মাদকাসক্তি : ধর্ম ও বিজ্ঞানের আলোকে
- অধ্যাপক কর্নেল (অব:) ডা: জেহাদ খান
- ১৭ জুলাই ২০২১, ২০:৩১
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান দিয়ে বিষয়টির অবতারণা করতে চাই। সেখানে প্রতি বছর ৯৫ সহস্রাধিক মানুষ মাদকজনিত রোগে মারা যায়; অর্থাৎ প্রতিদিন মারা যায় প্রায় ২৬১ জন। এসব মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। শুধু ২০১৫ সালে মাদকজনিত কারণে ১০ হাজার ২৫৬ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। ২০১৯ সালে এক কোটি ৪৫ লাখ লোক মাদকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। কাজে মনোযোগহীনতা, শিশু ও নারী নির্যাতন, বিয়েবিচ্ছেদ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে মাদকের ভ‚মিকা রয়েছে। ওই দেশে মাদকজনিত ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ২৪৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে প্রায় তিন লাখ লোক প্রতি বছর মাদকজনিত রোগে মারা যায়। মাদকের কারণে লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সার, মুখে ও গলায় ক্যান্সার, সংক্রামক রোগ, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগ হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সন্ত্রাস, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত শারীরিক ক্ষতি বিশেষ করে আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, ফৌজদারি অপরাধ, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণ ও এইচআইভি বা এইডস ইত্যাদির সাথে মাদকাসক্তি জড়িত।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে মাদকাসক্তি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। সেখানে প্রতি তিনজনের একজন মদ্যপান করে থাকে এবং ১০ শতাংশ মাদকাসক্ত। ভারতে সড়ক দুর্ঘটনার সাথে মাদকাসক্তির সম্পর্ক প্রায় ৩৩ শতাংশ। মাদকজনিত রোগে ২০-৩০ শতাংশ লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও মাদকদ্রব্যকে কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না? এর উত্তর জানতে গেলে আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতা পেছনের দিকে উল্টাতে হবে। ১৯২০-৩৩ প্রায় ১৪ বছর সেখানে মাদকদ্রব্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ সময় প্রচার-প্রপাগান্ডা করে ও আইন প্রণয়ন করে বিভিন্ন রকম শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু মদের কারখানা বন্ধ থাকলে কী হবে, ঘরেই মানুষ বিষাক্ত মদ বানানো শুরু করে দেয়। মদ বন্ধ করার চেষ্টা অবশেষে ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং আবার আইন করে মদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতের গুজরাট প্রদেশেও একই কর্মসূচি সফল হতে পারেনি। এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যর্থতার কারণ কী? যেকোনো অপরাধ যেমন- মদ বা ঘুষ খাওয়া, চুরি, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ প্রভৃতি সমাজ থেকে দূর করতে হলে তিনটি উপাদানের সমন্বয় দরকার- ১. নৈতিক শিক্ষা; ২. আইনের প্রয়োগ; ৩. অপরাধের উপকরণের সহজলভ্যতা দূরীকরণ। যেমন- যদি সমাজে সহজেই মদ কিনতে পাওয়া যায়, তা হলে তার সেবনও বেড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণটি শক্তভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু নৈতিক শিক্ষার অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাজেই নৈতিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মগ্রন্থকেই নৈতিক শিক্ষার অন্যতম উৎস মনে করে থাকে। তা হলে দেখা যাক, মাদকদ্রব্যের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ কী নৈতিক শিক্ষা দেয়-
খ্রিষ্টান ধর্ম : মদের ওপর বাইবেলে কমপক্ষে ১০০টি শ্লোক রয়েছে, তার কোনোটি মদ খাওয়ার পক্ষে আবার কোনোটি বিপক্ষে। যেমন- ‘শুধু পানি খেলে হবে না, পেটের জন্য কিছুটা মদ ব্যবহার করো এবং ঘন ঘন রোগের জন্য।’ (তিমথি-৫:২৩)
মদের একজন খ্রিষ্টান অনুরাগী বাইবেলে মদের পক্ষে অন্তত ১০টি শ্লোক পেয়েছেন। জার্মানিতে একবার আমি একটি গির্জা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম প্রধান ধর্মযাজক কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে গির্জায় বসে মদপান করছেন। এক কথায়, মাদকসেবন বন্ধের জন্য যে নৈতিক প্রেরণা প্রয়োজন তা বাইবেল থেকে পাওয়া কঠিন।
ইহুদি ধর্ম : তাদের ধর্মগ্রন্থে মদের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করা হয়েছে, আবার বিপরীত কথাও উল্লেখ আছে। যেমন- ‘মদ মানুষের হৃদয়কে প্রফুল্ল করে’। (সালম-১০৪:১৫) তাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ‘নুহ আ: নিজে ও হারুন আ:-এর ছেলেরা (প্রধান ধর্মযাজক) মাতাল হয়েছিলেন।’ (জেনেসিস ৯:২০-৫ ও লেভেটিকাস-১০:১) (নাউজুবিল্লাহ)। ইহুদি ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান যেমন- পাসওভার, হাভদালাহ, কিদ্দুশ ইত্যাদিতে মদ হচ্ছে অন্যতম উপাদান।
বৌদ্ধ ধর্ম : গৌতম বৌদ্ধ এক ফোঁটাও মদপান করতে নিষেধ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের কিছু শাখার মতে, পরিমিত মদপানে কোনো সমস্যা নেই। গৌতম বৌদ্ধ যুবক বয়সে মদপান করেছেন এবং কঠোর তপস্যার সময় মদপানে বিরত থেকেছেন। এরই ভিত্তিতে সম্ভবত তিব্বত ও ভারতের অনেক মঠে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিয়মিত মদপান করে থাকে।
হিন্দু ধর্ম : ঋকবেদে মদপানকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এর সূত্রগুলোতে (বেদের ব্যাখ্যা) বলা হয়েছে, ক্ষত্রিয়রা ফল ও ফুল থেকে তৈরি মদ খেতে পারে। মনুস্মৃতি অনুযায়ী মদ নিষিদ্ধ নয়, তবে ব্রাহ্মণদের জন্য তা অপবিত্র। ক্ষত্রিয়, শূদ্র ও নাবিকদের মদ খেতে কোনো অসুবিধা নেই। দেব-দেবী, রাজা-রানী মদপান করছে এরকম অনেক ঘটনা তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে উল্লেখ আছে।
এ আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর জন্য মদ বন্ধ করার নৈতিক শিক্ষা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া কঠিন। এবার আমরা দেখব, ইসলাম এ বিষয়ে কী বলেছে। ইসলাম মানবজীবনের যেকোনো সমস্যারই অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দেয়। মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জাহেলি যুগে মানুষ হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, জুয়া, ব্যভিচার, মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া, অকারণে যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল। ঘরে ঘরে মদপান চলত। এসব অপরাধের সমাধানের সাথে সাথে মাদকাসক্তির এমন সুন্দর সমাধান ইসলাম করেছে যে, আজো বেশির ভাগ মুসলিম দেশে মাদকদ্রব্য বড় কোনো সমস্যা নয়।
মাদকদ্রব্যের ব্যাপারে কুরআন নৈতিক শিক্ষার ওপর খুবই গুরুত্বারোপ করেছে। এ ব্যাপারে এর শিক্ষা খুবই স্পষ্ট, কোনো রকম সংশয় বা বাদানুবাদের অবকাশ নেই, যা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে রয়েছে। কুরআন মাদকাসক্তির বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাও করেছে; অর্থাৎ মাদকাসক্তিকে ক্রমেই সমাজ থেকে দূর করেছে। যদি একজন মাদকাসক্তকে হঠাৎ করে মদ খাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়, তা হলে তার Delirium Tremens-সহ নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কুরআন এ ব্যাপারে কিছুটা ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করেছে।
‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এ দুটোতে রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ (আল কুরআন-২:২১৯)
মদের ব্যাপারে নাজিলকৃত প্রথম এসব আয়াতে মদ সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি, নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যাদের নৈতিক প্রশিক্ষণ শক্ত ছিল তাদের জন্য এসব আয়াতই যথেষ্ট ছিল। তারা মদ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। বাকিদের জন্য আরো কঠোর আদেশের প্রয়োজন ছিল। একসময় কোনো কোনো বিজ্ঞানী পুলকিত হয়েছিলেন যে, লাল মদের মধ্যে হৃদরোগের ক্ষেত্রে কিছুটা উপকারিতা পাওয়া গেছে। অথচ এরকম কিছু উপকারিতার কথা ১৪০০ বছর আগে কুরআন আমাদেরকে জানিয়েছে। অধুনা এক গবেষণায় দেখা যায়, সামান্যতম মদপানও মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। যাই হোক, পরবর্তী ধাপে কুরআন কঠিনতর বিধান জারি করল-
‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পারো যা তোমরা বলো।’ (আল কুরআন-৪:৪৩)
রাসূল সা: তাঁর সাহাবিদের এমন নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যে, যখনই কুরআনের কোনো নির্দেশ আসত, তারা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতেন। উপরের নির্দেশে মদ খাওয়ার সময়সীমা অনেক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল।
পরবর্তীতে মদের ব্যাপারে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা, বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরগুলো তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (আল কুরআন-৫:৯৩)
এরকম একটি কঠিন আদেশ আসার পর তৎকালীন সমাজের মানুষের নৈতিক মান দেখুন। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, যে দিন মদ হারাম ঘোষিত হলো, আবু তালহার ঘরে আমি, আবু উবায়দা বিন জাররা, আবু তালহা, উবাই বিন কাব প্রমুখকে মদ পরিবেশন করছিলাম। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো, ‘এখন থেকে মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে’। তখন আবু তালহার নির্দেশে ওই সব মটকা ফেলে দেয়া হলো। আনাস রা: বলেন, সে দিন মদিনার অলিতে গলিতে মদের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। (সহিহ মুসলিম, কিতাবুল আশরিবা) উপরের হাদিসগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাসূল সা:-এর বড় বড় সাহাবিরাও মদপানে অভ্যস্ত ছিলেন। তা হলে সাধারণ মানুষের মদের প্রতি যে কী রকম আসক্তি ছিল, তা বলাবাহুল্য। কুরআন তাদেরকে এমন নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে যে, তাদের মধ্যে কেউ সাইয়েদুস শুহাদা (শহীদদের সরদার) হয়েছেন, আশারুল মুবাশশারাহ (জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন) হয়েছেন। এই হচ্ছে মাদকাসক্তির পর্যায়ক্রমিক কুরআনিক চিকিৎসা।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা