২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভাইরাল মহামারী ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কোভিড

- ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট মহামারী সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়াও মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। বর্তমান মহামারীটিকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীকে বোঝা প্রয়োজন। কারণ স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার সাথে বর্তমান করোনাভাইরাসের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ভাইরাস দু’টিই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপিক, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরজীবী। দু’টি ভাইরাসই বংশবৃদ্ধি বা বেঁচে থাকার জন্য অন্য জীবিত কোষের ওপর নির্ভর করে। উভয় ভাইরাস প্রোটিন সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষাক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করে। কোভিডের স্পাইক প্রোটিন হোস্ট কোষে সহজে আক্রমণ করে। প্রাণী কোষে তার আরএনএ ঢুকিয়ে জিনোম প্রতিলিপি (র‌্যাপ্লিকেট) করতে হোস্ট সেলকে ব্যবহার করে। অন্য দিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কাজ করে তার উপরিতলে থাকা প্রোটিনের মধ্যকার কোলাবোরেশনে। উভয় ক্ষেত্রেই ৩০-৫০ শতাংশ ভাইরাল সংক্রমণ উপসর্গ তৈরি করে না।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় একই ধরনের উপসর্গ প্রকাশ করতে পারলেও দুই ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ধরনের হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে শেষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হলেও করোনা ক্ষেত্রে সাইটোকাইন স্টর্ম, রক্ত জমাট বাঁধা, হার্ট অ্যাটাকসহ নানাবিধ ঘটনা ঘটে। রোগের চূড়ান্ত পরিণতি ভাইরাসটির রোগাগ্রস্ত করার ক্ষমতা, মানুষের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষেত্রে একেকটি ভাইরাসের একেক ধরনের আক্রমণ প্রবণতা থাকে। যেমন করোনা ভাইরাসটি মূলত মানুষের ফুসফুস তথা শ্বাসতন্ত্রে, খাদ্যনালীতে, ব্লাড ভাস্কুলার সিস্টেমের এপিথেলিয়াল সেলের ওপর আঘাত হানে। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের এপিথেলিয়াল সেলেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সারসকভ২-এ দুটোই আরএনএ এনভেলপ থাকে বলে উভয় ভাইরাসই সাবান দিয়ে হাত ধুলে মরে যায়। এই দুই ভাইরাসই মানুষের কোষের ভেতর ঢুকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং ভাইরাসের আরএনএতে থাকা জেনেটিক কোড বা রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে ক্রমেই বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। আক্রান্ত হলে মানুষ ভাইরাসকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অ্যান্টিবডি তৈরি করে। প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) দিয়ে ক্রমেই বাধার মুখে পড়ে একসময় শক্তিশালী ভাইরাসও দুর্বল হয়ে যায়। বেঁচে থাকা বা বংশবৃদ্ধির জন্য ভাইরাসের জন্য যেহেতু বাহক প্রাণিকোষ লাগে সে ভাইরাসটিকে বাহককোষ থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে তা দুনিয়া থেকেও নির্মূল করা সম্ভব। এভাবেই টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে গুটিবসন্ত (স্মলপক্স) দুনিয়া থেকে নির্মূল করা গেছে।

মানুষের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা যায়; অর্থাৎ সংক্রমণ ওঠানামা করে এবং বছরে দু-একবার হানা দেয়। এরা যতটা দ্রæতগতিতে যত বেশি মানুষকে আক্রান্ত করে, তত এদের রূপান্তর হয়ে নতুন ধরন তৈরি করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা অথবা করোনা উভয় ভাইরাসই র‌্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়, তবে ইন্টেরফেরন কিছুটা কার্যকর। উভয় ভাইরাসের উপরিভাগে থাকা প্রোটিন অত্যন্ত অ্যান্টিজেনিক ও সংক্রমণশীল। উভয় ভাইরাসই এক্সরে, আল্ট্রাভায়োলেট রে ও গামা রে, ফরমালডিহাইড, ৭০-১০০ শতাংশ অ্যালকোহল এবং ইথারের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হয়ে যায়। করোনা বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তাদের ক্রমাগত জেনেটিক পরিবর্তন দু’টি ভিন্ন পথে হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসে পরিবর্তন হয় মিউটেশন আর ভ্যারিয়েন্টে রূপান্তর হয়ে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ক্রমাগতভাবে বারবার জেনেটিক মিউটেশনের কারণে পরিবর্তিত হতে থাকে। ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জার বছর বছর নতুন ভ্যাকসিন লাগে। অনেক সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন দেয়ার পরও আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লু হয়। তবে আক্রান্তের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়। বছর বছর যে নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন লাগে ভাইরাসের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য তার প্রধান কারণ। করোনাভাইরাসের মিউটেশনে খুবই সামান্য পরিবর্তন হয়। ফলে একই ঘটনা বারবার ঘটছে এবং ভবিষ্যতে এমনটি ঘটবে বলেই মনে হয়। ভাইরাসে অ্যান্টিজেনিক ড্রিফট বা শিফট দুটোর সম্ভাবনা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিজেনিক ড্রিফট হয়। যখন অ্যান্টিজেনিক শিফট জাতীয় মিউটেশন ভাইরাসে ঘটে তখন তার মহামারী (প্যান্ডেমিক) চরিত্রের কারণে বিশ্বব্যাপী ফ্লু আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে অ্যান্টিজেনিক শিফট জাতীয় পরিবর্তনের কারণে ১৯১৮ সালে বড় ধরনের মহামারীর পর গত ১০০ বছরে চারটি প্যান্ডেমিক ফ্লুর মতো ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু কোনোটাই আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ভ্যাকসিন প্রয়োগের কারণে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে উত্তর আমেরিকায় মানুষ ও পাখিদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সোয়াইন ফ্লু আকারে দেখা দিয়েছিল কিন্তু বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অন্য দিকে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ঘনঘন মিউটেশন হয়ে স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন হয়ে নানা ভ্যারিয়েন্টে রূপান্তরিত হয়।

এখানে কোনো অ্যান্টিজেনিক ড্রিফটিং বা শিফটিং জাতীয় কিছু ঘটে না। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে করোনাভাইরাসের শেষ পরিণতি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো হবে নাকি আলাদা কোনো দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে থেকে যাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জার এইচ১এন১ ভাইরাসের ঢেউয়ের সাথে করোনা ওয়েভের চরিত্রের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনা ছাড়াও প্লেগ, কুষ্ঠ, বসন্ত ও কলেরা নামের রোগগুলো মহামারীরূপে এর আগে অনেক জনপদ ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু ববোনিক প্লেগ মহামারীতে ১৩৫৩ সালের আগে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় মারা গিয়েছিল প্রায় ২০ কোটি মানুষ।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের দীর্ঘ পাঁচ শত বছরের ইতিহাস রয়েছে। ১৫০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গড়ে ৩৬ বছর পরপর সংঘটিত আন্তঃমহামারী ব্যবধানের ১৪টি মহামারী হয় ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে। ১৫৫৭ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী পুরো অটোমান সাম্রাজ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। অন্য দিকে ১৮৩০ ও ১৮৪০ সালেও দু’টি ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী আঘাত হেনেছিল। ১৮৮৯-৯২ সালের মধ্যে সংঘটিত এশিয়াটিক ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। এরপর ১৯১৮-২০ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর পর ১৯৫৭ সালে এশিয়ান সোয়াইন ফ্লু, ১৯৬৮-৬৯ সালে হংকং ইনফ্লুয়েঞ্জা, ১৯৭৭ সালে সোয়াইন অরিজিন ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডেমিক মানুষকে অনেক ভুগিয়েছে। ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এর ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা হয় ১৯৩৩ সালে এবং প্রতিষেধক হিসেবে টিকার আবিষ্কার হয় ১৯৪০ সালে। এর আগে পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক রোগটিকে মানুষ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ মনে করত। গত ৫০ বছরের ব্যবধানে বিজ্ঞানীরা আরো কিছু ভাইরাস আবিষ্কার করেছে। ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে বন্য ও গৃহপালিত পাখি, শূকর, ঘোড়া ও মানুষসহ প্রচুর সংখ্যক উষ্ণ রক্তের প্রাণী ভয়াবহ আকারে সংক্রমিত হয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হোস্ট পরিবর্তন, অ্যান্টিজেনিক রিফট ও অ্যান্টিজেনিক শিফটের মাধ্যমে শত শত বছর ধরে বারবার মহামারী আকারে ছড়িয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন নাশ করেছে। এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নভেল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আবির্ভাব। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি আরএনএ ইনফ্লুয়েঞ্জা এইচ১এন১ ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগ, যা এভিয়ান বংশোদ্ভূত।

ওই মহামারীতে দৃশ্যমান চারটি ভাইরাল ওয়েভ হয়। এটি পৃথিবীর দু-তৃতীয়াংশ মানুষকে আক্রান্ত করেছিল। এতে ৬০ লাখ আমেরিকানসহ পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯২০ সালের পর থেকে কোনো রকম টিকা গ্রহণ ছাড়াই শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পর এর ভয়াবহতা কমতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে সাধারণ ফ্লু আকারে রূপ নিয়ে বারবার চারটি বৈশ্বিক মহামারী উপহার দিয়ে বর্তমানে সাধারণ ফ্লুতে রূপান্তর হয়েছে। তার পরও বর্তমানে সারা পৃথিবীতে উপসর্গযুক্ত ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩-১১ শতাংশ। কিন্তু এর দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয় প্রতি মৌসুমে ৩০-৫০ লাখ এবং মারা যায় প্রায় আড়াই লাখ। তখনকার দিনে গর্ভবতী মহিলা আক্রান্ত হয়ে ছিল ২৩-২৭ শতাংশ। ২২ মে ১৯১৮ সালে মাদ্রিদের এবিসি সংবাদপত্রে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মহামারীটির সংবাদ। তখন থেকেই এটি স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভাইরোলজিস্টরা বিশ্বাস করেন ভাইরাসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সে উদ্ভূত হয়েছিল। ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ডাক পরিষেবা, টেলিগ্রাফ পরিষেবা ও কিছু ব্যাংকের মতো মৌলিক পরিষেবার কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।

১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে বেশির ভাগ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২৫-৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে। কিন্তু কোভিড-১৯ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের প্রভাবিত করছে, বিশেষ করে যারা কোমর্বিডিটিতে আক্রান্ত। স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারীতে সামগ্রিক মৃত্যুহার ছিল ২.৫ শতাংশ। ১৮-২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে যেখানে মৃত্যুহার ছিল ৮-১০ শতাংশ এবং ২৫-৪০ বছর বয়সীদের ছিল ৪০ শতাংশ। অথচ কোভিড-১৯ এর সামগ্রিক মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত ১.২ শতাংশ। বয়স অনুপাতে দেখালে তা হবে ০-১৭, ১৮-৪৪, ৪৫-৬৪, ৬৫-৭৪ এবং ৭৫+ বয়সীদের মধ্যে যথাক্রমে .০৬ শতাংশ, ৩.৯ শতাংশ, ২২.৪ শতাংশ, ২৪.৯ শতাংশ ও ৪৮.৭ শতাংশ। স্পেনিশ ফ্লুতে অনেক বেশি আক্রান্ত হলেও অনেক দেশই এর আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল কিন্তু কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেয়েছে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ সলোমান দ্বীপপুঞ্জ ও ভানুয়াতু। তখন সারা পৃথিবীর উপসর্গযুক্ত ও উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫-৪০ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ। কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্তের সংখ্যা ৭৫০ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র ২১ কোটির কিছু বেশি (২.৮১ শতাংশ)।

এই দুই ভাইরাসে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তের কারণে ব্যক্তিরা সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ায় মারা গেলেও কোভিড -১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিরা মূলত অতিরিক্ত সক্রিয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে মারা যান মাল্টিঅর্গান ফেইলিউরে (বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ অকার্যকর হওয়ার কারণে)। কোভিড-১৯ এর কারণে মাল্টিঅর্গান ফেইলিউরে মৃত্যুহার ৫৩ শতাংশ।

তখনকার দিনেও চিকিৎসার ধরন ছিল দ্রুত রোগ নির্ণয়, উপসর্গের সিম্পটমেটিক চিকিৎসা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন প্রভৃতি, এখনো তাই আছে। তবে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে এখন সেকেন্ডারি ইনফেকশনের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক থাকলেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউনিটি কমে যাওয়ায় কাজ করে না। তা ছাড়া এখন রেমডিসিভির, ইন্টারলিউকিন বা প্লাজমা থেরাপি, আইসিইউ ইত্যাদির মাধ্যমে বর্তমানে উপসর্গমুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা তখন ছিল না। রোগ প্রতিরোধকল্পে তখনকার একটি পরিচিত স্লোগান ছিল ‘হাঁচি-কাশি আর অধিক কথন, রোগ ছড়াবে যখন-তখন’। তখন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্কের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।

১৯২০ সালের ৩০ এপ্রিলে শেষ হলে মোট আড়াই বছরে ইনফ্লুয়েঞ্জার তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেশি ছিল। চতুর্থ ঢেউ বেশ লম্বা হলেও ভয়াবহতা কম ছিল। অন্য দিকে বর্তমান কোভিড-১৯ ভাইরাস ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর শনাক্ত হওয়ার পর বিশ্বের ২২০টি দেশ ও অঞ্চলে হানা দিয়ে কোথাও দ্বিতীয় ঢেউ এবং কোথাও তৃতীয় ঢেউ চলছে। এখানেও প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ও ভয়াবহতা বেশি। প্রতিটি ঢেউয়ের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুটোই পাওয়া যায়, তবে সাদৃশ্যই বেশি। দুই ক্ষেত্রেই রোগের সংক্রমণ ধরন, উপসর্গ প্রায় এক এবং উভয় রোগের প্রতিরোধের ধরনও এক। তবে সংক্রমণ সক্ষমতায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এগিয়ে। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি ব্যতিক্রম। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত একজন ৮-৯ জনকে আক্রান্ত করতে পারে। এটি উহানে আবিষ্কৃত অরিজিনাল করোনাভাইরাসের দু-তিন গুণ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন। কোভিড-১৯ রোগের ইনকিউব্যাশন পিরিয়ড এবং সংক্রমণ সময় বেশি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে মারাত্মক এবং ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগীরা ২০ দিন পর্যন্ত রোগ ছড়াতে পারে। কোভিডে কম বয়সীরা কম আক্রান্ত হয় কিন্তু তরুণ ও যুবকরা আক্রান্ত হলে মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রম ইন চিল্ড্রেন (এমআইএসসি) হয়ে মারা যেতে পারে। কোভিডে ব্লাডক্লট বা হার্টঅ্যাটাকের মতো ঘটনায় মৃত্যু হতে পারে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা তরুণদের চেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় দেখা গেছে পাঁচ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের উপরের লোকজন বেশি মারা যেত। কিন্তু ফ্লু দ্বারা আক্রান্ত হতেন বেশি ২০-৪০ বছর বয়সীরা এবং গর্ভবতী মায়েরা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করে মূলত ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি করে কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে তা অর্জন করে অ্যান্টিজেনিক রিফটিং ও অ্যান্টিজেনিক শিফটিংয়ের মাধ্যমে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় ৩৬-৪০ বছর পরপর, তখন মহামারী দেখা দেয়। মনে করা হচ্ছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতোই শতাব্দীতে দু-চারবার ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্টে রূপ নেয়ায় অনাগত বিশ্ববাসীকে করোনা মহামারীর মতো ভাইরাসের মোকাবেলা বারবার করতে হতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement