২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাংবাদিক নির্যাতনের শেষ কোথায়?

সাংবাদিক নির্যাতনের শেষ কোথায়? - ফাইল ছবি

জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর কিংবা মফস্বল- সর্বত্রই চলছে সাংবাদিক নির্যাতন। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বা সদস্য, সবার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে তুলে নিয়ে নির্যাতন থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে মারধরের শিকার হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু দেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা আর নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার নেই।

হত্যা ও নির্যাতনের অগুনতি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে; বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার না করায় দেশে এখন সাংবাদিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনে ও জখম থেকে শুরু করে গুম কিংবা খুন নির্যাতনের এমন কোনো ধরন নেই যার শিকার হচ্ছেন না সাংবাদিকরা। অথচ সাংবাদিকরাই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যাদের লেখনীর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা জনসম্মুখে ফুটে ওঠে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও এখনো হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করা হয়নি। ৯ বছরে আদালত থেকে ৭৮ বার সময় নির্ধারণ করে দেয়ার পরও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। আদৌ বিচার পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয়! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারামুক্তির দিন ক্যামেরার প্রথম ক্লিকটি যে করতে পেরেছিল সেই ফটো সাংবাদিকের নাম শফিকুল ইসলাম কাজল। আর সেই সাংবাদিক কাজলই চোখ ও মুখ বাঁধা অবস্থায় নিখোঁজ ছিলেন ৫৩ দিন। খোঁজ পাওয়ার পর কারাগারে ছিলেন সাত মাস।

সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। এবার প্রকাশ্য দিবালোকে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি এখন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। অথচ তার নির্যাতন ও কারাবরণ নিয়ে সারা দেশের সাংবাদিকরা আজ ফুঁসে উঠেছেন। রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল এলাকার সাংবাদিকরা রোজিনাকে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

গত মার্চ মাসে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় হামলায় সাংবাদিকরা মারাত্মক মারধরের শিকার হন। বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার সময় অস্ত্রধারী চার ব্যক্তির ছবি তোলায় ফটো সাংবাদিক রুবেল রশীদকে রড দিয়ে পেটানো হলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একই সাথে তার মূল্যবান ক্যামেরা ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা। একই দিন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাস ও এমরান হোসেন, প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক হাসান রাজা, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায়, বিডিনিউজ২৪-এর ফটো সাংবাদিক মাহমুদ জামান অভি, সারাবাংলার ফটো সাংবাদিক হাবিবুর রহমান, ৭১ টিভির সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমন, বাংলাভিশনের স্টাফ রিপোর্টার দীপন দেওয়ান মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

এভাবে গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ২৩ জন। এর মধ্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে নিহতের সংখ্যা ১৪, আহত হয়েছেন ৫৬১ জন সাংবাদিক। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৯ বছরে খুন হন ৯ জন সাংবাদিক। আর নির্যাতনের কথা বাদই দিলাম। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদে গত ক’দিনে রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে। সেখানেও এমন মারাত্মক হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। এর আগে পঁচিশে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোদির আগমনবিরোধী বিক্ষোভে ছাত্রলীগের কয়েক দফা হামলায় আহত হন তিনজন সাংবাদিকসহ অন্তত ১৬ শিক্ষার্থী-বিক্ষোভকারী।

সাংবাদিকরা দেশের সব ধরনের দুর্যোগ-সঙ্কটে সামনের সারিতে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমবেশ যা-ই হোক- এটাই পেশাগত দায়িত্ব সাংবাদিকের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দায়িত্বপালনকালেই সাংবাদিকরা মারাত্মক হামলার শিকার হচ্ছেন। আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্ব পালনের কারণেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর। এমন হামলা যেমন আলোকচিত্র সাংবাদিকদের ওপর হচ্ছে, তেমনি প্রতিবেদকদের ওপরও হচ্ছে। সাম্প্রতিক অন্যান্য ঘটনাতেও দেখা গেছে, এমন সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকরা যেমন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন, তেমনি অস্ত্রশস্ত্র-লাঠি নিয়ে বিক্ষোভ বা সমাবেশে হামলাকারী সন্ত্রাসীদেরও টার্গেট হচ্ছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সাংবাদিকদের কোনো সুরক্ষা দিচ্ছে না, উপরন্তু নিজেরাও চড়াও হচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এমন হামলায় সাংবাদিকরা প্রাণও হারাচ্ছেন।

সম্প্রতি নোয়াখালীর বসুরহাটে পৌরমেয়র এবং তার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের অপর একটি গ্রুপের কর্মসূচিতে দুই পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষের ভিডিও ধারণের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দৈনিক বাংলাদেশ সমাচারের নোয়াখালী প্রতিনিধি বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার চার দিন নিখোঁজ থাকার পর আহতাবস্থায় ছাড়া পেয়েও আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলেন ‘আমি আর নিউজ করব না, আমাকে মারবেন না, প্লিজ।’

সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। এক দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানারকম ভয়ভীতি-হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে; আরেক দিকে শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব হামলা-নির্যাতন সাংবাদিকতা পেশাকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তথ্যপ্রকাশে বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিক নির্যাতন ও সাংবাদিক হত্যার যথাযথ বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাংবাদিক নির্যাতন রোধে এখনই সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : ব্যুরো প্রধান, দি নিউনেশন ও দৈনিক আজকালের খবর; বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ লেখক-সাংবাদিক ইউনিয়ন।


আরো সংবাদ



premium cement