২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মোদির দাবি এবং ভারতীয় মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত

শহীদের রক্ত ও মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিত্যনতুন তথ্য শুনতে হচ্ছে। জানি না আগামীতে আরো কত নতুন তথ্য শুনতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষদর্শীর কলমে বর্ণিত ইতিহাস আমাদের কাছে সংরক্ষিত থাকার পরও যখন একেবারে নতুন তথ্য শুনতে হয়, তখন মনের ভেতর নানা রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা জাগে, যারা উঠতে বসতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আত্মস্থ করিয়ে দিতে চায়, তারা নিত্যনতুন তথ্যকে কেন চ্যালেঞ্জ করে না? বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অতিথি হয়ে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের একেবারে নতুন তথ্য দিয়ে গেলেন। এতে আমরা কতটুকু অবাক হয়েছি জানি না, তবে ভারতের মানুষ এবং মিডিয়া বেশ অবাক হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বলেন, তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য সত্যাগ্রহ করেন। এর জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং কারাবন্দীও হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশে এ কথা বলে মোদি নিজেকে বাংলাদেশের কাছের মানুষ হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। অথচ তিনি ও তার দল প্রায় ক্ষেত্রে নিজেদের বাংলাদেশবিরোধী হিসেবে প্রকাশ করে চলেছেন।

এনআরসির মাধ্যমে আসামের চল্লিশ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আখ্যায়িত করে তাদের ভারত থেকে (বাংলাদেশের দিকে) বের করে দেয়ার অনবরত হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর কথা বলেন। অ্যাসেম্বলি নির্বাচনেও বিজেপি ‘অনুপ্রবেশকারীদেরকে’ ফেরত পাঠানোর ওয়াদা করেছিল। সরকার গঠন হতেই মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার জন্য এনআরসির সাথে আলাদাভাবে ডিটেক্ট (অনুসন্ধান), ডিলিট (মোচন) ও ডিপোর্ট (নির্বাসন) প্রোগ্রাম শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বিদেশী অধিবাসীদের অনুসন্ধান করে তাদের নাগরিকত্ব বিলোপ করা ও তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক সফরে এসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহ বলেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিজেপির নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী ২০১৮ সালে বাংলাদেশ দখলের হুমকি প্রদান করেছিলেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। এমন পরিস্থিতিতে মোদি যখন বলেন, তিনি বাংলাদেশের জন্য গ্রেফতার হয়েছেন এবং কারাবন্দী হয়েছেন, তখন বাস্তবিকই অবাক হতে হয়। অবশ্য সার্বিকভাবে আমাদের অবাক হওয়ার বিষয়টি তেমন নজরে পড়ছে না। তবে ভারতীয়রা ঠিকই অবাক হয়েছে।

কলকাতা ও শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত দৈনিক বর্তমান জানাচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন, তার জন্য গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন- প্রধানমন্ত্রী মোদির এই দাবি নিয়ে ধন্ধ ভারতজুড়ে। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির দফতরেই তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনে একাধিক আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক আইনজীবী কৃষ্ণমোহন পাণ্ডে এবং কংগ্রেস নেতা সরল প্যাটেল পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আরটিআই দাখিল করে ২৭ মার্চ জানতে চেয়েছেন- ১. কোন আইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করায় জেলে যেতে হয়েছিল নরেন্দ্র মোদিকে? সেই অভিযোগের এফআইআর কপি প্রকাশ করা হোক। ২. নরেন্দ্র মোদি ভারতের কোন জেলে বন্দী ছিলেন? ৩. সত্যাগ্রহ করার জন্য সেই সময় জেলে কতদিন বন্দী ছিলেন তিনি? ৪. এই সত্যাগ্রহ, গ্রেফতার, জেলবন্দী সংক্রান্ত নথি প্রকাশ করা হোক।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সব থেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ভারত সরকারই। দেশের সব রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একজোট ছিল। সেই আবহে এই ইস্যুতে সত্যাগ্রহ করা হলে পুলিশ গ্রেফতার করবে কেন? আবার সরকারই যেখানে বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহ কার বিরুদ্ধে? দিনভর এ রকম হাজারো প্রশ্ন ও কটাক্ষের জবাব দিতে বিজেপির সোস্যাল মিডিয়ার প্রধান অমিত মালব্য বলেন, যারা প্রধানমন্ত্রীর দাবিকে ঘিরে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, তারা ইতিহাস জানেন না। দিল্লি, লখনৌ ও মুম্বাই থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক সাহাফাতের ৩০ মার্চের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য সত্যাগ্রহের কারণে মোদির গ্রেফতার হওয়া ও জেলে যাওয়ার দাবিকে কংগ্রেস নেতা শশী থারোর ও জয়রাম রমেশ চ্যালেঞ্জ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন নতুন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যাদের সরগরম হওয়ার কথা তাদের কাউকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। শুধু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, মোদি সাহেব বলেছেন উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলে গিয়েছিলেন, কারণ কী? মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তো ভারতীয় নেতাকর্মীদের বিরোধিতা ছিল না। বরং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে এক কোটি শরণার্থী অসহায় বাঙালির সহায়তা এবং কিভাবে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা যায়, সেই পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছিল। এ জন্য রুশ-ভারত চুক্তি হয়েছিল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য (মোদিকে) জেলে যেতে হয়েছিল।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় শুদ্ধব্রত সেনগুপ্তের কলামে। তিনি The Wire এর অনলাইন সংস্করণে A Sataygrah and Asatyagraha : Narendra Modi and the Liberation of Bangladesh কলামে বলেন, ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে জনসঙ্ঘের সত্যাগ্রহ ছিল সদ্য সাক্ষরিত হওয়া রুশ-ভারত চুক্তির বিপক্ষে প্রতিবাদ। আর এ কারণেই সরকার তাদের গ্রেফতার করে বন্দী করেছিল। মোদির দাবি অনুযায়ী ওই গ্রেফতারকৃত ও বন্দীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত ষাট বছরের পুরনো প্রভাবশালী পত্রিকা উর্দু টাইমস ৩০ মার্চ এ ব্যাপারে একটি চমৎকার সম্পাদকীয় লিখেছে। সম্পাদকীয়টির হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করলেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর সোস্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ এই নয় যে, তিনি সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছেন। বরং এ জন্য আলোচনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদি সেখানে আত্মপ্রশংসায় এমন কিছু বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা একেবারে অসঙ্গত ও ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তিতে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তিনিও তার অংশীদার ছিলেন। আর ওই আন্দোলনের জন্য তিনি জেলেও গিয়েছিলেন। এখানে প্রশ্ন ওঠে, নরেন্দ্র মোদিকে ১৯৭১ সালে কে জেলে প্রেরণ করেছিলেন? সেটা কোন জেল ছিল? সেখানে তিনি কত দিন ছিলেন এবং কার কার সাথে জেলে ছিলেন? এ প্রশ্নগুলো সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেননা তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের সব বিরোধী দল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ছিল। আর পুরো ভারত পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সরকার যেখানে স্বয়ং কোনো আন্দোলনকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছিল, সেখানে ওই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকে জেলে কেন পাঠাবে? সমগ্র ভারতে লাখ লাখ মানুষ ওই আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু কারো জেল হয়নি। তাহলে নরেন্দ্র মোদির জেল হলো কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী তার অতীত সম্পর্কে বিস্ময়কর কথা বলে থাকেন, কিন্তু তার চা বিক্রয় থেকে নিয়ে তার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত সময়ের কথাগুলোর কোনোটাই বাস্তবতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক বড় সম্মানের বিষয়। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো রাষ্ট্রে যান, তখন তিনি শুধু একা যান না, বরং সমগ্র ভারতের সম্মান ও ঐতিহ্য তার সঙ্গী হয়। তিনি সমগ্র ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় এমন ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রদানের দ্বারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর গায়ে দাগ লাগে না, বরং এটা পুরা দেশের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রীর যদি কোনো কিছু করতে হয়, তাহলে তার বাংলাদেশের কাছ থেকে এটা শেখা উচিত যে, তারা এত নাজুক সময়েও নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিচ্ছে এবং বিশ্বপরিমণ্ডলে সুখী দেশের তালিকায় ভারতের চেয়ে কিভাবে এগিয়ে আছে।

বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্কের জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ব্যাপারে তার ব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত ছিল। কেননা তার সফরের বিরুদ্ধে পুুরো বাংলাদেশে যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়েছে, তার ভিত্তি ছিল ‘সিএএ’ এবং ‘এনআরসি’। এ বিক্ষোভ এতটাই জোরালো ছিল যে, এতে মোট সাতজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। ওই লোকগুলোর প্রতিবাদের মৌলিক কারণ ছিল ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ব্যাপারে মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশীদের নামে তৈরি আইন। ভারতে বাংলাদেশীদের শত্র“গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তাদের প্রকাশ্য রাষ্ট্রশত্র“ নাম দিয়ে রাজনীতি করা হয়, তাদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সেই বাংলাদেশীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারকবাহক হয়ে যান। আমাদের দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসির পুরো অস্তিত্বটাই ‘বাংলাদেশী’ অনুপ্রবেশকারীর নামে কার্যকর করা হচ্ছে। এটা কেমন নীতি যে, শত্রু পাল্টে হঠাৎ করে উল্টো পরম আপন হয়ে যায়?

১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষিত। তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হতে পারে। তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসে সম্পূর্ণ নতুন কোনো তথ্য বা গালগল্প শুনতে আমরা মোটেও প্রস্তুত নই।

লেখক : গবেষক ও অনুবাদক


আরো সংবাদ



premium cement