২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে পথশিশুদের

-

শিশু অপরাধের শাস্তি কম এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাদের দিয়ে অপরাধ করানো সম্ভব হওয়ায় অপরাধীদের সহজ টার্গেট ছিন্নমূল বা পথশিশু। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় পেশাদার অপরাধীরা পথশিশুদের দিয়ে অপরাধ করিয়ে অনেকেই থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। এরা ‘সহজলভ্য’ হওয়ায় এসব শিশুকে অনেকসময় বিদেশেও পাচার করা হয়।

পরিবারবিচ্ছিন্ন এসব শিশুর বসবাস বাস, রেল ও লঞ্চ টার্মিনাল। দেখা যায় ফুটপাথ ও পার্কসহ খোলা জায়গাগুলোতেও। তাদের যাপিত জীবনের চিত্র প্রতিনিয়ত ইঙ্গিত করে এরা সমাজের ‘অবাঞ্ছিত’ নাগরিক। এদের না আছে পরিবার, না পায় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা।

চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে নিজেরাও হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। শুরু হয় ‘ড্যান্টি’ দিয়ে, এরপর হেরোইন, নেশার ইনজেকশন ও ট্যাবলেট। হাতের নাগালেই যেহেতু সব কিছু তাই সব কিছুতেই এদের আসক্তি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণা বলছে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোনো-না-কোনোভাবে মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি মাদকের স্পট আছে। এসব স্পটে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে থাকে।

পথশিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। স্বজনহারা শিশুরা শহরে এসে জীবন সংগ্রামে নামে। অচেনা শহরে খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করে দেয়। রাতে থাকে রাস্তা, সরকারি স্থাপনা কিংবা রেল স্টেশনে। অভিভাবকহীন এসব শিশু ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই, পিকেটিংসহ নানা অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে।

বিআইডিএস ও ইউনিসেফের এক গবেষণা বলছে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরে রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ঢাকায় মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই শিশুদের বেশির ভাগ পথশিশু। আর মাদকাসক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

অপর একটি গবেষণা জরিপ থেকে জানা গেছে, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ এবং ছিনতাই, নেশাদ্রব্য বিক্রয়কারী ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ শিশু।

প্রতিদিন রাজধানীতে অসংখ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব ছিনতাইয়ের কাজে যারা জড়িত, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৬ বছর। অনেকসময় চক্রটি অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। পথশিশুরা সংসারের ঘানি টানতে কিংবা মাদকের টাকা জোগাড় করতে রোজগারের সহজ পথ হিসেবে ছিনতাইকে বেছে নিচ্ছে।

মাদক সেবন এবং চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে পথশিশুরা। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তির অলিগলিতে পথশিশুদের মাদক সেবনের দৃশ্য চোখে পড়ে। সারা দিন কাগজ বা ভাঙ্গারির অন্য মালামাল কুড়িয়ে তা সংশ্লিষ্ট দোকানে বিক্রি করে উপার্জিত টাকা ব্যয় করে মাদক সেবনে। অন্য দিকে, একশ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করছে।

রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ সব বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে, পার্কসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মাদকাসক্ত পথশিশুদের দেখা যায়। তবে ঢাকার বাইরেও এরা সংখ্যায় কম নয়। দিন দিন সারা দেশে বাড়ছে এসব পথশিশু। সঙ্গে বাড়ছে অপরাধ এবং মাদক সেবনকারীর সংখ্যা।

পথশিশুদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার অভাব এবং দারিদ্র্য মূল ভ‚মিকা পালন করে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও সমানভাবে দায়ী। আমাদের দেশে এই পথশিশুরা নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। দিনে দিনে আরও অধিকসংখ্যক শিশু অপরাধ জগতে পা বাড়াচ্ছে। ছোটবেলায় পারিবারিক বন্ধনের মাঝে থেকে এই অপরাধ থেকে বেঁচে থাকতে পারলেও একটু বড় হওয়ার পর এই বন্ধন স্বভাবতই আলগা হয়ে পড়ে। যাদের পরিবারের বালাই নেই, তারা শুরু থেকেই নানা অপরাধমূলক কাজে সিদ্ধহস্ত হয়। ঠিক কত শতাংশ পথশিশু এই ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। এ ব্যাপারে যা আছে, তা ধারণা মাত্র। অপরাধের ধরন ভিন্ন হলেও গ্রাম কিংবা শহর, এই দুই জায়গাতে সমানভাবেই পথশিশুরা অপরাধে লিপ্ত। শহরে অপরাধের ধরনের জন্য পথশিশুরা খুবই আলোচিত। পথে-ঘাটে চুরি-ছিনতাই তো খুবই সাধারণ ব্যাপার।

পথশিশুদের দ্বারা ডাকাতি, অপহরণ, মাদক পাচার ইত্যাদি অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ককটেল কিংবা পেট্রলবোমা নিক্ষেপের কাজেও পথশিশুদের ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। চলন্ত বাস থেকে মোবাইল, ভ্যানিটি ব্যাগ, গয়না ইত্যাদি ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার কাজেও এদের দেখা গেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের পেছনে বিরাট কোনো চক্রের অস্তিত্ব থাকে। ফলে তারা এই ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে সাহস পায়। শুধু পথশিশুদের দোষ দিলে ভুল হবে। অবস্থাসম্পন্ন ভদ্রঘরের সন্তানদেরও এই ধরনের অসৎ কাজে লিপ্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের অপরাধ করার কারণটা একটু ভিন্ন। কেউ কেউ নিতান্তই আগ্রহ কিংবা কৌতূহল বশে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হলেও এদের মোটা অংশ মাদকের টাকা জোগাড় করতেই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর এই মাদকের সঙ্গে যে সম্পর্ক, এটা পথশিশু ও বড়লোকের ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগকেই অপরাধের দিকে ধাবিত করে।

এ সমস্যার সমাধানের উপায় দু’ভাবে করা সম্ভব। প্রথমত রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দানের পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন করা উচিত। পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত ফান্ড থাকা চাই। দ্বিতীয়ত সামাজিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। পরিবার ও সমাজের শিক্ষাটাই বড় ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু পথশিশুরা পারিবারিক শিক্ষা এবং সঠিক সামাজিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তাই এ ব্যাপারে বিভিন্ন এনজিওর এগিয়ে আসা উচিত। আমাদের দেশে পথশিশুদের অপরাধপ্রবণতা হ্রাসে একেবারে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে। এই সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। পথশিশুদের দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজের ‘ভলান্টিয়ারি’ করানো যেতে পারে। বিভিন্ন দাতব্য কাজে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। তাহলেই সমাজে ধীরে ধীরে শিশু অপরাধ কমে আসবে।


আরো সংবাদ



premium cement