২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গরু নিয়ে রাজনীতি

গরু নিয়ে রাজনীতি - ছবি : সংগৃহীত

মেঘালয় সরকারের বিজেপির মন্ত্রী সানবোর সুল্লাই সম্প্রতি গরু নিয়ে এমন এক বক্তব্য দিয়েছেন, তা যদি অন্য কেউ দিত, তাহলে এখন তো ভারতজুড়ে হইচই শুরু হয়ে যেত। সুল্লাই তার রাজ্যের লোকদের মুরগি, পাঁঠা, খাসি, ভেড়ার গোশত বা মাছের চেয়ে গরুর গোশত বেশি করে খেতে বলেছেন। গত ৩০ জুলাই ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণকারী শীর্ষ বিজেপি নেতা সুল্লাই বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি ব্যক্তি তার পছন্দের খাওয়ার ব্যাপারে মুক্ত-স্বাধীন।’ তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘আমি লোকদের মুরগি, ভেড়া, পাঁঠা, খাসির গোশত বা মাছ খাওয়ার পরিবর্তে গোমাংস বেশি করে খেতে উদ্বুদ্ধ করছি। যাতে করে এ ধারণা দূর হয়ে যায় যে, বিজেপি গোহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।’ রাজ্যের প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সুল্লাই এ নিশ্চয়তাও দিয়েছেন যে, তিনি প্রতিবেশী রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। যাতে সেখানে আরোপিত নতুন আইনে মেঘালয়ে পশু সরবরাহে কোনো প্রভাব না পড়ে।

এ কথা সবাই জানেন, গরু ভারতে এমন এক নির্যাতিত মজলুম প্রাণী, যাকে নিয়ে সর্বদা রাজনীতি চলতে থাকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, উত্তর ভারতের অধিবাসীরা গরুকে এক ‘পবিত্র প্রাণী’ হিসেবে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং তাকে ‘মা’-এর সমকক্ষ মনে করে থাকে। আমরাও স্বদেশী ভাইদের এই আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। মোগল সম্রাট বাবর, হুমায়ুনকে এই অসিয়ত করেছিলেন যে, তিনি যেন গরু সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কেননা, সেটি হিন্দুদের কাছে ‘পবিত্র’ পূজনীয়। কিন্তু যখন থেকে গরুর বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেছে, তখন থেকে পরিস্থিতি বেশ অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে কেন্দ্রে বিজেপির শাসনক্ষমতা গ্রহণের পর গরু ভারতে রাজনীতির মেরুদণ্ডে রূপ নিয়েছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গরু সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং গরু জবাইকারীদের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকাশ থাকে যে, সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে মহারাষ্ট্রে গোহত্যার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি দীর্ঘ দিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের জন্য তার টেবিলে পড়ে ছিল। প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি তাতে স্বাক্ষর করেন। আর এভাবে দেশের কয়েকটি রাজ্যে গোহত্যার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন কার্যে পরিণত হয়। এরপর গো সংরক্ষণের জন্য সরকারি খরচে বিভিন্ন স্থানে গোশালা (গোয়াল ঘর) বানানো হয়। এ পর্যন্ত তো ঠিক আছে। তবে গোরক্ষার নামে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতাও বেড়ে গেছে। আর নামসর্বস্ব গোরক্ষকরা এখন পর্যন্ত গোহত্যার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বহু মুসলমানকে বেশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে গুজবের বাজার এ পরিমাণ গরম ছিল যে, পশুর ব্যাপারি ও গোশত ব্যবসায়ীর বেঁচে থাকা কঠিন করে দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আপনাআপনি গড়ে ওঠা ‘গোরক্ষকদের’ সন্ত্রাস আজো অব্যাহত আছে। আর তারা যত্রতত্র মুসলমানদের বর্বরোচিত গণপিটুনি চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনাগুলো এই পরিমাণে বেড়ে গেছে যে, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অস্থিরতা প্রকাশ করেছে। আর মানবাধিকারের কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এ ব্যাপারে লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে।

আমরা তো এটাই মনে করি যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে বিজেপির গরুর প্রতি আবেগঘন বিশ্বাস রয়েছে। আর তারা এ ব্যাপারে বেশ কঠোর। কিন্তু এই বিজেপিই উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতে যখন বেশি পরিমাণে গোমাংস খাওয়ার আহ্বান করে, তখন বাস্তব পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে সামনে আসে। এর একেবারে তাজা প্রমাণ মেঘালয়ে বিজেপি মন্ত্রীর বক্তব্য। যিনি প্রকাশ্যে তার রাজ্যের অধিবাসীদের গোমাংস বেশি পরিমাণে খাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মেঘালয়ের প্রাণিসম্পদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী সানবোর সুল্লাই শিলংয়ে প্রকাশ্যে রাজ্যের বাসিন্দাদের মুরগি, মাটন ও মাছের চেয়ে বেশি করে গোমাংস খাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। সুল্লাই জুলাই মাসের শেষের দিকেই মেঘালয়ে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

সুল্লাইয়ের এই বক্তব্যের পর আমরা দৃঢ় আশাবাদী ছিলাম যে, বিজেপি শুধু তাকে কড়া ধমকই দেবে না, বরং তাকে প্রাদেশিক ক্যাবিনেট থেকেও বহিষ্কার করবে। কিন্তু এই মারাত্মক আপত্তিকর ও ধর্মীয় আবেগে আঘাতকারী বক্তব্যের কয়েক দিন পার হওয়া সত্ত্বেও বিজেপির কোনো নেতার কোনো প্রতিক্রিয়া দৃশ্যপটে আসেনি। তাদের সবাই খরগোশের ঘুম ঘুমাচ্ছে। এমনকি সঙ্ঘ পরিবারের সেই বীর সন্তানরা, যারা গরু আনা-নেয়ার ঘটনাতেই সীমা ছাড়িয়ে যায়, তারাও সুল্লাইয়ের মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্যে কোনো হাঙ্গামা হইচই তো দূরের কথা, সামান্য উহ্ পর্যন্ত করেনি। গণমাধ্যমগুলো অবশ্য এই বক্তব্যকে বিতর্কিত অভিহিত করেছে। কিন্তু বিজেপি এতটুকুও বলেনি যে, সুল্লাইয়ের এমন বিতর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত। এখানে বিষয়টি যেহেতু, ক্ষমতা ও ভোটের, এ কারণে সুল্লাইয়ের বক্তব্যকে তারা সানন্দেই মেনে নিয়েছে এবং সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে।

এখানে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতে গোহত্যার ইস্যুটা মুসলমানদের হয়রানি করার জন্যই কি দাঁড় করানো হয়েছে? এই ইস্যুতে মুসলমানদের হত্যা করা ও তাদের প্রতি নানারকম নির্যাতন করা সঙ্ঘ পরিবারের এজেন্ডার অংশ অনুমিত হয়। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এর সূচনা হয়েছে। আপনাদের মনে থাকার কথা, ২০১৫ সালে কোরবানির সময় এই ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে রাজধানী দিল্লি­-লাগোয়া উত্তর প্রদেশের দাদরি এলাকায়। সেখানে মুহাম্মদ আখলাক নামে এক ব্যক্তিকে তার ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার মিথ্যা অভিযোগে সীমাহীন বর্বরতা ও পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর দেশের কয়েকটি রাজ্যে গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে মুসলমানদের বেধড়ক গণপিটুনি দেয়া হয়। সরকারের অসদুদ্দেশ্য এ কথাতেই পরিমাপ করা যায় যে, ওই সব বর্বরোচিত ঘটনায় জড়িত হিংস্র পশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে তাদের সাহস জোগানো হয়েছে। ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জৈন্ত সিনহা গণপিটুনির অভিযুক্তদের রীতিমতো মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানান। এরপর ইউপি, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও হরিয়ানায় গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে বহু মুসলমানের জীবন ছিনিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু সরকারের কান জনগণের আহাজারি শোনে না।

কিছুকাল আগে বিখ্যাত দলিত পণ্ডিত ও ‘দলিত ভয়েস’-এর সম্পাদক ভি টি রাজ শেখর ‘ভারতে গরুর রাজনীতি’ শিরোনামে ইংরেজিতে এক বিস্তারিত প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার উর্দু অনুবাদ একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তিকাকারে আমাদের কাছে রয়েছে। ওই পুস্তিকার ৯ নং পৃষ্ঠায় তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিকের (‘আউট লুক’; ২০ এপ্রিল, ২০১৪) উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘১৯৬০ সালে ভারত সরকার গরু জবাইয়ের ওপর বিচারপতি এ কে সরকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করেছিল। আরএসএসের নেতা গোলওয়ালকার, পুরির শঙ্কর আচার্য ও ড. ভার্গিস কুরিন এই কমিটিতে যুক্ত ছিলেন। কমিটিতে গোলওয়ালকারের সাথে মৌলিক যুক্তিতে তর্কবিতর্ক হয়। ভার্গিস কুরিনকে যৌক্তিক প্রমাণাদিতে আশ্বস্ত করতে না পেরে গোলওয়ালকার স্বীকার করেছিলেন, গরু জবাই নিয়ে ইস্যু তৈরিকরণ শুধুই রাজনীতি।’ অর্থাৎ ধর্মের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৮ আগস্ট, ২০২১-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement