোকটি আপনাকে বলবে, ‘দেখুন ভাই, আমরা আফগানরা আমাদের বোন সম্পর্কে কথা বলি না।’
পুরো আফগান সংস্কৃতিতে নারী একটি গোপনীয় কিংবা আলাদা বিষয়। আবার এই নারীর সম্মানের জন্য তার জীবনও দিতে পারে। আপনি যদি তাদের মা কিংবা বোনের অসম্মান করেন তা হলে আপনার জীবনও নাশ হতে পারে। সে সময়ই ১৯৯৩ সালে মালয়েশিয়ার ভার্সিটি ক্যাম্পাসে এক গল্প শুনেছিলাম যে, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে এক আফ্রিকান এক আফগান মেয়েকে বিয়ে করে, তা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝির পর আফগানিস্তান থেকে কিছু যুবক এসে সরাসরি সেই আফ্রিকান ‘দুলাভাই’কে হত্যা করেছিল।
১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল আফগানিস্তানের জন্য আরেক দুঃসময়। বলা যেতে পারে খুবই কঠিন ও জটিল। সে সময়ের সমস্যাটা শুধু দ্বিমুখী বা ত্রিমুখী ছিল না, ওই সমস্যাটা ছিল চতুর্মুখী কিংবা বলা যায় পঞ্চমুখী। এক দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে গেলেও রেখে গেছে মার্কসবাদীদের আদর্শিক সন্তানদের। অন্য দিকে প্রবেশ করেছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের আদর্শিক সন্তানরা।
পাশ্চাত্যপন্থীদের সূতিকাগার ছিল সেই কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য দিকে ইসলামপন্থীদের মধ্যে ছিল এক বিশেষ দ্ব›দ্ব, এটি এক কথায় অনেকটা জামায়াত ও দেওবন্দি আদর্শের লড়াইয়ের মতো। এটিকে কেউ কেউ জামায়াত-দেওবন্দি লড়াই না বলে কনজারভেটিভ আর লিবারেলদের দ্ব›দ্বও বলতে পারেন যে দ্ব›দ্বটা মূলত বিশ্বজুড়েই রয়েছে। আধুনিক বিশ্ব কিংবা পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক কী হবে, কিভাবে হবে এসব নিয়ে ফিলোসফিক্যাল ডিফরেন্সে। যেমন- ফিলিপাইনে মরো মুসলমানদের রয়েছে মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট ও মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট। এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করা যাবে।
১৯৯২ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়া সরকার যখন দেখছিল যে, আফগানিস্তান থেকে তাদের পাততাড়ি গোটাতে হচ্ছে খুব শিগগিরই, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নজিবুল্লাহ সরকারকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়। শিগগিরই এর প্রথম মারাত্মক প্রভাব পড়তে থাকে আফগানিস্তানের অর্থনীতির ওপর। এ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ আফগান এয়ারফোর্স শুধু তেলের অভাবেই বন্ধ করে দেয়া হয়।
আস্তে আস্তে খেলা জমতে থাকে। এবারের খেলার প্রধানতম খেলোয়াড় আমেরিকা এবং তাদের দোসর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো। আফগান মাঠের সম্মুখ সমরে মূল মাঠে খেলোয়াড় ছিলেন বুরহানউদ্দিন রাব্বানি, আহমদ শাহ মাসুদ; অন্য দিকে খেলছিলেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। রাব্বানি ছিলেন কিছুটা গুরু বা মুরুব্বি হিসেবে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। তবে সময়টা অনেক দিক থেকেই খুবই প্রশ্নবোধকই নয়, বেশ দুর্বোধ্যও ছিল। অন্য সব এলোমেলো দেশের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতিতে বারবার পরিবর্তন আনা হয়। সে সময়, কে আসলে ক্ষমতায় ছিলেন তা খুঁজে বের করাও এক কঠিন কাজ ছিল। দেশটি কার নিয়ন্ত্রণে ছিল সেটিও কেউ বলতে পারত না। রাব্বানি অফিসিয়ালি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত, সেটিই দেখবেন ইতিহাসের বইতে। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই তিনি পলাতক বা নির্বাসিত ছিলেন। তবে আগেই যেমন বলেছি, রাব্বানি ছিলেন প্রধানতম খেলোয়াড়দের অন্যতম। অনেকটা গুরুও।
তাত্ত্বিকভাবেও বুরহানউদ্দিন রাব্বানি একজন গুরু ছিলেন। শিক্ষক ছিলেন। তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। এক অর্থে বলা যায়, অন্য মূল খেলোয়াড়দ্বয় হেকমতিয়ার ও আহমদ শাহ মাসুদেরও গুরু ছিলেন।
আহমদ শাহ মাসুদ ও হেকমতিয়ার বারবার দু’জন ভিন্ন ভিন্ন পোস্টে খেলেছেন কিন্তু তারা নিজেই হয়তো জানতেন না একে ওপরের বিরুদ্ধে খেললেও আসলেই তারা খেলছিলেন একই লক্ষ্যে। আবার বৃহত্তর অর্থে বলা যায়- আফগানিস্তানেরই বিরুদ্ধে। দেশটিকে ধ্বংসের দিকে নিতে।
সে সময় তলে তলে খেলছিলেন আরেক খেলোয়াড় আবদুর রশিদ দোস্তাম। একজন চতুর ও বিশ্বাসঘাতক এই খেলোয়াড় তরুণ বয়সেই আফগান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। তবে তিনি দুই দিকেই ভালো খেলেছিলেন; অর্থাৎ এক দিকে আফগান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, কমিউনিস্ট শাসন তথা নজিবুল্লাহর সময় উচ্চ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, নজিবুল্লাহ কর্তৃক অনেকগুলো প্রমোশনও বাগিয়ে নিয়েছিলেন, এ সময় দোস্তামের অধীনে ৪৫ হাজার সৈন্য ছিল। দোস্তাম অপর দিকে সিআইএর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন এবং নজিবুল্লাহ সরকার তথা সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনে বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন। আবদুর রশিদ দোস্তাম আহমদ শাহ মাসুদের সাথে বিশেষ মিত্রতা স্থাপন করেন। অবশ্য মাসুদের সাথে দোস্তামের ওই মিত্রতা যে তার দুই দিকে খেলার কৌশল তা স্বভাবতই বোঝা যায়। মাসুদ কে ছিলেন তা বুঝলেই ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
১৯৯৮ সালে তালেবান যখন কাবুলের দখল নিয়ে নেয়, তখন দোস্তাম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ২০০১ সালে আমেরিকা ও ন্যাটোর যৌথ বাহিনী যখন আমেরিকা দখল করে, তখন দোস্তাম আফগানিস্তানে ফিরে আসেন এবং আগের রাজনৈতিক খেলার পুরস্কারস্বরূপ ২০১৪ সালে আশরাফ গনির সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছিলেন।
১৮ মার্চ ১৯৯২, প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহ তার সরকারের পদত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং জাতিসঙ্ঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালের সরকার গঠন করা হয় সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদির নেতৃত্বে। নজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদি ক্ষমতা নেয়ার আগে আবদুল রহিম হাতিফ দুই সপ্তাহের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ সালে সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুজাদ্দেদি মাত্র দুই মাস টিকতে পেরেছিলেন। মুজাদ্দেদি আফগান সমাজে এক সম্মানিত পরিবারের সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন মুজাদ্দিদে আলফেসানি শায়েখ সারহিন্দের বংশধর। মুজাদ্দেদি ছিলেন কিছুটা সুফিপন্থী। সিবগাতুল্লাহ মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরিয়াহ ও ইসলামী আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি মিসর থেকে আফগানিস্তানে ফিরে এসে শিক্ষকতা করতে থাকেন। পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কসবাদ যখন আফগানিস্তানকে গ্রাস করছিল, তখন মুজাদ্দেদি এর প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে শুরু করেন; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে মুজাদ্দেদি তদানীন্তন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুসচেভের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ আনা হয় এবং কোনো বিচার ছাড়াই তাকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়। ১৯৬৪ সালে তাকে নামেমাত্র মুক্তি দেয়া হলেও সাথে সাথে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলো। মূল কথা হলো- তিনি আফগান জনগণকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছিলেন এবং নাস্তিক্যবাদী শিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন বিধায় মার্কসবাদীদের চক্ষুশূল হলেন।
২৮ এপ্রিল ১৯৯২ সালে সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুজাদ্দেদি মাত্র দুই মাস টিকতে পেরেছিলেন। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও তার দল ‘হেজবে ইসলামী’ সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদিকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। হেকমতিয়ার ছাড়াও বুরহানউদ্দিন রাব্বানি সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদিকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। পরিণতিতে মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৯৯২ সালের মে মাসে মুজাদ্দেদি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং রাব্বানি গঠিত নতুন কাউন্সিলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, হেকমতিয়ার আর বুরহানউদ্দিন রব্বানি কারা? কেনই বা তারা মুজাদ্দেদির নেতৃত্ব মানেননি? সেটি বুঝতে হলে রাব্বানি ও মুজাদ্দেদি দু’জন সম্পর্কেই জানতে হবে। সোজা কথা বলতে গেলে, সেই আকিদা ইস্যু। এ ইস্যুতে দু’জন ছিলেন দুই মেরুর। দু’জনই শিক্ষাগুরু, দু’জনই আল আজহার বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়েছেন। দু’জনই কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং দু’জনই সোভিয়েতবিরোধী আন্দোলন করেছেন। একজন ছিলেন দেওবন্দ সমর্থিত সুফিপন্থী, আরেকজন ছিলেন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী। বলাবাহুল্য, তালেবানও দেওবন্দপন্থী গ্রুপ।
বুরহানউদ্দিন রাব্বানি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি মিসর গিয়েছিলেন এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী দর্শনে মাস্টার্স ও পিএইচডি অর্জন করেন। কায়রো থাকাকালে রাব্বানি মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে পরিচিত হন এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বুরহানউদ্দিন রাব্বানিই প্রথম ব্রাদারহুড নেতা সাইয়েদ কুতুবের পুস্তক ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
রাব্বানি একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে দলের নাম ছিল ‘জমিয়তে ইসলামী’। এটি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী থেকে ভিন্ন। যদিও দর্শনের দিক থেকে জমিয়তে ইসলামী পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর কাছেই ছিল বলা যেতে পারে, তথাপি মাওলানা মওদুদীর সাথে রাব্বানির কোনো যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়নি। কিন্তু মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে যোগাযোগ ছিল।
জমিয়তে ইসলামী প্রাথমিকভাবে ছিল মুসলিম ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠন Sazman-i Jawanan-i Musulman (Organization of Muslim Youth)। যে সংগঠনের বেশির ভাগই ছিল জাতিগতভাবে তাজিক।
১৯৬৮ সালে রাব্বানি মিসর থেকে ফিরে এসে জমিয়তে ইসলামীর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। সে সময়ই সে সময়কার কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও আহমদ শাহ মাসুদ জমিয়তে ইসলামীর মাধ্যমেই রাব্বানির সাথে জড়িত হন।
পরবর্তীকালে রাব্বানি, হেকমতিয়ার ও মাসুদ এই তিনজনই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস হয়ে থাকেন। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় আহমদ শাহ মাসুদ নিহত হন। এই মাসুদেরই ছেলে হলেন বর্তমান পাঞ্জশির আন্দোলনের নেতা আহমেদ মাসুদ। কথিত আছে, ওসামা বিন লাদেন নিজেই আহমদ শাহ মাসুদকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে রাব্বানিও এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। রাব্বানির মৃত্যুর পর কারজাই সরকার তাকে ‘শান্তির শহীদ’ খেতাব উপাধি দেয়। রাব্বানি কারজাই সরকারের ‘সমর্থক’ ছিলেন।
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এখনো জীবিত আছেন। তিনিও ছিলেন আফগান কিংবদন্তি। ১৯৭০-এর দশকে তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুরহানউদ্দিন রাব্বানি ও আহমদ শাহ মাসুদসহ জমিয়তে ইসলামীর সাথে জড়িত ছিলেন এবং আন্দোলন করেছেন। পরে ১৯৭৫ সালের দিকে তিনি নিজে হেজবে ইসলামী নামে নিজস্ব দল গঠন করেন। ‘Our Men in Kabul’ বইয়ে দাবি করা হয় যে, সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও তার দল হেজবে ইসলামী সিআইএ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র Crowley, Michael (2010-03-09). "Our Man in Kabul?". The New Republic. ISSN 0028-6583. উইকিপিডিয়া) Peter Dale Scott, The Road to 9/11: Wealth, Empire and the Future of America (September 2007, ISBN 978-0-520-23773-5), p. 129, উইকিপিডিয়া)
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় সৌদি আরব থেকে বড় অঙ্কের সাহায্য পেয়েছিলেন। এমনকি ব্রিটেনের এম-১৬ থেকে বড় অঙ্কের সাহায্য পেয়েছিলেন, এমনকি তিনি মার্গারেট থ্যাচারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। (Sengupta, Kim (2010-07-30). Secret Affairs, By Mark Curtis. The Independent. London.)
পিটার বারগেন নামক আরেক লেখকের লেখা বই ‘হোলি ওয়্যার : ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব ওসামা বিন লাদেন’ বইতে বলা হয়েছে- হেকমতিয়ার সৌদি আরব থেকে বেশির ভাগ সাহায্য পেয়েছিলেন। সোভিয়েতের বিদায়ের পর ১৯৯২ সালের ‘জগাখিচুড়ি’ সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদি যখন প্রেসিডেন্ট, মুজাদ্দেদি তখন আহমদ শাহ মাসুদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা ডিফেন্স মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ দেন, সে সময় মাসুদ বাহিনী ও হেকমতিয়ার বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। দুই দিনের তুমুল যুদ্ধের পর ২৫ এপ্রিল মাসুদ বাহিনী হেকমতিয়ার বাহিনীকে কাবুল থেকে বের করে দেয়। ২৫ মে মাসুদের সাথে এক শান্তিচুক্তি হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে হেকমতিয়ারকে আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হলো। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই চুক্তি ভেঙে যায়। হেকমতিয়ারের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে, হেকমতিয়ার বাহিনী প্রেসিডেন্ট মুজাদ্দেদির বিমানে রকেট আক্রমণ করেছিলেন। পরদিনই আবার যুদ্ধ শুরু হয়; এ যুদ্ধ ছিল চারমুখী। এক দিকে রাব্বানি, অন্য দিকে মাসুদ বাহিনী, আরেক দিকে হেকমতিয়ার এবং আরেক দিকে আবদুর রশিদ দোস্তাম।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি তুর্কিস্তানের টিআরটি ওয়ার্ল্ডে হেকমতিয়ারের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা যাবে।
আহমদ শাহ মাসুদ ছিলেন আফগানিস্তানের এক রহস্যপুরুষ; যার একাধিক পরিচয় রয়েছে। এক দিকে আফগান মুজাহিদ নেতা, অন্য দিকে পাশ্চাত্যের বন্ধু। ছেলেবেলায় তিনি লেখাপড়া করেছিলেন কাবুলের বিখ্যাত ‘ফ্রেঞ্চ-আফগান লেসি ইস্তিকলাল’ স্কুলে। তার পর তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলেন। সে সময় তিনি বুরহানউদ্দিন রাব্বানির সাথে জমিয়তে ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
আমেরিকা ও ফ্রান্সের সাথে আহমদ শাহ মাসুদের খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মাসুদের মৃত্যুর পর তার ছেলে আহমদ মাসুদকে লালন পালন করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আহমদ মাসুদ ব্রিটেনে সামরিক অ্যাকাডেমিতে লেখাপড়া করেন। এ ব্যাপারে পরে তার সাম্প্রতিক পাঞ্জশির বিদ্রোহসহ আরো বিস্তারিত কিছু চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে।
মোদ্দাকথা, ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছিল প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ‘খেলার সময়’। এক দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে গেলে সোভিয়েতের অর্ধশতাব্দীর লাগানো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের গাছ, অন্য দিকে পাশ্চাত্যের নতুন করে চারাগাছ লাগানো। আমেরিকা ও ন্যাটো আফগানিস্তানে এসেছিল ২০০১ সালে, কিন্তু তারা চারা লাগাতে শুরু করেছে ১৯৯২ সালেরও আগে সোভিয়েত তাড়ানোর মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অফিসিয়ালি আফগানিস্তানে তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির চারা লাগাতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চারা লাগাতে শুরু করে পঞ্চাশের দশক থেকে আর আমেরিকা ও ইউরোপ চারা লাগাতে শুরু করে আশির দশক থেকে।
আজকের লেখার উপসংহার ও আগামী লেখার আগাম ভ‚মিকা হিসেবে দু’টি কথা বলছি। আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও ব্রিটিশ ও ফ্রান্স আফগানিস্তান ছাড়েনি। আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদকে ব্রিটেন ও আমেরিকা এত দিন লালন পালন করে এসেছে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য নয়। আল্লাহ চাহে তো হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মতো নিজেরা সরাসরি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়।
ফ্রান্স ও ব্রিটেন চায় আফগানিস্তানে আবার গৃহযুদ্ধ লাগুক। চায় মানে, তারা মনে মনে কামনা করে, এমনটি নয়। এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৪ মার্চ ফ্রান্সের প্রধানতম ইংলিশ টিভি চ্যানেল ফ্রান্স-২৪-এ আহমদ মাসুদের একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়েছিল এবং প্রচার করা হয়েছিল। যেখানে সরাসরি আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের উসকানি দেয়া হয়েছে উপস্থাপকের পক্ষ থেকে। উপস্থাপক দু’বার সরাসরি আহমেদ মাসুদকে বলেন, তারা পাঞ্জশির অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত কি না।
তবে ফ্রান্স বা ব্রিটেন কোনো কিছু মাগনা বা বিনা পয়সায় নেয় না। আহমেদ মাসুদকে ব্রিটেনে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ব্রিটিশরা। অন্য দিকে এ বছর মার্চেই প্যারিস সিটি কাউন্সিল আহমেদ মাসুদের বাবা আহমদ শাহ মাসুদের সম্মানে তার নামে প্যারিস সিটি কাউন্সিলে একটি সম্মাননা প্লেট করেন। তাদের জন্য দুঃখের সংবাদ হলো- তারা যেভাবে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, সেটি এখন পর্যন্ত লাগেনি এবং অনেকের জন্যই অনেকটা আশ্চর্যজনক যে, সারা বিশ্বের মানুষ, সারা বিশ্বের মিডিয়া তালেবানকে যেভাবে মনে করেছিল সে দৃষ্টিতে তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিল। এমন ধৈর্য, এমন ডিপ্লোম্যাসি অসাধারণ; স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন প্রথম আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় সে সময় ইন্টারনেট আজকের মতো এত সহজলভ্য ছিল না। আমরা তখন হোম ফোনে ডায়ালিং সিস্টেমের মাধ্যমে আমেরিকা অনলাইনের মাধ্যমে ইমেইলে মেসেজ পেতাম। ইমেইল সেটআপ করা থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজের ইমেইল আমরা পেতাম। সে সময় তালেবান সম্পর্কে এত সব খারাপ সংবাদ দেখেছিলাম যে, সে সময় এ সংবাদ দেখলেই তা ডিলিট করে দিয়েছিলাম। কারো ওপর রেগে গেলে ‘তালেবান’ বলে গালিও হয়তো দিয়েছিলাম, আমাদের কাছে তেমনভাবেই তালেবানের সংবাদ এসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তালেবান নেতাদের অনেকগুলো সাক্ষাৎকার দেখেছি, তার মধ্যে টিআর টি ওয়ার্ল্ডে আনাস হাক্কানির একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম, যা দেখে চোখে পানি এলো। এত সুন্দর কথা খুব কম মানুষ বলতে পারে। সে ব্যাপারে পরে বলব।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী,পশতুনদের জামাতা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা