একটি বই ও সত্যের অপলাপ-৩
- মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা
- ০৬ জুলাই ২০২১, ২০:২৭
বিতর্কিত ডা: কালীদাস বৈদ্যের লেখা বইটির ১১১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে গঠিত হলো ‘জাতীয় গণমুক্তি দল’-একটি অ-সাম্প্রদায়িক জাতীয় রাজনৈতিক দল।... লাহোর প্রস্তাবে ভারতের দুই অঞ্চলে দুটো সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল। গণমুক্তি দল সেই লাহোর প্রস্তাবকে জনগণের সামনে তুলে ধরল।... কিন্তু আলাদা রাষ্ট্রের কথা বললেই, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হতে হবে। তাই বাইরে স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার প্রস্তুতি চলতে থাকে। নতুন এই গণমুক্তি দলের আমি হলাম প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার হলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বিশিষ্ট সমাজসেবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী গান্ধীবাদী নেতা শ্রী মুনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য হলেন সভাপতি এবং অ্যাডভোকেট শ্রী মলয় রায় হলেন প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক।... গণমুক্তি দলের ঘোষণাপত্রে স্বায়ত্তশাসনের দাবির আড়ালে স্বাধীন পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্র গঠনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।” ১০৭ পৃষ্ঠায়, ‘এভাবে বাইরে ৬ দফা দাবির কথা বললেও ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপের কাজ চালিয়ে গিয়েছি।’ ১৪৩ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘তারা (পাকিস্তানিরা) ভালোভাবেই জানত যে, সব হিন্দুই পাকিস্তানকে ভাঙতে চায়। কিন্তু সব মুসলমান তা চায় না।’
লাহোর প্রস্তাবে বর্তমান পশ্চিম বাংলাকে কি বাদ রাখা হয়েছিল? এখনো সেটি আমাদের সাথে যোগ দিলেওতো প্রস্তাবটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়ে যায়। কই, তাতো বলা হচ্ছে না! এমন রাজনীতিকের প্রজ্ঞার পরিমাপ ইংরেজ বিচারক চার্লস ব্যারন বোওয়েনের (১৮৩৫-১৮৯৪ খ্রি:) (charles Baron Bowen) কথায় বুঝা যায়, “A blind man in a dark room-looking for a black hat-which is not there.” (একজন অন্ধ একটি অন্ধকার কামরায় একটি কালো টুপি খুঁজছে, যা সেখানে নেই।)
এ ধরনের নানা বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত আরেক সত্যের অপলাপে তারা সফল হয়েছেন। জনৈক মফিজদ্দিন, প্রকাশক আফিরদ্দিন, গ্রাম ভাগদী, পো: নরসিংদী, জিলা-ঢাকা-এর ২৫ পয়সা মূল্যের ৬ দফার কবিতাটির এই লেখক ও প্রকাশকের উচ্চারিত নাম দৃশ্যত এবং ঠিকানা সম্ভবত ভ্রান্ত। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে ও লঞ্চ-স্টিমারে এর পাঠ শুরু হলে ব্যাপক লোক সমাগম হতো। এতে মনে তৎকালীন পাকিস্তানবিরোধী তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। দুই পাকিস্তানে কিছু পণ্যের মূল্যে পার্থক্যের সত্যতায় পোস্টারিং হয়েছিল। ওই কবিতার প্রভাব ও প্রচারে, তখন মংলা বন্দরে ড্রেজিং দেখে জনরব শুরু হয় যে, পাকিস্তানের মাটিতে পান চাষ না হওয়ায় সেখানে চাষের জন্য আমাদের মাটি বড় বড় জাহাজে করে তারা নিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনে কাজ করার ওই কবিতাটির কিয়দংশ উদ্ধৃত করা হলো : ‘ফলাই আম, কাঁঠাল ২ কলা, তাল, লেবু, আনারস। করাচীতে বসে চুষে, কমলারী রস \ আমরা পাই না খেতে ২ সিলেটেতে কমলার বাগান। আমদানি হইতেছে গিয়া পশ্চিম পাকিস্তান। হালের গরু নাই ২ চাষী ভাই পড়ছে বিষম ফেরে। তার উপরে সুধে খাজনা নিছে আদায় করে। আবার টেস্ক ধরে ২ টিনের ঘরে, গরু গাড়ি আর। নৌকার উপর টেস্ক ধরে পাকিস্তান সরকার। বাংলার যত আয় ২ লইয়া যায় পশ্চিম পাকিস্তান। দিনে দিনে সোনার বাংলা হইল শ্মশান। মোদের টাকা দিয়া ২ বানছে নিয়া মঙ্গলারই বাঁধ। মরুভূমি বালু জমি করছে আবাদ। পূর্ব পাকিস্তানে ২ নানা স্থানে উঠে বন্যার জল। নষ্ট করে কোটি কোটি ধানের ফসল। ডুবায় বাড়ি ঘর ২ নাই খবর নাই দেখে চোখে। ইন্দ্রপুরী গড়ছে লিয়া মরুভূমির বুকে। জ্বালায় ইলেক্টারী ২ বাড়ি বাড়ি অল্প খরচ দিয়া। আমরা পাই না কেরোসীন তৈল দুঃখে যাই মরিয়া। আবার বালাম চাউল ২ বরিশাল পূর্ব বাংলায় ফলে। কি সন্ধানে জায়গা দেখ লাহোরেতে চলে। খাওয়ায় সস্তা দরে ২ কন্টোল করে ছয় সাত আনা দরে। আমরা পাই না বালাম চাউল কপালেরই ফেরে \ আবার সাদা চিনি ২ আমরা যানি পূর্ব বাংলায় হয়। দশ আনা সের করাচীতে খাইছে সব সময় \ থাইকা মরুর বুকে ২ খাইছে সুখে চিক্কন চাউলের ভাত। পচা ভুট্টা খাইয়া মরছে বাংগালীর এই জাত \ দিয়া মোদের টাকা ২ করছে পাকা তাদের বাড়ী ঘর \ আমি থাকি গাছ তলাতে কে রাখে খবর। করছে রাস্তা ঘাট ২ খেলার মাঠ, ফুলেরী বাগান। মরু বুকে করছে তারা সাত তালা দালান \ দেশের যত চাউল, ধান, সে সব গোলায় ভরে \ তার পর কোথায় যায় ২ কেউ না পায় পূর্ব পাকিস্তানে। করাচীতে চলে যায় দেখ, কি সন্ধানে। যদি এসব গোলা ২ হইত খোলা পূর্ব পাকিস্তানে। বাজারেতে থাকত আজি ১০ টাকা মণ ধান \ খাইত দেশের লোকে ২ মহা সুখে কাটাইত জীবন। মরত না আজ বাংলার ছেলে ভাতেরী কারণ \’
স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৪৭-এর ভাগে পশ্চিম বাংলা ভারত রেখে দিতে সফল হওয়ায় তখনকার কংগ্রেস নেতাদের মন্তব্য বাস্তবায়নে কালিদাস বৈদ্য এবং চিত্তরঞ্জন সুতার ভারতের সহায়তায় এ দেশকে ১৯৪৭-এর আগের পূর্ববাংলা বানাতে চেয়েছিলেন, যার ব্যর্থতায় তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সত্তে¡ও রয়ে গেছেন তারা আজো ‘ভারতীয়’।
মাস কয়েক আগে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো কেউ কেউ কালীদাস বৈদ্যের এই বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাতেই কি বইটি দুর্লভ হবে? এখনো জীবিত থাকা প্রবীণদের যিনি যতটুকু জানেন, তা দিয়ে তথ্যগত আপত্তি প্রকাশ করাই উত্তম, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটা ‘বাংলাদেশী পুরাণ’ বলে সমাদৃত না হয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা