আমাদের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য
- মুহম্মদ মতিউর রহমান
- ১০ মার্চ ২০২১, ১৯:৫৫
‘স্বাধীনতা’ ও ‘সংস্কৃতি’ দু’টি আলাদা ও স্বতন্ত্র অর্থবোধক শব্দ। স্বাধীনতা শব্দের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। অন্য দিকে সংস্কৃতি শব্দের সাথে মানুষের জীবনদৃষ্টি, রুচিবোধ, শিল্প-সাহিত্য ও পরিশীলিত-পরিমার্জিত জীবনাচারের সম্পর্ক বিদ্যমান। ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তার মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্যসূত্র রয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী এক স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে। এ স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিনির্মাণের মূল উপাদান ইসলাম। ইসলাম গতানুগতিক কোনো ধর্ম নয়, এটি মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ফলে পৃথিবীর যেখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেখানেই মুসলিমদের এক স্বতন্ত্র সমাজ গড়ে উঠেছে। বিশ্বাস পরিবর্তনের সাথে আমল ও আখলাকের পরিবর্তন ঘটেছে। আচার-আচরণে, পোশাক-আশাকে, খাদ্য-খাওয়া, চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা, সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব-আনন্দ, আইনকানুন প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ-কাল-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র এটি ঘটেছে।
বাংলাদেশেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। বলা হয়ে থাকে যে, এ দেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই বেশির ভাগ ইসলাম গ্রহণ করেছে। জাতিভেদ প্রথার কারণে হিন্দুধর্মে নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা নানাভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত হয় দীর্ঘকাল থেকে। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের কাছে সমমর্যাদা দূরে থাক, ন্যূনতম মানবীয় মর্যাদাও পায়নি। কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, ধোপা-নাপিত, মিস্ত্রি-জেলে প্রভৃতি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা সর্বদা উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের জীবনযাপনকে আরামপ্রদ করার কাজে ব্যাপৃত থাকলেও বিনিময়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবহেলা-অবজ্ঞা এমনকি লাঞ্ছনা-দুর্গতিই তাদের অনিবার্য ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়। সাম্য-ভ্রাতৃত্ব ও মানবিক ধর্ম ইসলাম তাই তাদেরকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ফলে দলে দলে তারা ইসলাম কবুল করে মানবিক মর্যাদাপূর্ণ, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সমঅধিকারপূর্ণ শাশ্বত, সুন্দর জীবনের অধিকার লাভ করে। এভাবে অত্যল্পকালের মধ্যে এ দেশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হয়।
ইসলাম গ্রহণের পর নবদীক্ষিত বাঙালি মুসলিমের আমল-আখলাক, আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, খাদ্য-খাওয়া, চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা প্রভৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। মন্দিরের পাশাপাশি নতুন স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে মসজিদ। সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিক রীতিনীতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বিচার-সালিসসহ সব ক্ষেত্রেই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটে। উপমহাদেশে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরবানি, ঈদ, শবে মেরাজ, শবে কদর, শবে বরাত, মিলাদুন্নবী প্রভৃতি চালু হয়।
হিন্দুধর্মের রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর পর মুখাগ্নি, শবদাহ, পৈতাধারণ প্রভৃতির পরিবর্তে মুসলিমরা লাশের অজু-গোসল করিয়ে, আতর-লোবান-সুগন্ধি মাখিয়ে জানাজা, দাফন-কাফন, দোয়ায়ে মাগফিরাত, কুলখানি, চল্লিশা প্রভৃতি চালু করে; যা হিন্দুরীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলিম হওয়ার পর সামাজিক রুসুম-রেওয়াজ, আদব-কায়দা, রীতিনীতিও সম্পূর্ণ বদলে যায়। কুসংস্কারের পরিবর্তে সংস্কারমুক্ত, স্বচ্ছ, সুন্দর তৌহিদি চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, নানা ছুঁৎমার্গের পরিবর্তে সাম্য-ভ্রাতৃত্বপূর্ণ উদার মানবিক আদর্শে জীবন পরিচালনা করা, কুরআনের বিধানানুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিবেশী তথা সমাজের প্রতিটি মানুষের হক আদায় করা, বিচার-সালিস, বিবাহ-তালাক, সম্পত্তির অধিকার, ঈদ, কোরবানি ও অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবাইকে সমভাবে অংশীদার করাসহ সব ক্ষেত্রে এক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নতুন জীবনধারার বিকাশ ঘটে। বিশ্বাস বা ধর্মের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের উদ্ভব। এ সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের কারণে একই ভৌগোলিক এলাকায়, অভিন্ন জলবায়ুর অধীনে বসবাস করা সত্ত্বেও বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের জীবনধারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।
ফলে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার সময় ভারতীয় মুসলিমরা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। মুসলিমদের ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যই মূলত এ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি বলিষ্ঠতর করে। অবশ্য মুসলিমদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এ দাবি এক দিনেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। ইংরেজ আমলে হিন্দুরা শাসকশ্রেণীর আনুকূল্য পেয়ে একে একে জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সব কিছু হস্তগত করে সর্বক্ষেত্রে মুসলিমদের বঞ্চিত করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা দিন দিন নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়। সমাজের সব ক্ষেত্রে মুসলিমরা অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টারের ভাষায়, এক শ’ বছর আগে যে মুসলিমদের গরিব হওয়া অসম্ভব ছিল, তাদের পক্ষে এখন ধনী বা বিত্তবান হওয়া অসম্ভব। এ ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও উপেক্ষার ফলে মুসলিমরা নিজেদের ভাগ্য গড়ার ক্ষেত্রে স্বাধিকার অর্জনের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করে। ইংরেজ আমলে মুসলিমরা সব ক্ষেত্রে বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হয়েছে, অখণ্ড ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে তারা অধিকতর বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হবে, এ কথা ভেবেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিমদের জন্য এক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে।
অবিভক্ত ভারতে হিন্দুরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা ইংরেজ আমলে মুসলিমদের নানাভাবে শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন করেছে। অখণ্ড ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিমদের ন্যায্য দাবি সর্বদাই উপেক্ষিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদ্বিষ্ট হিন্দুদের দ্বারা তাদের ভাগ্যোন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। সামাজিক মর্যাদা ও সমঅধিকার লাভের কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। এটি কোন ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত ব্যাপার নয়, বর্তমান ভারতের দিকে তাকালেই আমরা এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারি। ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও ভারতীয় মুসলিমরা সর্ব ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও পদানত। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, চাকরি-বাকরিসহ সব ক্ষেত্রে তারা কোণঠাসা হয়ে আছে। এমনকি সেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিলোপ করা হয়েছে, মসজিদ ভেঙে মন্দির করা হচ্ছে, অসংখ্য মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সামান্য কারণে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে, মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালের গুজরাটের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে এ রকম হাজার হাজার নৃশংস ঘটনা সেখানে সংঘটিত হয়েছে। এ দুর্বিষহ অমানবিক অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যই ব্রিটিশ-ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা নিয়ে স্বতন্ত্র, স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। ভারতীয় মুসলিমদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং অধঃপতিত অবস্থা থেকে উন্নতি লাভের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের কোনো বিকল্প ছিল না।
তাই দেখা যায়, হিন্দু-কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যখন স্বাধীন ভারতে রাম-রাজত্ব কায়েমের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, হিন্দু কবি-সাহিত্যিকরা যখন ‘ভারত-মাতার’ বন্দনা-গীতি গেয়ে সব ভারতবাসীকে ‘একদেহে লীন’ হওয়ার আহ্বান জানালেন তখন ভারতীয় মুসলিমরা আপন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের গৃহীত ‘লাহোর প্রস্তাব’ অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র কায়েমের দাবি ছিল বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিশেষত মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী ও পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতের পূর্বাঞ্চলে বঙ্গ এবং পশ্চিমাঞ্চলে পাঞ্জাব বিভক্ত করার জন্য জেদ ধরেন। তা ছাড়া আসাম, মেঘালয় তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাকে পূর্ববঙ্গ থেকে আলাদা করে ভারতীয় ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়।
অন্যথায় অবিভক্ত বাংলা, আসাম তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হওয়া ছিল তখনকার বাস্তবতার অনিবার্য দাবি। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম না হলেও ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উভয় এলাকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি রাষ্ট্র কায়েম হয়। ইংরেজ ও হিন্দু এ দুই প্রবল প্রতিপক্ষের বিরোধিতা সত্ত্বেও উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য যে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটিও এক বিরাট সাফল্য।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি মুসলিমদের প্রত্যাশা আংশিক পূরণ হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম অন্য ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। ইসলামের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হলেও পাকিস্তানে মুসলিম ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে সুন্দর, কল্যাণময়, আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এ ছাড়া যে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় বাঙালি মুসলিমরা স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে একাধারে শাসক ইংরেজ ও উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের সে প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। তার ওপর শুরু হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করার ষড়যন্ত্র। ফলে পর্যায়ক্রমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ, স্বায়ত্তশাসন, ছয় দফা, এগারো দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য যুগ যুগ ধরে আমাদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তা গড়ে তুলেছে এবং যে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ-স্বাবলম্বী সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাঙালি মুসলিমদের ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, ১৯৭১ সালে সে দুর্মর স্বপ্নই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, তার জন্মসূত্র হাজার বছর আগে ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক স্বতন্ত্র মুসলিম সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জাতিসত্তার ভিত্তিমূলে।
তাই বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতার মূলভিত্তি ইসলাম, ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও সে স্বাতন্ত্র্য-চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতিসত্তার পূর্ণ পরিণত রূপ হলো স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীনতা একধরনের মানসিক অনুভূতি, একধরনের অঙ্গীকার। একে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থায়ীভাবে দাঁড় করাতে হলে চাই একটি প্রাণবন্ত আদর্শ, গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য ও সুস্পষ্ট মানবিক মূল্যবোধ। আমাদের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক সত্তার মধ্যেই রয়েছে তার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি।
তবে এ আদর্শ-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার পথ কণ্টকমুক্ত নয়। স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ধার করা নীতি বা আদর্শ দিয়ে কোনো জাতি বা রাষ্ট্র গড়ে ওঠে না এবং টিকেও থাকে না। নিঃসংশয়িতভাবে সবাইকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার অপরিহার্য তাগিদে আমাদের ভৌগোলিক সীমানা রক্ষা যেমন জরুরি, আমাদের আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণও তেমনি সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যে জাতির কোনো মহৎ আদর্শ, নিজস্ব গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক পরিচয় নেই, সে জাতি কখনো আপন অস্তিত্ব ও মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকে না। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমাদের রয়েছে ইসলামের অতুলনীয় প্রাণবন্ত মহান মানবিক আদর্শ, হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য এবং এক সুস্পষ্ট পরিশীলিত উন্নত সাংস্কৃতিক জীবনধারা। তাই পৃথিবীতে সগৌরবে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার উপযোগী সব উপকরণ আমাদের বিদ্যমান। এ আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঔদাসীন্য বা বিদেশী আদর্শের অনুসরণ করার অর্থ আমাদের জাতিগত পরিচয়, স্বাধীনতা তথা স্বকীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা। এ আত্মঘাতী প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিকের অপরিহার্য কর্তব্য।
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা