কুরআনে কারিমের ২৬টি আয়াতের প্রেক্ষাপট
- মাওলানা আরশাদ মাদানী
- ২২ এপ্রিল ২০২১, ২০:৩৬
গত কয়েক দিন ধরে ভারতে কুরআন মাজিদের ২৬টি আয়াত সম্পর্কে বেশ জোরেশোরে এ আলোচনা চলছে যে, কুরআন মুসলমানদের মুশরিকদের (মূর্তিপূজকদের) হত্যা করা ও মেরে ফেলার নির্দেশ করে। এ জন্য কুরআনের যেসব আয়াতে মূর্তিপূজকদের হত্যার নির্দেশ এসেছে, সেগুলো কুরআন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কেননা, ওই আয়াতগুলোর মর্ম হচ্ছে- ইসলাম কখনো অমুসলিম ও মূর্তিপূজককে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার দেয় না এবং তাদের সাথে ওঠাবসা ও সদ্ব্যবহার নাজায়েজ মনে করে।’ অথচ কুরআন মাজিদে সূরা মুমতাহিনার ৮-৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুসলমান, আল্লাহ তোমাদের তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায়বিচার করতে নিষেধ করেন না, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদের ঘর থেকে বের করে দেয়নি। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন। আল্লাহ শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তোমাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে এবং বের করে দেয়ার কাজে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তারাই জালিম-পাপী।’
এটা কুরআনে কারিমের একটি সাধারণ নির্দেশ যার দ্বারা জানা যায় যে, কুরআন কখনো অমুসলিমের সাথে ওঠাবসা ও সদ্ব্যবহার করতে নিষেধ করে না। বরং তা মুশরিকদের একটি বিশেষ শ্রেণী, যারা ধর্মের কারণে মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দেয় না, হত্যাযজ্ঞ চালায়, মুসলমানদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং তাদের জায়গাজমি দখল করে নেয়, তাদের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখতে নিষেধ করে। অনুরূপ, সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(ওই মূর্তিপূজক) ব্যতীত, যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়, যাদের ও তোমাদের মধ্যে চুক্তি রয়েছে অথবা তোমাদের কাছে এভাবে আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং স্বজাতির সাথেও লড়াই করতে অনিচ্ছুক। (এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার, নতুবা) যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তোমাদের ওপর তাদের প্রবল করে দিতেন। ফলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে লড়াই করত।
অতঃপর যদি ওই মুশরিকরা তোমাদের থেকে পৃথক থাকে, অর্থাৎ তোমাদের সাথে লড়াই না করে এবং তোমাদের সাথে সন্ধি করে, তবে আল্লাহ তোমাদের তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ দেননি।
এই আয়াত থেকেও জানা যায়, কুরআনে কারিমে যেখানেই মুশরিকদের সাথে লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা সাধারণ মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের সাথে নয়, বরং সেসব মুশরিকের সাথে, যারা কোনো অবস্থাতেই আরব ভূখণ্ডে কোনো স্থানেই মুসলমানদের বেঁচে থাকা ও বসবাস করার অধিকার দিত না। এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হচ্ছে, আল্লাহ হজরত মুহাম্মদ সা:কে জাজিরাতুল আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করান। এখানকার অধিবাসীরা মূর্তিপূজা করত এবং এটাকেই ধর্ম মনে করত। হজরত মুহাম্মদ সা: ৪০ বছর পর্যন্ত তাদেরই মাঝে অত্যন্ত ভদ্রতা ও পবিত্রতার সাথে জীবনযাপন করেন। নবী করিম সা: যখন ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পান এবং তিনি আল্লাহর নির্দেশে এক আল্লাহর ইবাদতের তাবলিগ বা প্রচার শুরু করেন, তখন মক্কার অধিবাসীরা যেহেতু মূর্তিপূজা করত, এ জন্য তারা আল্লাহর রাসূল ও তাঁর অনুসারীদের মারাত্মক কষ্ট দেয়া শুরু করে। তারপরও তিনি ১৩ বছর পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় অবস্থান করেন এবং স্বজাতির জুলুম নির্যাতন স্বয়ং তিনি এবং তাঁর হাতোগোনা কিছু সহচর রাত-দিন সয়ে গেছেন। তাদের একটাই ‘অপরাধ’ ছিল, তাহলো- তারা ওই পরিবেশে শুধুই এক আল্লাহর ইবাদত করতেন, যেখানে মক্কাবাসী কাবার অভ্যন্তর ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি রেখেছিল। সুতরাং মূর্তিপূজকদের জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায় ৮০ জন মুসলমান রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুমতি নিয়ে ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিয়ে শান্তিতে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আবিসিনিয়া বা হাবশায় চলে যান।
মক্কা মুকাররমায় ১৩ বছর পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা:-এর হাতে কোনো শক্তি ছিল না। শক্তি যেটুকু ছিল, তা ছিল নিজ বংশ ও গোত্রের শক্তি। কিন্তু তারা সবাই ধর্মের ভিত্তিতে তাঁর ও তাঁর সহচরদের কঠোর বিরোধী ছিল। তারা এমন এমন কষ্ট দিত, যা শোনামাত্র লোম খাড়া হয়ে যায়। যখন একদিন আপন-পর মিলে মক্কার বড় বড় সর্দার নিজ হাতে মহানবী সা:কে হত্যার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে একত্র হলো, তখন আল্লাহর নির্দেশে ও তাঁর নিরাপত্তায় তিনি সেই লোকগুলোর মাঝ দিয়েই বের হলেন এবং মদিনা মুনাওয়ারায় গিয়ে পৌঁছলেন। এই সফরে তাঁর সঙ্গী ও খাদেম ছিলেন শুধু হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা:।
মদিনায় এসে রাসূলুল্লাহ সা: প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করলেন। মদিনা মুনাওয়ারাকে তার রাজধানী বানালেন এবং শাসনকার্যের জন্য যা প্রয়োজন তিনি তার সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন। এখানে তাঁর বিশ্বস্ত এবং তাঁর ইশারায় জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত বাহিনীও ছিল। আধুনিক পরিভাষায় স্টেট ব্যাংকও ছিল, কারাগারও ছিল। মোট কথা, প্রয়োজনীয় সবকিছুই ছিল। রাসূলুল্লাহ সা: এবং মক্কা থেকে আগত (মাতৃভূমি ত্যাগকারী) তাঁর সহচররাও মদিনাকেই নিজ ভূমি বানিয়ে নিলেন।
মক্কার অধিবাসীরা তাদের মেনে নিলো না। যাদের তারা সহায় সম্বলহীন অবস্থায় নিজেদের মাতৃভূমি মক্কা থেকে বের করে দিয়েছিল, তারা এখন প্রকাশ্যে এক আল্লাহর ইবাদত করতে লাগল এবং রাষ্ট্র গঠন করে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। আবার আরবে তাদের মুদ্রা চালু হয়ে গেল। সুতরাং বিদ্বেষের আগুন ও শক্তির মত্ততায় নিজেদের বীর নওজোয়ান ও সর্দারদের নিয়ে অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বদর প্রাঙ্গণে এই অসহায় মানুষদের নিঃশেষ করে দিতে এবং প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের নামনিশানা মুছে দিতে মক্কার মুশরিকরা সমবেত হলো। কিন্তু রাষ্ট্র ও শক্তি তো আল্লাহর। তিনি এই অসহায় সামান্য সংখ্যক মানুষদের হাতে মক্কাবাসীকে এমনভাবে পরাস্ত করলেন, যা মক্কার কুরাইশরা কল্পনাও করতে পারেনি। তাদের এই লাঞ্ছনা, অবমাননা ও পরাজয় এক দিকে মুসলমানদের সাহস বাড়িয়ে দিলো, অপর দিকে কুরাইশদের অন্তরে বিদ্বেষের এমন আগুন জ্বালিয়ে দিলো, যার সঠিক বর্ণনা বেশ কঠিন। বিদ্বেষের ফলে পরাজয়ের পর ওহুদ ও আহজাবের যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা মদিনার ওপর আক্রমণ চালায়। ইতিহাস সাক্ষী, রাসূলুল্লাহ সা: ও মুসলমানরা আগ বাড়িয়ে মক্কার ওপর আক্রমণ করেননি।
এই আলোচনার পর এ বাস্তবচিত্র সামনে আসা উচিত যে, কুরআনে যেখানেই মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই ও তাদের হত্যার নির্দেশ এসেছে, তা সব মূর্তিপূজক ও মুশরিকের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের ব্যাপারে এসেছে, যাদের বুকের ভেতর মুসলিমবিদ্বেষের আগুনে জ্বলন্ত চুলা হয়ে আছে। নতুবা কোনো অমুসলমানের সাথে ভালোভাবে ওঠাবসা ও সদাচরণের নির্দেশরূপে প্রতিটি মুসলমানের জন্য সর্বদা সেটাই বলবৎ রয়েছে, যা শুরুতে আয়াতগুলোর আলোকে বলা হয়েছে। যারা সব অমুসলিমকে সর্বদা যত্রতত্র হত্যা করা ইসলামের শিক্ষা মনে করে, তারা ইসলামকে মোটেই বুঝেনি। ইসলাম আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত এক ঐশী ধর্ম। আর কোনো ঐশী ধর্ম আল্লাহর বান্দাদের অন্যায়ভাবে হত্যার নির্দেশ প্রদান করে না। আল্লাহর প্রেরিত ধর্মের বাতি নেভানো কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রের শেকড় ওপড়ানোর জন্য কোনো প্রশাসন বা শ্রেণী দাঁড়িয়ে গেলে তার সাথে ইসলামের কোনো আপস নেই।
এই ভূমিকাকে সামনে রাখা ও ভাবনার পর এ বাস্তবতা সামনে আসবে যে, এমন বিদ্বেষপোষণকারী ও রাষ্ট্রের শেকড় ওপড়ানো ব্যক্তিদের আজো বিশ্বে কেউই আদর-সোহাগ করে না। বরং তাদের সাথে সেই আচরণই করা হয়, যা ইসলাম করেছে ও কুরআনের যুদ্ধবিষয়ক আয়াতে বলা হয়েছে এবং সুরা মুমতাহিনার ৯ নম্বর আয়াতে এই বিষয়টিকেই সুস্পষ্টরূপে প্রকাশও করা হয়েছে। উল্লিখিত এই বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা এই আয়াতগুলোকে ধর্মের নামে সব মুশরিকের বিরোধিতা ও হত্যার অর্থ করে থাকে। অথচ এটা মারাত্মক ভ্রান্তি। সূরা মুমতাহিনার ৮ নম্বর আয়াত বলছে, ‘যে সব অমুসলিম তোমাদের শত্রু নয়, তোমরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার ও সদাচরণ অব্যাহত রাখো।’ অপর একটি আয়াত, যেটাকে ওই ২৬টি আয়াতের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে সূরা তাওবার ২৮ নম্বর আয়াত। ওই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, মুশরিকরা অবশ্যই অপবিত্র। তারা যেন এ বছরের পর মসজিদে হারামের কাছে না আসে।’ এ আয়াত ‘মুশরিকরা অপবিত্র’ বলার পাশাপাশি ‘তারা যেন এ বছরের পর মসজিদে হারামের কাছে না আসে’ এ কথা বলছে, এরা তারাই, যাদের পাপকর্ম কাবা শরিফের সম্মানবিরুদ্ধ হচ্ছিল। এ জন্য তাদের বায়তুল্লাহ ও মসজিদে হারামের কাছে আসতেও নিষেধ করা হয়েছে। শিরকের পাশাপাশি এই অপবিত্র কর্ম ওই বিশেষ মুশরিকদের অপবিত্র হওয়ার কারণ। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সা: মক্কা বিজয়ের পর প্রথম হজের সময় হজরত আলী রা:কে যে বিষয়গুলো ঘোষণার জন্য প্রেরণ করেন, সেখানে এটাও একটি বিশেষ বিষয় ছিল যে, এ বছরের পর কেউই আপাদমস্তক উলঙ্গ অবস্থায় কাবার তাওয়াফ করবে না। কেননা, আশপাশের অমুসলিমরা উলঙ্গ অবস্থায় কাবার তাওয়াফ করত। অর্থাৎ উলঙ্গপনাকে তারা নিজেদের ধর্মের অংশ বানিয়ে রেখেছিল। যদি কেউ বিবেকবিরোধী কাজ করে, তখন যেভাবে আমাদের ভাষায় বলা হয়, ‘ওই ব্যক্তির বিবেকের ওপর পাথর পড়েছে’ বা ‘বিবেকের ওপর কুকুর পেশাব করেছে’, অনুরূপ এখানে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর সম্মানিত ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘরের তাওয়াফের মতো পবিত্র কাজ ও ইবাদতকে উলঙ্গের মতো নোঙরা রূপ দিচ্ছে, তাদের এটা পুরোটাই নোঙরা ও অপবিত্র।
যারা ধর্মের নামে ইসলামে অমুসলিম হত্যাকে বৈধ মনে করে, তারা কুরআনের কিছু আয়াতের তরজমা পাঠ করেছে মাত্র, এর তাফসির পড়েনি। এ জন্য তারা হোঁচট খায়। যদি তারা সূরা মুমতাহিনার ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতের মর্মের ওপর চিন্তা করত এবং এই দু’টি আয়াতকে সামনে রেখে হত্যার নির্দেশের আয়াতগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করত, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যেত। কেননা, হত্যার নির্দেশের আয়াতগুলো যদি সব মুশরিকের জন্য হতো, তাহলে সূরা মুমতাহিনার ৮ নম্বর আয়াত ও সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াতে সাধারণ মূর্তিপূজকদের সাথে সদাচরণ করা ও লড়াই-হত্যা না করার বিষয় কুরআনে কিভাবে বলা হলো? কুরআন আল্লাহর কিতাব। এর প্রতিটি হরফ বিশুদ্ধ। বিশ্বের সব মুসলমান চৌদ্দশ’ বছর ধরে এই বিশ্বাস নিয়ে পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, বেঁচে আছেন এবং মরছেন। এটাকে ভুল বলা মারাত্মক ভ্রান্তি। তবে সংশয় হলে তা নিরসনের জন্য এর তাফসির নিয়ে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৭ এপ্রিল, ২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম ও জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের প্রেসিডেন্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা