২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য তুলে নেয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে

-

ব্যাংক সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়ার শর্তে ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষের কাছে থেকে আমানত সংগ্রহ করে। পরে সেই আমানতের অর্থ উদ্যোক্তা এবং অন্যদের কাছে অধিকতর উচ্চ সুদে ঋণ দিয়ে ব্যবসায় করে।

আমানতকারীদের ব্যাংক যে সুদ দেয় এবং ঋণগ্রহীতাদের থেকে যে হারে সুদ আদায় করে এ দুয়ের মধ্যে যে ব্যবধান সেটিই ব্যাংকের পরিচালনগত মুনাফা। দেশের প্রচলিত আইনে ট্যাক্স এবং অন্য সব ব্যয় মেটানোর পর পরিচালনগত মুনাফা থেকে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা-ই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা।

ব্যাংক কী পরিমাণ ঋণদান এবং সুদ আদায় করতে পারবে তা নির্ভর করে বিনিয়োগ চাহিদার ওপর। বিনিয়োগ চাহিদা কমে গেলে ব্যাংক গৃতীত আমানত নিয়ে সমস্যায় পড়ে। কারণ বিনিয়োগ না করতে পারলে ব্যাংক সুদ আদায় করতে পারে না। কিন্তু ব্যাংক আমানতের অর্থ বিনিয়োগ করতে পারুক আর নাই পারুক আমানতকারীকে ঠিকই সুদ দিতে হয়। তাই অবিনিয়োগকৃত অর্থ সবসময়ই ব্যাংকের জন্য ‘দায়’ হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে মারাত্মক সঙ্কটে রয়েছে।

ব্যাংকগুলো বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে বসে আছে; কিন্তু ঋণ গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে খুব কম। গত জুনের শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অলস অর্থ ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে বন্ড কেনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেকটি ট্রেডিশনাল ব্যাংকের মোট আমানতের ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ নগদে বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। আগে এটি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া স্ট্যাটুইটরি লিকুইডিটি রিজার্ভ (এসএলআর) হিসেবে বিভিন্ন বন্ড এবং অন্যান্য খাতে আরো ১৩ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাংক মোট আমানতের মধ্যে সাড়ে ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে না। অবশিষ্ট ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করা যায়।

ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য সিআরআর এবং এসএলআর এর হার কিছুটা কম। উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে কিছু দিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। একই সাথে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদ হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হয়। আগে ছিল ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ৬ শতাংশ হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল মূলত ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো তথা দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রম গতিশীল করতে; কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ানোর যায়নি। গত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও ঋণ প্রবাহ বাড়েনি। বর্তমানে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার ৬ শতাংশের পরিবর্তে গড়ে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আর ঋণের ওপর আরোপিত সুদের গড় হার ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার এবং ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্তটি আমাদের কাছে ভুল বলে মনে হয়েছে। কারণ মুক্তবাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত কোনো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে আমানত এবং ঋণের সুদ হারের ওপর হস্তক্ষেপ করে না। বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করেই আমানত ও ঋণের সুদ হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে সেখানে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দেখানো হয়েছে গতবারের মতোই ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এটা যে অর্জনযোগ্য নয় বলে অর্থনীতিবিদদের মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক ধরনের টার্গেট নির্ধারণ করা হয় ব্যর্থ হবে জেনেই। এই ব্যর্থতার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না।

ব্যাংক সেক্টরের বর্তমান অবস্থা এবং দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে সঙ্কটে রয়েছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা চাঙ্গা হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই।

করোনাকালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য এর আগে থেকেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে একধরনের গতিহীনতা বিরাজ করছিল। কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে অনেকই বলে থাকেন, দেশে বর্তমানে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে। দেশে কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদি) নেই। তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো। একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই ঠিকই; কিন্তু একধরনের অনিশ্চয়তা সব সময়ই বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারিরা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নানা আইনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে দেশে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু যারা বিদেশী বিনিয়োগকারী তারা তো তা করতে বাধ্য নন। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগ করার আগে সেখানকার বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা নিয়েই পুঁজি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্বব্যাংক প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে প্রতেবেদন প্রকাশ করে থাকে। ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ অথবা সহজে ব্যবসায় করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? ২০২০ প্রকাশিত বিশ^ব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসায় সহজীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮। অর্থাৎ ব্যবসায় সহজীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে উপরে রয়েছে ১৬৭টি দেশ। অন্য দিকে ব্যবসায় সহজীকরণের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ৬৩। ভিয়েতনামের অবস্থান ৭০, পাকিস্তানের ১০৮, ইন্দোনেশিয়ার ৭৩, ভুটানের ৮৯, নেপালের ৯৪ ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৯৯। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) নানাভাবে বিনিয়াগ পরিবেশ উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অর্জন নেই। বিডার একজন কর্মকর্তা বছর তিনেক আগে বলেছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ডাবল ডিজিটে নামিয়ে আনবেন। কিন্তু কিছু দিন আগে সেই তিনি স্বীকার করেছেন এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমন একটি অবস্থায় বাংলাদেশ চাইলেই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন তা আশা করা যায় না। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার উদ্যোগে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ আহরণের লক্ষ্যে ‘রোড শো’ করা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে যার শিরোনাম ছিল, ‘বিনিয়োগ কখনো ডাকিয়া আনা যায় না।’ এটিই বাস্তবতা। স্থানীয় বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না করে শুধু বিদেশীদের আহ্বান জানালেই তারা উদ্বৃত্ত পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রহী হবেন না।

বাংলাদেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা সব সময়ই পুঁজি সঙ্কটে থাকেন। তাই তারা ব্যাংক ঋণ পেতে সব সময়ই মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। ব্যাংক খাতে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত পুঁজি নিয়ে বসে আছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সুদ হারের চেয়ে কম সুদে ঋণ দিতে চাচ্ছে এর পরও উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা ঋণের জন্য আবেদন করছেন না। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের কেউ-ই নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। দেশের বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতিও বিনিয়োগের জন্য তেমন অনুক‚ল নয়। চার দিকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, পেশিশক্তির দাপট এসব দেখে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে, বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের যদি বিদেশী বিনিয়োগের সহজ সুযোগ দেয়া হতো তাহলে অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগের জন্য চলে যেতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, টাকা পাচারকারীদের বিদেশে বিনিয়োগের তথ্য থেকে। বর্তমানে বিনিয়োগ প্রতিক‚ল পরিবেশে ব্যাংক খাতে যে উদ্বৃত্ত তারল্যের সৃষ্টি হচ্ছে, অলস টাকার পাহাড় জমছে এই সমস্যা সহজে সমাধান হওয়ার নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি অনুধাবন করেই ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তরল অর্থ তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেহেতু বিনিয়োগের মাধ্যমে এ টাকা ব্যাংক থেকে বেরোনোর কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সাত দিন, ১৪ দিন এবং ৩০ দিন মেয়াদি বিল বিক্রি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ তুলে নেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকগুলোর কাছে বিল বিক্রি করে কী পরিমাণ টাকা তুলে নেবে তা এখনো ঠিক হয়নি। এমনকি এই বিলের সুদহার কত হবে তাও নির্ধারিত হয়নি। তবে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে পত্র দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

উল্লখ্য, ২০১৮ সালের মার্চে একবার বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাত থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ তুলে নিয়েছিল। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এটা সাময়িক ব্যবস্থা হলেও কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগে নিয়ে আসা ছাড়া এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement