২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মাদরাসা বন্ধের আইন

মাদরাসা বন্ধের আইন - ছবি : সংগৃহীত

এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, দ্বীনি মাদরাসাগুলো ভারতে ইসলামের অবশিষ্ট ও অব্যাহত থাকার একমাত্র মাধ্যম। এসব মাদরাসা থেকে ধর্মীয় শিক্ষার যে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছে, তা পুরো উপমহাদেশকে আলোকিত করেছে। ভারতের আনাচে-কানাচে অবস্থিত এসব মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপ্তকারী উলামায়ে কেরাম ও মুফতি সাহেবরা শুধু ধর্মীয় পথপ্রদর্শনের দায়িত্বই পালন করছেন না, বরং ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখতেও সহযোগিতা করছেন। যদি এটি বলা যায় তবে অনর্থক হবে না, ভারতে ইসলামের অগ্রযাত্রায় এসব প্রতিষ্ঠানই মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণেই ইসলামের প্রচার-প্রসারে ভীত, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী অনেক দিন ধরে এর পেছনে লেগে আছে এবং এটিকে বন্ধ করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। বিজেপি যখন থেকে পরিপূর্ণরূপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকে এ ধরনের অপচেষ্টাগুলোতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। আর সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী তাদের অ্যাজেন্ডাকে বাস্তবরূপ দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে। নিজস্ব অর্থায়ন ও দানে চলা মাদরাসাগুলোর ওপর তো সরকারের জোর চলে না, কিন্তু বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ওই সব মাদরাসা ও মক্তব বন্ধ ও ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু করেছে, যারা সরকারি সহায়তায় চলে। এ ধারাবাহিকতার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্য আসামে। চলতি বছরের শুরুতে আসাম অ্যাসেম্বলিতে এমন এক বিল পাস করা হয়েছে, যার কারণে সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোকে এক ধাক্কায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোকে স্কুলে পরিবর্তন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা অ্যাসেম্বলিতে এই বিল উপস্থাপন করতে গিয়ে যা বলেন, তা তার অ্যাজেন্ডা ও মানসিকতাকে সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট করে দিয়েছে। তিনি সরকারি মাদরাসাগুলোকে সাধারণ স্কুলে পরিবর্তন করার বিল উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘সকল মাদরাসা হাইস্কুল ও মিডল স্কুলে পরিবর্তন হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভোটের প্রয়োজন নেই। আমরা কারো মুখাপেক্ষী নই। এই সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের কোনো স্বার্থ জড়িত নয়। আমরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এই সম্প্রদায়কে উন্নত বানাতে চাই। যখন ছেলেরা এই স্কুল থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হবে, তখন আপনারা এটি বুঝতে পারবেন।’ আসামের শিক্ষামন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সম্পর্কে বলার প্রয়োজন নেই যে, তিনি উগ্রপন্থা মানসিকতার অধিকারী। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, বিগত দিনে যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসির মামলা চলছিল, তখন আসামে নামসর্বস্ব অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে বহিষ্কার বা তাদের ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অগ্নিঝরা বক্তৃতা তিনিই করেছেন।

এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আপনারা মুসলমানদের ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান, তা হলে তাদের জন্য মুসলিম এলাকাগুলোতে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ কেন খুলছেন না? এসব মাদরাসাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছেন কেন, যা মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণ করে? অ্যাসেম্বলিতে এ বিল উপস্থাপন করা হলে এতে কংগ্রেস এবং এআইডিএফ অ্যাসেম্বলি থেকে ওয়াক আউট করে। তারা এ বিলটি সিলেকশন কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি জানালেও এটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। স্পিকার এই বিলকে কণ্ঠভোটের মাধ্যমে পাস করার সিদ্ধান্ত নেন। তুমুল হট্টগোলের মধ্য দিয়ে বিলকে সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে পাস করিয়ে দেয়া হয়। বিজেপির জোটভুক্ত দল আসাম গণপরিষদ ও বোড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট সরকারের এ পদক্ষেপের পক্ষ নেয়। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘তিনি কোনো সম্প্রদায়ের বিরোধী নন। মৌলবাদের বিরোধিতা করা ইসলামের বিরোধিতা করা নয়।’ তিনি বলেন, ‘কিছু মুসলিম সন্তানকে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার বানানো কখনো ইসলামের শত্রুতা হতে পারে না।’ তিনি এ প্রসঙ্গে ভারতের সংবিধান রচয়িতা ড. আম্বেদকরের এ উদ্ধৃতিও দেন যে, শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় নির্দেশনার কোনো স্থান থাকা উচিত নয়। তিনি এ কথাও বলেন, ‘সরকারে অর্থে কুরআনের শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে না। এসব মাদরাসায় ভগবৎগীতা, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা দেয়া হয় না।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘এ বিল কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতার ভিত্তিতে আনা হয়নি, বরং এটার উদ্দেশ্য সমাজের একটি পিছিয়ে পড়া ও নিষ্পেষিত শ্রেণীকে উপরে ওঠানো এবং তাদের পশ্চাদপদতাকে দূর করা।’

বাহ্যত মুসলিম ছাত্রদের ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার বানানোর কথা এতটা মনোরম ও আকর্ষণীয় যে, কেউই তার গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এখানে মৌলিক প্রশ্ন এই যে, রাষ্ট্র মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়েই তাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কেন বানাতে চাচ্ছে? এ কাজের জন্য পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনপদগুলোতে আধুনিক শিক্ষার স্কুল খুলে এই চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। বাস্তবে আধুনিক শিক্ষার আড়ালে এসব মাদরাসাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য- ভারতে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে তছনছ করা এবং মুসলমানদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ বানানো। এর সূচনা করা হয়েছে সরকারি মাদরাসা থেকে। এরপর পুরো আশঙ্কা রয়েছে যে, এরপর ওই সব মাদরাসার ওপর হাত দেয়া হবে, যেগুলো সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এর সংখ্যা ভারতে মোটেও কম নয়। প্রতিটি প্রদেশে এমন মাদরাসা বিদ্যমান রয়েছে, যারা মুদাররিসদের বেতন সরকার থেকে গ্রহণ করে থাকে। আর এ বেতন এ জন্য দেয়া হয় যে, মাদরাসাগুলো সীমিত উপকরণের ভেতর নিরক্ষরতা দূর করার সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ভারতের নিরক্ষরতার ব্যাখ্যা অনেক ব্যাপক। আর যদি কোথাও কেউ সেটি দূর করার চেষ্টা করে, সে সরকারি সহায়তা পাওয়ার হকদার। এ ব্যাপারে মাদরাসাগুলোর ভূমিকা বেশ ইতিবাচক ও গঠনমূলক। কোনো সরকারি অবকাঠামো ছাড়া মৌলিক শিক্ষাকে ব্যাপক করা অনেক বড় একটি কাজ, যা সারা ভারতে ধর্মীয় মাদরাসাগুলো আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। ভারতে অপর কোনো সম্প্রদায়ের কাছে এ ধরনের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই কয়েকটি সরকারি প্রতিবেদনে মাদরাসাগুলোর এই মূল্যবান অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

আসামের নতুন আইন দু’টি বিদ্যমান আইনকে বাতিলের জন্য আনা হয়েছে। আইন দু’টি হচ্ছে ১৯৯৫ সালের আসাম মাদরাসা এডুকেশন অ্যাক্ট এবং ২০১৮ সালের মাদরাসা চাকরি সম্পর্কিত আইন।

আসামে বর্তমানে সরকারিভাবে দুই ধরনের মাদরাসা চালু রয়েছে। তন্মধ্যে বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের অধীনে রয়েছে ১৮৯টি মাদরাসা হাই সেকেন্ডারি স্কুল। এ ছাড়াও ৫৪২টি মাদরাসা রয়েছে স্টেট মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের অধীনে, যেগুলোকে প্রি-সিনিয়র, সিনিয়র ও অ্যারাবিক কলেজ বলা হয়। প্রাদেশিক সরকার নতুন আইনের অধীনে স্টেট মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডকে দুর্বল করতে চলেছে। এসব মাদরাসাতে যেসব শিক্ষক ধর্মীয় শিক্ষা দেন, তাদের অন্য বিষয়ে পাঠদানের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং তারা কুরআন ও হাদিস পাঠদান থেকে বিরত থাকবেন। এ ব্যাপারে ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য রাষ্ট্র এতটুকু অবশ্য করেছে যে, প্রদেশগুলোতে চলমান সংস্কৃত পাঠশালাগুলোকে এখন থেকে স্টাডি সেন্টার বা রিসার্চ সেন্টার বলা হবে। অবশ্য তাদের পাঠ্যসূচি ও উদ্দেশ্যে কোনো রদবদল হবে না।

মাদরাসার ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠী বিজেপির যে চিন্তাধারা, তা কারো কাছে গোপন নেই। শাসক দলের লোকজন এসব মাদরাসাকে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর কেন্দ্র ও মুসলমানদের মৌলবাদী বানানোর কারখানা নামে অভিহিত করে আসছে। এই অনর্থক প্রোপাগান্ডার একটাই উদ্দেশ্য, মাদরাসাগুলোর বদনাম করে তাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করা। এর পেছনে যে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র কাজ করছে তা হচ্ছে, যেকোনোভাবেই হোক ভারত থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে হবে। মাদরাসাগুলোকে যেহেতু ‘ইসলামের দুর্গ’ বলা হয়, এ জন্য সেগুলোকে ধ্বংস করে আধুনিক শিক্ষার স্কুলে পরিবর্তনের কাজ শুরু করা হয়েছে। এ কথা খুব কম লোকই জানে যে, আরএসএসের অঙ্গসংগঠন রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চে মাদরাসাগুলোর তদারককারী একটি শাখা রয়েছে, যাকে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নাম দেয়া হয়েছে। এ শাখা ওই মাদরাসাগুলোর ওপর গভীর দৃষ্টি রাখে, যারা যেকোনোরূপে সরকারি সহায়তা নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চের কাছে সারা ভারতের মাদরাসাগুলোর তালিকা রয়েছে। আর এ সংগঠন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাদের মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। আসামে সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলো বন্ধ করার কাজ এই সংগঠনের ইশারাতেই করা হয়েছে। এটি মাদরাসা কর্তৃপক্ষদের জেগে ওঠার সবচেয়ে সঠিক সময়। কেননা দ্বীনি মাদরাসাগুলোকে বিদ্যমান পাঠ্যসূচিসহ টিকিয়ে রাখা খুব জরুরি।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ০৪ জানুয়ারি,
২০২১ সংখ্যা হতে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালকের বিদায়ী সাক্ষাৎ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা চুয়াডাঙ্গায় বিজিবির অভিযানে ৪টি স্বর্ণের বার উদ্ধার স্বামীসহ সাবেক এমপি হেনরীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা সিলেটে ৫ হাজার কোটি টাকার দুই ‘মেগা’ প্রকল্প বাতিল পৌনে চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে ট্রেন যাবে খুলনায়, কাল উদ্বোধন দেশে ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্র এখনো চলছে : বিএনপি মহাসচিব চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নাজেহাল করার ঘটনায় জামায়াতের নিন্দা শ্রম সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাবনা পেশ করেছে পোশাক শ্রমিক নেতারা স্বামীর পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা

সকল