১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাংবাদিক যখন ‘তথ্যচোর’!

রোজিনা ইসলাম - ছবি : সংগৃহীত

রোজিনা ইসলাম। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর একজন সিনিয়র রিপোর্টার। দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সাথে সাংবাদিকতা করছেন। মূলক্ষেত্র অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার জন্য দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সসেলেন্স ইন বাংলাদেশী জার্নালিজম (২০১১), ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড (২০১১), জার্মানি-ভিত্তিক জিআইজেড এবং ডয়চে ভেলে একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাবি সাংবাদিকতা বিভাগ, পিআইবি ও দুদকের যৌথ উদ্যোগে দেয়া ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কার বাংলাদেশ’ (২০১৪), টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ডিআরইউ বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড (২০১৭) অন্যতম।

সাম্প্রতিককালে স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোতে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন, যা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এসব রিপোর্টের মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী অফিস করেন না (২৫ জুন, ২০২০), ‘এখন এককোটি দেব, পরে আরো পাবেন’ (১২ এপ্রিল, ২০২১), টিকার মজুদ ১৫ মে’র মধ্যে ফুরিয়ে যাবে (২৩ এপ্রিল, ২০২১), উৎপাদনের নয়, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি গোপনীয়তার (২৫ এপ্রিল, ২০২১), কিটের ঘাটতি নিয়ে দুই রকম তথ্য (২৯ এপ্রিল, ২০২১), ৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম (৩০ এপ্রিল, ২০২১)।

সাংবাদিকতা একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পেশা। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন। তুলির আঁচড়ে কিংবা ক্যামেরার কারুকার্যে তারা সাধারণ্যে সমাজের ভালো-মন্দের ছবি ফুটিয়ে তোলেন। এটা করতে যেমন মেধার জোগান লাগে, অনেক শারীরিক-মানসিক ধকলও পোহাতে হয়। একদিকে তাদের যেমন সদা সমাজের আম-জনতার প্রত্যাশা পূরণে সজাগ থাকতে হয়, অন্য দিকে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় কায়েমি স্বার্থের রোষানলে পড়তে হয়। সাংবাদিকরা কেবল যে সমাজের চলমান অবস্থাকে প্রতিবিম্বিত করেন তাই নয়, জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ কারণে সাধারণ থেকে অসাধারণ- সমাজের সকল পর্যায়ের ব্যক্তি তাদের বিশেষ কদর করে থাকেন। তাদের ভূমিকা আপসকামী বলে প্রতীয়মান হলে তাদের সাধারণ্যে দুয়োধ্বনি শুনতে হয়। অন্য দিকে, কোনো রিপোর্ট কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে, যা কিনা প্রায়ই ঘটে, তাদের নানাবিধ চাপের মধ্যে পড়তে হয়। সেটা হতে পারে শারীরিক কিংবা মানসিক, এমনকি জেল-জুলুম থেকে জীবনসংশয় পর্যন্ত। বিপরীতে, আপসের পথে পা বাড়ালে উন্মুক্ত হতে পারে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের অবারিত দ্বার।

সাংবাদিকরা বিভিন্ন অঙ্গনে বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করেন। কেউ হয়তো মাঠে ময়দানে চলমান ঘটনাবলি কাভার করেন, কেউবা প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে সমাজের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করেন, আবার কেউ বিশেষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঘটনার আড়ালের ঘটনা বের করে আনেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সাংবাদিকরা এসবের সাথে পরিচিত এবং কর্মব্যাপদেশে যে যে এরিয়ায় কাজ করেন সেটার সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত বের করে আনার জন্য ঘটনার উৎসমূলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ স্থাপন। এজন্য সাংবাদিকদের নানাবিধ কলাকৌশল অবলম্বন করতে হয়। স্পষ্টতই এটা সবসময় সহজে হয় না। এখানে বুদ্ধি খাটাতে হয়, ঝুঁকি নিতে হয়, ঘটনাস্থলের কারো না কারো সহযোগিতা পেতে হয়। তবে, এই কঠিন কাজটিই অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বিশেষ দক্ষতায় সম্পন্ন করে সর্বসাধারণের জন্য অনেক অজানা তথ্য তুলে আনেন।

সেদিন হয়তোবা তেমনি কিছু তথ্য পাবার আশায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। হয়তোবা তার কাঙ্ক্ষিত তথ্য পেয়েও গিয়ে থাকবেন। কিন্তু, কোথাও হয়তো একটা ছন্দপতন ঘটেছিল। যার ফলাফল, মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের সাথে বচসায় জড়িয়ে পড়া। অভিযোগ উঠেছে, তিনি রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর গোপনীয় তথ্য ‘চুরি’ করছিলেন, যা কিনা হাতেনাতে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, তার স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঐদিন তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়েছে। একপর্যায়ে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং ঘটনাটি নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। আদালতে উপস্থাপনের পর রিমান্ড চাওয়া হলে বিজ্ঞ আদালত তা নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন এবং ২০ তারিখ জামিন শুনানির দিন ধার্য করেন।

ঘটনাটি দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশের সাংবাদিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল তথা দেশের সর্বস্তরের জনতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সারা দেশে সাংবাদিক সমাজ আন্দোলনে নামেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনাটি দ্রুত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দফতর থেকেও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে, পুরো বিষয়টি দেশের জন্য একটি ইমেজ ইস্যুতে পর্যবসিত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কী এমন গোপনীয় তথ্য যা সেদিন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ‘চুরি’ করার চেষ্টা করেছিলেন? যা প্রকাশিত হলে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত? বলা হচ্ছে, তিনি টিকা নিয়ে রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্প্রতি স্বাক্ষর করা চুক্তিবিষয়ক নথিপত্র নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো, ইতঃপূর্বে স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি যেসব অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন সেগুলো কি দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে? প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তার ইতঃপূর্বে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরকার বরং সংশোধনমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে। সন্দেহ নেই, এসব প্রতিবেদন তৈরিতে তাকে আগেও এরকম তথ্য হাতিয়ে নিতে হয়েছে। শুধু রোজিনা ইসলাম কেন, এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে যেকোনো সাংবাদিককেই কি এরকম তথ্য হাতিয়ে নিতে হয় না? এটা তো নতুন কোনো বিষয় নয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজনে এরকম তথ্য সংগ্রহকে ‘চুরি’ হিসেবে বিবেচনা কতটুকু সঙ্গত হতে পারে? তবে, হ্যাঁ, বিনা অনুমতিতে ফাইল থেকে ছবি তোলার ও ফাইল সরানোর চেষ্টা করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক হলে ভিন্ন কথা। সচিবালয়ের মতো সংরক্ষিত এলাকায় এমন কিছু ঘটে থাকলে তা সিসিটিভিতে নিশ্চয়ই ধরা পড়ে থাকবে। তেমন কোনো ফুটেজের কথা এখন পর্যন্ত আলোচনায় এসেছে কি?

স্বাধীনতাযুদ্ধসহ প্রতিটি ক্রান্তিকালে এ দেশের সাংবাদিক সমাজ জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূল পর্যায় থেকে গড়ে ওঠা একটি দল এ বিষয়টি যে অন্য কারো চেয়ে কম বোঝে তেমন তো নয়। বর্তমান সরকারের সাথে সাংবাদিক সমাজের সম্পর্কও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। যার একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা হলো করোনা অতিমারীর এই দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে দেশব্যাপী সাংবাদিকদের সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ১০ কোটি টাকার অনুদান মঞ্জুর। ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী রোজিনা ইসলাম যাতে ন্যায়বিচার পান তা নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। এ থেকে কি এটাই প্রতীয়মান হয় না যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়টি সফটলি হ্যান্ডল করতে চান? প্রশ্ন হলো, রোজিনা ইসলামের স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অভিযোগমতে তাকে প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা, তার বিরুদ্ধে তথ্য ‘চুরির’ অভিযোগ এনে মামলা দেয়া ও পুলিশের কাছে হস্তান্তর কি সেই বার্তা বহন করে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে তো সাংবাদিকদের সাথে বসে বিষয়টি সচিবালয়েই নিষ্পত্তি করে ফেলতে পারতেন। বিষয়টি এমন নয়তো যে, একটি মহল তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করতে সরকার ও সাংবাদিক সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছে?

সরকার যে বরাবর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলে আসছে, স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে, ইতঃপূর্বে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি উন্মোচনে সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে। উদ্বেগের বিষয় হলো, রোজিনা ইসলামের ঘটনা একদিকে যেমন সরকারের জন্য ইমেজ সঙ্কট তৈরি করছে, অন্য দিকে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নিরুৎসাহিত করতে পারে। এটা আখেরে সরকার বা সমাজ কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না, কেবল দুর্নীতিবাজদের পোয়াবারো হতে পারে।

ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এটাকে সঠিকভাবে হ্যান্ডল করা না গেলে এর প্রতিক্রিয়ায় বহুমাত্রিক সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। এজন্য স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। অন্যথায়, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি


আরো সংবাদ



premium cement
কামরুল-সোলায়মান ৪ দিনের রিমান্ডে নতুন বিল অনুমোদন করেছে রাশিয়ার আইন প্রণেতারা যুদ্ধ শেষে গাজার নিরাপত্তা ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে : প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, ১ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত ৫ রুশ জেনারেলকে হত্যার কৃতিত্ব দাবি ইউক্রেনের জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে ২০২৫ সালে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ মিয়ানমার নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের ইজতেমা ময়দানে দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩ প্লাস্টিকের দাপটেও টি‌কে আছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প কাঁপছে পঞ্চগড়, ৮ ডিগ্রির ঘরে তাপমাত্রা ইউক্রেন-রাশিয়া লড়াই করছে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা

সকল