২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্মরণে শ্রদ্ধায় হাসান শাহরিয়ার

স্মরণে শ্রদ্ধায় হাসান শাহরিয়ার - ফাইল ছবি

দেশের খ্যাতিমান ও কীর্তিমান সাংবাদিক, দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক বিশেষ সংবাদদাতা হাসান শাহরিয়ার করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। ঢাকায় যেমন সবাই তাকে এক নামে চিনত ইত্তেফাকের হাসান শাহরিয়ার হিসেবে, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ করে করাচিতে তেমনই তাকে সবাই এক নামে চিনত ‘ডন’ এর হাসান শাহরিয়ার হিসেবে। আসলে তার সাংবাদিকতা জীবনের সূচনাপর্বে একটা বড় অংশজুড়ে আছে পশ্চিম পাকিস্তান। প্রথমে ছিলেন ‘ডেমোক্র্যাট’ পত্রিকায় (১৯৬৪); তারপর মর্নিং নিউজে। তারও পরে টানা কয়েক বছরের জন্য দৈনিক ডন (উঅডঘ) পত্রিকায়। সে সময় তিনি ডনের সহযোগী পত্রিকা ‘ইভনিং স্টার’ এবং করাচির আরেক বিখ্যাত ম্যাগাজিনে ‘দ্য ইলাকট্র্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান’ এবং একই সাথে ‘হেরাল্ড’ ম্যাগাজিনে লিখতেন। তার লেখার কথা আমি প্রথম শুনি ড: মীজানুর রহমান শেলীর কাছে। শেলী ভাই বলতেন, রিপোর্টিং কী, শাহরিয়ারের কাছে জানা উচিত। শাহরিয়ার লেখেন ‘ডন’ বা ‘হেরাল্ডে’ কিন্তু তার লেখার ধরন, গড়ন এবং রুচি ও বৈশিষ্ট্য থাকে শিকাগো হেরাল্ড, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বা হেরাল্ড ট্রিবিউনের মতো। করাচি প্রেস ক্লাব ভবনে প্রবীণ সাংবাদিকদের সারিতে বাংলাদেশের হাসান শাহরিয়ারের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি আজো আছে, সম্প্রতি এক স্মৃতি আলেখ্যে এ কথা উল্লেখ করেছেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।

সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের জীবনে দু’টি ক্লাবই সমান গুরুত্ব বহন করত। একটি জাতীয় প্রেস ক্লাব, অন্যটি ঢাকা ক্লাব। তিনি যে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ, উন্নত রুচির শোভন আচরণের ও সদা হাস্যময় ব্যবহার-সম্ভাষণের এক বিরল মানুষ এটা তার যেকোনো সঙ্ঘ-সদস্য, সহকর্মী বা শুভানুধ্যায়ী এক বাক্যে স্বীকার করবেন। সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের সাথে বেশ কয়েকবার দেশের বাইরে পেশাগত কাজে ভ্রমণের সুযোগ পাই আমি। একসাথে বিদেশ সফর একজন মানুষকে বোঝার বা জানার উৎকৃষ্ট সময়। তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন দৈনিক ইত্তেফাকের, আমি দৈনিক ইনকিলাবের। বাংলাদেশে দীর্ঘ কয়েক দশক এই পত্রিকা দু’টিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ধারণা করা হতো, এই দুই পত্রিকার প্রতিনিধি দুইজনের মধ্যে থাকবে ঈর্ষার সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল নিতান্তই এর বিপরীত। বিদেশের পথে-ঘাটে, অফিসে, লাউঞ্জে, ফ্যাক্স, টেলিপ্রিন্টার বা ফোন বুথে তাকে পেয়েছি প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং অভিভাবক হিসেবে। তিনি বয়সে বড় এবং অভিজ্ঞতায় প্রবীণ এবং খ্যাতিমান এক তারকা সাংবাদিক। কখনোই এই তুলনামূলক উচ্চতার কথা আমি ভুলিনি। তবে তিনি রাশভারী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এমনটা তার সমালোচকরাও বলতে পারবে না। মানবিক সদাচার ও সৌজন্য যে রাজনৈতিক মতভিন্নতা বা পেশাগত বৈরিতাকে কত সহজে জয় করতে পারে, এটা হাসান শাহরিয়ারের সংস্পর্শে আসা মানুষমাত্রই জানেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পরিবারের সদস্যরা আজ এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো, কেউ ঘরে বসা, কেউ বা পরপারে। তবে যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছে হাসান শাহরিয়ারের মৃত্যুর এই দুঃসংবাদটি পৌঁছানো মাত্রই শোকে মুহ্যমান হয়েছেন তার একসময়ের সব সহকর্মী। এত মানুষের এত হৃদয়-উৎসারিত রোদন ও দীর্ঘশ্বাস তার মতো এক সজ্জন ও সুপ্রিয় মানুষের যে কত বড় অর্জন, ভেবে ব্যাকুল হতে হয়। হাসান শাহরিয়ার কেবল অবিভক্ত পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান সাংবাদিকই ছিলেন না, তিনি পাকিস্তানের সাংবাদিকদের নেতাও ছিলেন। ভাষা ও অঞ্চলের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও পূর্ববাংলার একজন মানুষ যে কতটা গুণসমৃদ্ধ হলে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী সাংবাদিক মহলে জনপ্রিয় হতে পারেন সেটা ভাবলে সত্যি বিস্ময় জাগে।

রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পেশাগত প্রয়োজন ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সময়টি পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত কোনো বাঙালি পেশাজীবীর জন্য ভালো সময় ছিল না। বাঙালিরা নিজ নিজ সাধ্য ও সীমা মোতাবেক বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে একাত্মবোধ লালন করতেন। বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা, সহকর্মী ও সহযোগীরাও তাদের বাঙালি সহকর্মীদের ব্যাপারে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ঘৃণাবোধ লালন করত। তবে বলতেই হবে, তখনকার সেই সময়েও আদর্শগত বিপরীতমুখিতাকে কখনোই দেখা যায়নি এখনকার মতো সংহারী ও সন্ত্রাসী রূপ নিতে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হাসান শাহরিয়ার নিজে। জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে দেখলেই ডাকতেন, ‘শেখ মুজিবের সাগরেদ’ বলে। তবে সেই খুনসুটির মধ্যেও স্নেহ ও সহমর্মিতার একটা ছায়া থাকত। পাকিস্তানে তখন রাজনীতির নেতৃত্ব দিতেন ভূস্বামী ‘রাজা’ জমিদার, খ্যাতনামা পীর মাশায়েখ বা সশস্ত্রবাহিনীর অবসরে যাওয়া জেনারেলরা। ফলে রাজনৈতিক দৃষ্টি তখনো ছিল উন্নত মূল্যবোধে লালিত। রাজনীতিতে খুনোখুনি, সংহার-সন্ত্রাস এসব ’৭০ দশক পর্যন্ত ভাবাই যেত না।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের অসংখ্য ক্ষমতাধর মানুষের সাথে সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ। কিন্তু কারো কাছে তিনি কখনো কোনো ধরনের সুযোগ বা ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের তদবির-দরবার করেছেন, এটা মনে হয় তার কঠোর কোনো নিন্দুকও বলতে পারবে না। তিনি যখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের (ঢাকা) সভাপতি কিংবা কমনওয়েলথ সাংবাদিক সংস্থার নেতা, তখনো কি তার সুযোগ কম ছিল? সব কিছু বাদ দিলাম, শুধু ইত্তেফাকের বিশেষ সাংবাদিক হিসেবেও তিনি তো অবলীলায় পারতেন বহু কিছু হাতিয়ে নিতে বা আদায় করতে। কিন্তু সারা জীবন মা ও ভাই-ভাতিজি-ভাতিজা নিয়ে মধ্যবিত্তের সহজ সরল জীবনই কাটিয়ে গেলেন চিরকুমার এই বিশাল মনের মানুষটি। সিলেটের বিশিষ্ট শিল্পী কলিম শরাফীর সাথে বেশ মার্গীয় হৃদ্যতা ছিল সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের।

সুনামগঞ্জের বিশাল হাওর-জলাশয়ে প্রস্ফুটিত যার শৈশব ও তারুণ্য, জীবনের অথৈ জলরাশিতে তাকে কখনোই কোনোরকম সঙ্কীর্ণচিত্ততায় ভুগতে দেখা যায়নি। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নয়কে ছয় করার কোনো তেলেসমাতিতে কখনোই জড়াননি তিনি। পেশাজীবনে আমি বা আমার মতো অনেকেই তার ঘনিষ্ঠ ছিলাম যারা রাজনৈতিক ভাবনা-চিন্তায় পুরোপুরি বিপরীতমুখী। তবে ভাবনার বিপরীতমুখিতা কখনোই তার সাথে মৈত্রীপথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানেই হাসান শাহরিয়ার ছিলেন অন্য অনেকের চেয়ে ব্যতিক্রমী।


আরো সংবাদ



premium cement
বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা নবনির্মিত ওয়ামি কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যুদ্ধবিরতির মার্কিন চেষ্টার মধ্যে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসাকর্মী নিহত অস্বস্তিতে ক্রেতারা : কমিয়ে দিতে হচ্ছে কেনাকাটা গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪৪ হাজার ছাড়াল আমরা মানুষের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে সম্মান করি

সকল