শহীদ লে. আনোয়ারের স্মৃতিবিজড়িত ৪০ বছর
- অধ্যাপক মো: মসিউল আযম
- ২০ মার্চ ২০২১, ২০:৩০
শহীদ লে. আনোয়ার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ৫ মে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার আলীগঞ্জ সরকারি এতিমখানা কোয়ার্টারে। তার নানা মরহুম এয়াকুব আলী ছিলেন এতিমখানার সুপার। আনোয়ারের পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। বাবা আবদুল হক ছিলেন পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা। সাত ভাই-বোনের মধ্যে আনোয়ার মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার পদে তিনি রিক্রুট হন। এরপর সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমি কাকুল থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যশোর সেনানিবাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা যশোরের চৌগাছা এলাকার জগদীশপুর এলাকায় গ্রীষ্মকালীন মহড়ায় ব্যস্ত ছিল। ওই সময় তাদেরকে পাঠানো হলো সিগন্যাল মেসেজ- দ্রুত ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য। ফিরে আসার পরপরই তাদের করা হলো নিরস্ত্র। তরুণ অফিসার আনোয়ারের তাজা খুন উঠল টগবগিয়ে। জ্বালা ধরিয়ে দিলো তার সব অস্থিমজ্জায়। তিনি ভাবলেন, এভাবে নিরস্ত্র হয়ে শিয়াল-কুকুরের মতো মরার চেয়ে লড়াই করে বীরের মতো শহীদ হওয়া গৌরবের কাজ।
১৯৭১ সাল ৩০ মার্চ, সকাল পৌনে ১০টা, বাঙালি সেনারা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ শুরু করে দেয় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনী যেখানে ওদের নিরস্ত্র করে অস্ত্র জমা রেখেছিল, একটি হাতুড়ি নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন লে. আনোয়ার। তাকে অনুসরণ করলেন কয়েকজন বাঙালি সেনা। মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে হালকা অস্ত্র নিয়ে তারা এলেন বেরিয়ে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই অস্ত্র বের হওয়ার খবর পৌঁছে গেল সেনাদের হাই কমান্ডে।
এক দিকে ভারী অস্ত্র, অপর দিকে বাঙালি বিদ্রোহীদের হাতে সামান্য হালকা ধরনের অস্ত্র। তবুও বিদ্রোহী সেনারা প্রাণপণে লড়ছিলেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। হঠাৎ একটি মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার এসে লে. আনোয়ারের তলপেট ও ঊরু ঝাঁজরা করে দেয়। আহত অবস্থায় সঙ্গী সেনারা নিয়ে আসে সেনানিবাসের পাশে ছাতিয়ানতলা গ্রামে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তিনি শাহাদত বরণ করেন। পরে গ্রামের তিন জন যুবক ও সাথী সৈনিকেরা তার লাশ গরুর গাড়িতে করে (গরুবিহীন) নিজেরা গাড়ি টেনে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ সংলগ্ন হৈবতপুর গ্রামে আনে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা শেষে যশোর-ঢাকা সড়কের ধারে একটি কড়ইগাছের ছায়ায় আনোয়ারকে সমাহিত করা হয়। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন চিরতরে বীর সেনা শহীদ লে. আনোয়ার।
১৯৭৩ থেকে এই সুদীর্ঘ ৪৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত অনেক ইতিহাস রয়েছে। তা এই লেখার মধ্য দিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি।
১৯৭৩ সাল। যশোর সেনানিবাসের তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তদানীন্তন লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর। তিনিই সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহীদ লে. আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করার। ৩০ মার্চের কয়েক দিন আগে সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের কলেজে খবর পাঠানো হয় আমাদের আগামী ৩০ মার্চে অনুষ্ঠেয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। লে. আনোয়ার হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী সেবার পালিত হলো। সেই থেকে অদ্যাবধি প্রায় ৫০ বছর ধরে যথাযোগ্য মর্যাদায় এই শহীদের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়ে আসছে।
১৯৭৩ সালের কথা। তখন কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় যশোর জেলা প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলাম। শহীদ লে. আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের সংবাদটি ছবিসহ বাংলার বাণী পত্রিকায় ছাপা হয়। ওই অনুষ্ঠানের সমস্ত আলোকচিত্র গ্রহণ করেন বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফি। আমার ও শফি ভাইয়ের সাথে লে. কর্নেল মঞ্জুরের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যতবার সেনানিবাসে এম এ মঞ্জুরের সাথে সাক্ষাৎ করেছি ততবারই আলোকচিত্র শিল্পী শফি ভাই খোঁজখবর নিয়েছেন।
যশোর সেনানিবাস থেকে বদলি হওয়ার আগে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি অধ্যক্ষ ও আমাকে বলেন, ‘আপনারা যেকোনো সময় আমার কাছে আসবেন। আর লে. আনোয়ারের এই অনুষ্ঠানকে সবসময় ধরে রাখবেন। এটি ছিল একজন সেনাকর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন। আমরা আজো তার সেই অনুরোধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি।
এরপর লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর বদলি হন ঢাকা সেনা সদর দফতরে। সময় পেলেই তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ভুলতাম না। উনি খুবই সমাদর করতেন। একবার অধ্যক্ষ ইব্রাহিম হোসেন ও ঢাকা সেনানিবাসে স্টাফ রোডের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের যে সম্মান ও অমায়িক আচরণ করেছিলেন তা কোনোদিন ভুলে যাবার নয়। সাক্ষাত পর্ব শেষে তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকার গন্তব্যস্থলে আমাদের নামিয়ে দিয়ে যান। উনি তখন ব্রিগেডিয়ার। এত উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার হওয়া সত্ত্বেও আমাদের যে সম্মান দিয়েছিলেন, তা চির স্মরণীয় থাকবে স্মৃতির মণিকোঠায়।
আরেক বারের ঘটনা যা এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে। এম এ মঞ্জুর তখন চট্টগ্রামের জিওসি ও মেজর জেনারেল। আমাদের কলেজে সৃষ্টি হয় একটি বড় সমস্যা। তখনই মনে পড়ে এম এ মঞ্জুরের যশোর থেকে বিদায় বেলার কথা। অধ্যক্ষ ও আমি সোজা ছুটে যাই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। তখন বেলা ১১টা। তিনি দরবারের জিওসির এডিসি মারফত আমাদের আগমনের খবর পেয়েই অপেক্ষাগারে নিজে এসে বললেন, ‘আপনারা চা পান করুন। দরবার শেষে সব কথাই শুনব। দরবার শেষে তার অফিসকক্ষে আমাদের মুখে বিস্তারিত সব কিছুই শুনলেন। খুবই ধৈর্যসহকারে বললেন, ‘কলেজের সিল-প্যাড এনেছেন? প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বরাবর একটি আবেদন করতে হবে, আবেদনপত্রটি তার কাছে রেখে আমরা সোজা যশোরে ফিরে আসি। চট্টগ্রাম থেকে ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ যশোর জেলা প্রশাসকের দফতরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে একটি চিঠি আসে। আমাদের কলেজে রাষ্ট্রপতির অনুদান প্রাপ্তির চিঠি। এই অনুদান পাওয়ার পরই চার দিকে সব মহলে হইচই পড়ে যায়। এটা কী করে সম্ভব হলো? একবারে খোদ রাষ্ট্রপতির অনুদান। সত্যিকারে বলতে গেলে ব্রিগেডিয়ার মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর যদি সে দিন এই সহযোগিতা না করতেন, কলেজের সার্বিক উন্নয়ন অনেকটা বিঘ্নিত হতো এবং আমরা অনেক পিছিয়ে পড়তাম। এ জন্য মেজর জেনারেল মঞ্জুরের পাশাপাশি আরেক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই অবদানের কথা চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করব। তার কাছে আমরা চিরঋণী, এই অনুদান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য।
শহীদ আনোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে আরেকজন সেনা অধিনায়কের কথা চির অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি হচ্ছেন যশোর সেনানিবাসের সাবেক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক। ৩০ মার্চ খুব ভোরে ফজরের নামাজ শেষে যশোর সেনানিবাস থেকে সোজা চলে আসতেন শহীদের মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে এবং বিকেলে আয়োজিত কর্মসূচিতেও যোগদান করতেন। তিনি যশোর সেনানিবাসে যতদিন ছিলেন, অধ্যক্ষ ও আমাকে সেনানিবাসের বেশ কিছু অনুষ্ঠানে মেহমান হিসেবে উপস্থিত হতে দাওয়াত দিয়েছেন। এরপর তিনি বদলি হলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ঢাকা তার দফতর ও ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে যখন সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি, আমাদের খুবই সমাদর করতেন। এরপর তিনি বদলি হন কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাসে। সুদূর কাতার থেকেও তিনি আমাদের ভুলে যাননি। চিঠি দিয়ে শহীদ লে. আনোয়ার হোসেনের অনুষ্ঠানটি ধরে রাখার তাগিদ দিয়েছেন বারবার। পরে তিনি কাতারেই থাকাকালে ইন্তেকাল করেন।
পরবর্তীকালে যশোর সেনানিবাসের যেসব অধিনায়ক ও সামরিক অফিসার ৩০ মার্চ শহীদের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন তাদের কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। এদের মধ্যে রয়েছেন- ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, কর্নেল এম নূরউদ্দীন খান, লে. কর্নেল আবদুল হাকিম মিয়া, কর্নেল মহসীনউদ্দীন আহমেদ, মেজর জেনারেল কে এম আবদুল ওয়াহেদ, মেজর জেনারেল সাদিকুর রহমান, কর্নেল সাদেক হুসাইন, মেজর জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান, কর্নেল আবদুল্লাহ, মেজর জেনারেল জামিল ডি. আহসান, মেজর জেনারেল কাজী আশফাক আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার এম হুসেইন সাদেক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মাওলা প্রমুখ। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান, মেজর হাফিজউদ্দিন আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খুরশিদ এ বাবলু এবং লে. আনোয়ার হোসেনের আত্মীয় স্বজনরাও এসেছেন। তাদের অনেকেই ‘না ফেরা’র দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
শহীদ লে. আনোয়ার হোসেন রক্ত দিয়েছেন বলেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। আনোয়ার হোসেনের মতো নাম না জানা শত শহীদের রক্তের আর বহু স্বজনহারা মানুষের অশ্রুর বিনিময়ে, বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছি এই স্বাধীনতা। অনেক ত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা আমাদের স্বাধীনতার ফল ভোগ করে যেতে পারেননি, তাদের অবদান আমরা বিস্মৃত হতে পারি না।
স্বাধীনতা একটি জাতির অমূল্য সম্পদ, পবিত্র আমানত। আসুন, আমরা এই দিনে সবাই দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হই, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র আমরা রুখবই।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা