২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেশ কত দূর?

-

কারো মুখ দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনা বোঝা যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার চেহারা দেখেও দেশটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে ঢাকার সুনাম না থাকলেও দূষিত শহরের তালিকায় স্থান আছে। এই বদনাম কতকাল বইতে হবে, তা কারো জানা নেই। কিন্তু সরকার উদ্যোগী হলে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির মতো পরিচ্ছন্নতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর রাস্তা কত সুন্দর। কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়। সেখানে আমাদের দেশে রাস্তা একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখার আর ইচ্ছা হয় না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পোশাক কতটা মূল্যবান তা বড় কথা নয়! কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সবাই পছন্দ করে। অপরিচ্ছন্ন জীবন কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু আমাদের দেশে পরিষ্কার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। সবাই সুন্দর নির্মল পরিবেশে থাকতে চায়। অথচ যত্রতত্র ময়লা ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করে না বেশির ভাগ মানুষ।

বাংলাদেশের রাস্তায় মানুষ ও যানবাহন চলাচল করে। উন্নত বিশ্বের রাস্তায়ও মানুষ, যানবাহন চলাচল করে। অথচ সেসব দেশে ময়লা আবর্জনার ভাগাড় দেখা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে যা স্বাভাবিক। এর কারণ কী? কারণ একটাই আমাদের বদখাসলত। রাস্তা অপরিচ্ছন্ন হওয়ার পেছনে যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বদঅভ্যাস। আমরা সবাই যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত হই তাহলে কেবল অপরিচ্ছন্নতার অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

সব ধর্মই পরিচ্ছন্নতাকে উৎসাহিত করে। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ ভগবত গীতায় পরিচ্ছন্নতাকে একটি অন্যতম গুণ এবং খ্রিষ্টানদের বাইবেল ও বৌদ্ধধর্মে পরিচ্ছন্নতাকে আধ্যাত্মিক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে ঈমানে অঙ্গ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩)। অথচ আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ পথের ধারে অথবা ফুটপাথে প্রস্রাব করতেও লজ্জাবোধ করেন না। কোনো কোনো রাস্তার অবস্থা এতই করুণ যে দুর্গন্ধে হাঁটা পর্যন্ত যায় না। নাকে রুমাল চেপে কোনো মতে ওই স্থান অতিক্রম করতে হয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এরকম রাস্তার ধারে প্রস্রাব করার রীতি আছে কি না আমাদের জানা নেই।

আমাদের কারণে নগরীর পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মানদণ্ডে আমাদের দেশের অবস্থান হতাশাজনক। আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো করছি না। উল্টো যত্রতত্র থুতু ফেলছি। নাকে কোনো কিছু না দিয়ে হাঁচি দিচ্ছি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলছি। ডাস্টবিন খঁজছি না। বাদামের খোসা, কলার খোসা, বাসার ময়লা, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট, পানের পিক, পলিথিন ইত্যাদি রাস্তায় ফেলছি। এমনকি বাসার উপর থেকে ময়লা ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তার উপর ফেলে দিচ্ছি। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তা অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিন আছে। কিন্তু সময়মতো ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করা হয় না। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।

জাপানের নগরীগুলো পরিচ্ছন্ন হিসেবে পরিচিত। তাদের কোনো ডাস্টবিন কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। সেখানে যারা বেড়াতে যান তারা ডাস্টবিন না দেখে অবাক হন। জাপানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকার্যক্রমের মতো পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেয়। স্কুলগুলোতে ক্লিনিং রোস্টার চলে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা জাপানের জন্য কোনো বীরত্বের কাজ নয়, এটি তাদের স্বাভাবিক চর্চা।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জাপান সমর্থকরা স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। ঘটনাটি সে সময় ভাইরালও হয়েছিল। এ ছাড়াও আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মডেল। ১৯৬২ সালের ১ জানুয়ারি রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯৪ সালে জাতিগত দাঙ্গায় প্রায় ১০ লাখের উপরে মানুষের মৃত্যু হয়। এ কঠিন অবস্থা কাটিয়ে তারা এখন পরিচ্ছন্নতার নগরীতে পরিণত হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে কিগালি এখন ইউরোপ-আমেরিকার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সারা দেশের রাস্তা কিংবা ফুটপাথে আবর্জনা তো দূরের কথা ছোট কাগজের টুকরাও দেখা যায় না। গন্ধযুক্ত ময়লা-আবর্জনার কথা তো চিন্তাই করা যায় না। অথচ ১২ বছর আগেও আফ্রিকার অন্য শহরগুলোর মতো কিগালি অপরিষ্কার ছিল। আর এখন কিগালিকে বলা হয় আফ্রিকার সিঙ্গাপুর।

পরিচ্ছন্নতার উপকারিতা লিখে শেষ করা যাবে না। পরিচ্ছন্নতা স্বাস্থ্যবিধি চর্চার অন্যতম মূলনীতি। পরিচ্ছন্নতা শুধু অন্যের উপকার করে না, নিজেরও উপকার করে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব পড়ে। শরীরের জীবাণু সংক্রমণ রোধ করে এবং শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়। এ ছাড়াও পরিচ্ছন্নতা মনকে হালকা করে। মানসিক অবসাদ দূর করে। মানসিক প্রশান্তি বয়ে আনে।

নোংরা পরিবেশে যেখানে কাজ করতে দম বন্ধ হয়ে আসে সেখানে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কাজ করতে উৎসাহ জাগে। পরিচ্ছন্নতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ব্যতীত উন্নত ও রুচিশীল দেশ আশা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বত্র অপরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে সামাজিক জনমত গড়ে তোলা। পাশাপাশি স্কুল কলেজ মাদরাসার পাঠ্যপুস্তকে পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক বিশেষ কোর্স চালু করা। বিশ্বের যেসব দেশ পরিচ্ছন্নতার রোল মডেল হিসেবে পরিচিত সেসব দেশ কিভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছে তা কেস স্টাডির মাধ্যমে চিহ্নিত করে সেভাবে আমাদের প্রস্তুত করতে পারলে পরিচ্ছন্ন দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement