শিল্প-সাহিত্য এবং রাজনীতি
- ফ্লোরা সরকার
- ১৬ আগস্ট ২০২১, ১৪:১৭
শিল্প-সাহিত্যে রাজনৈতিক সিনেমা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকর্ম ইত্যাদি নির্মাণ এবং লেখা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। কোনো লেখা পাঠককে যত না রাজনীতি সচেতন করে তোলে, তার থেকে আরো বেশি এবং সহজে সচেতন করে তোলে শিল্পকর্মের মাধ্যমে।
রাজনীতি বলতে এখানে কোনো বিশেষ দলের সমালোচনা বা কটাক্ষ করাকে বোঝানো হচ্ছে না। যে রাজনীতি মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনে, মানুষের ক্ষতি করে, মানুষের জীবন জটিল করে তোলে তা বোঝানো হয়েছে। শিল্পের কাজ সত্য ও সুন্দর সৃষ্টি করা। সত্য অসুন্দর হলেও, সৃষ্টির পর সেটা সুন্দর হতে বাধ্য। কারণ যা বাস্তব সেটাই সত্য। সত্য বা বাস্তবটাই মানুষ দেখতে ও পড়তে পছন্দ করে। বাস্তব থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। শুধু বাস্তবতাই না,
বাস্তব ও বাস্তবতীর্ণ বিষয়গুলো আর্টফর্মে তুলে ধরাও শিল্পের কাজ।
বিষয়টা উৎপল দত্ত তার 'গদ্য সংগ্রহ'-এর প্রথম খণ্ডে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। দত্ত বাবু লিখেছেন, 'গোর্কি ও ব্রেখট দুজনেই বলে গেছেন, শুধু যা ঘটছে সেটাই দেখাব না। যা ভবিষ্যতে ঘটবে, যা ঘটা উচিত তাও আমরা দেখাব। সন্ত্রাসের সময়ে কৃষক পড়ে মার খাচ্ছিল শুধু সেটাই সত্য, আর অদূর ভবিষ্যতে সে যে বিদ্রোহ করবেই- এই অনিবার্য ইতিহাসটা সত্য নয়?' অর্থাৎ বাস্তবেরও নানাদিক আছে। সেসব দিক তুলে ধরাও শিল্পের কাজ।এখানেই শিল্পের মাহাত্ম। প্রাচীন গ্রিক নাটকে, বিভিন্ন দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে নাটকের চরিত্রদের সোচ্চার হতে দেখা যায়। আসলে দেব-দেবী নয়, শক্তিশালী বা ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে শক্তিহীন বা ক্ষমতাহীনের লড়াই। এই লড়াইয়ের নামই রাজনীতি। আর এসবই প্রধানত রাজনৈতিক সিনেমা বা গল্পে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু এসব বাদ দিয়ে খোদ বাস্তবের রাজনীতি যখন শিল্পের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে, তখন দুটিরই বিলয় বা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ শিল্পের ভেতর রাজনীতি নিয়ে না এনে, রাজনীতিই সরাসরি শিল্পের অন্দরমহলে প্রবেশ করে গেলে, বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন শিল্প বা রাজনীতি দুটির কার্যকারিতাই নষ্ট হয়ে যায়।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক সিনেমা বা গল্প দূরে থাক, ভালো সামাজিক বা পারিবারিক নাটক বা উপন্যাসও আমরা পাই না। পেলেও সেটা যৎসামান্য। বেশির ভাগ সিনেমা, নাটক বা গল্প প্রধানত প্রেমনির্ভর। তাও প্রকৃতিপ্রেম বা মানবিক প্রেম নয়, দুটি উঠতি বয়সী বালক-বালিকার বালখিল্য প্রেমের চিত্র বেশির ভাগ সিনেমা বা নাটকে আঁকা হয়ে থাকে। তবু আমাদের দেশের সাধারণ দর্শকদের, প্রেমের প্রতি প্রীতির থাকার কারণে এসব সিনেমা বা নাটকের ভালো কাটতি হয়। সেই হিসাবে এসব বালখিল্য সিনেমা বা নাটক নির্মাণ দোষের কিছু নয়। কারণ দর্শক চাহিদা প্রচুর। কিন্তু এই শিল্প যখন রাজনীতির নোংরা কাদায় জড়িয়ে যায়, তখন তার ভবিষ্যত আরও বেশি সংকটাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আমাদের এখানে বিগত নব্বইয়ের দশক থেকেই সিনেমা শিল্পের ধস শুরু হয়েছে। নাটক- উপন্যাসেও ভালো নির্মাতা বা লেখকের দেখা পাওয়া বিরল। এইরকম অবস্থায় যেখানে এই শিল্পকে রক্ষা করা, পরিচর্চা করা সবার দায়িত্ব, সেই অবস্থায় এখানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এই শিল্পকে একেবারে বিলীন করে দেয়ার এক অপচেষ্টা নতুন করে শুরু হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিল্পীদের ওপর মামলা-মোকদ্দমার বিষয়টা এই শিল্পকে আরো জটিল করে তুলছে। শিল্পীদের সমালোচনা, দুর্নাম এক কথায় গসিপ এক চিরন্তন বিষয়। বিষয়টা সবসময়ই ছিল এবং থাকবে। কিন্তু গসিপ যখন রাজনীতি হয়ে যায়, বিপদটা তখনই নেমে আসে। অতীতে রাজনীতি কখনো শিল্প অর্থাৎ প্রধানত সিনেমা শিল্পকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। যে কারণে এই শিল্প তার জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল।
কিন্তু শিল্পাঙ্গনে, রাজনীতি যদি শিল্পকে অতিক্রম করে প্রধান হর্তাকর্তা হয়ে ওঠে, তখন গল্প, উপন্যাস বা সিনেমা কোনোটাই আর ঠিকভাবে নির্মাণ করা যাবে না। গল্প বা নাটকে রাজনীতির প্রয়োজন থাকলেও, রাজনীতির ভেতরে গল্প বা নাটকের কোনো প্রয়োজন বা কাজ নেই।
রাজনীতির ভেতরে শিল্পের প্রবেশ ঘটে গেলে, এখন যেমন বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য, রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদির জন্যে বিদেশনির্ভর হয়ে থাকতে হয়, শিল্পের ক্ষেত্রেও, বিদেশী নাটক-সিনেমার ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে। কাজেই আমরা যদি এখনই আমাদের শিল্গাঙ্গনকে রাজনীতি মুক্ত করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে এই শিল্পের ইতি ঘটতে বাধ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা