Boss is always right
- ফ্লোরা সরকার
- ০২ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৪
আমাদের অফিস-আদালতে ভীষণ ভুল একটা শিক্ষা দেয়া হয় এবং সেটা হলো - Boss is always right. ব্রিটিশদের দেয়া এই শিক্ষা আমরা এখনো মাথা পেতে পালন করি। চাকরি জীবনের শুরু থেকে অনেক অফিসের সেক্রেটেরিয়েট টেবিলের কাচের নিচে এই লেখা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকতে দেখেছি। উপনিবেশিক শক্তি চলে যা, কিন্তু উপনিবেশিক মনটা থেকে যায়। যে মন উপনিবেশিক শক্তির চেয়েও শক্তিশালী। এই প্রসঙ্গে কেনিয়ার সাহিত্যিক এবং লেখক গুগি ওয়া টি ওঙ্গোর 'ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড' বইয়ের একটা অংশ তুলে ধরছি, 'কৃষ্ণাঙ্গদের মহাদেশে যে কেউ বুঝতে শুরু করে আসল ক্ষমতা প্রথম প্রত্যুষের গোলার মধ্যে নয়, বরং গোলার পরে যা এসেছে সেটার মধ্যেই নিহিত। কাজেই গোলার পেছনেই ছিল নতুন স্কুল। আর নতুন স্কুলের ছিল গোলা আর চুম্বক উভয়েরই স্বভাব। গোলার কাছ থেকে নিয়েছে যুদ্ধবাজি অস্ত্রের দক্ষতা। কিন্তু গোলার চেয়েও বেশি স্থায়ী বিজয় অর্জন করেছে নতুন স্কুল। গোলা শক্তি প্রয়োগ করে শরীরের ওপর। আর স্কুল দুর্বার আকর্ষণে টানে আত্মাকে।'
গুগি এখানে স্কুল বলতে ভাষাকে বুঝিয়েছেন। কোন ভাষা? ইংরেজি। অর্থাৎ আফ্রিকা দখল করে ইংরেজরা স্কুলগুলোতে ইংরেজি ভাষা চর্চার যে প্রচলন করে আফ্রিকানদের যে ভয়াবহ ক্ষতি করেছিল তার কথাই বলছেন গুগি। শত্রুর গুলি বা গোলা শরীরের ক্ষতি করে কিন্তু শত্রুর মতাদর্শ, ভাষা, সংস্কৃতি আত্মার যে ক্ষতিসাধন করে সেটা অপূরণীয়। আমাদের অবস্থাও অনেকটা এইরকম। ইংরেজ চলে গেছে বহু বছর, কিন্তু তাদের দেয়া আইন, অভ্যাস, আচরণ ইত্যাদি এখনো আমরা পালন করে চলি। আর তাই অফিসে (সরকারি অফিস) প্রথমেই শেখানো হয়, বস সময় ঠিক। বস তো আল্লাহ্ বা ঈশ্বর নন, যে তার কোনো ভুল হতেই পারে না। এবং এই চর্চা করতে করতে আমরা এমন এক জায়গায় যেয়ে পৌঁছেছি যে আমি যা শিখেছি, আমি যা জেনেছি সেটাই ঠিক, অপর যা বলে, যা জানে সেটা ভুল বা ঠিক না। তাছাড়া নব্য উপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকেও আমরা অনেককিছু আত্মস্থ করে চলেছি। বিস্তারিত সেদিকে গেলাম না।
আমাদের বহুমতে বিভক্ত এই সমাজে নিজের মতে অনড় থাকা একধরনের অসুস্থতা। আরো পরিচ্ছন্ন করে বললে সহনশীলতার অসুস্থতা। এক ধরনের ঈর্ষা করার অসুস্থতা। নিজের মতামতকে টপকে অন্যের মতামত উপরে উঠে যাবার ঈর্ষার অসুস্থতা। অপরের মতামত সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত হলেও, সেই সত্য মেনে না নেয়ার অসুস্থতা। আমরা কমবেশি সবাই এই রোগে আক্রান্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়ে না। স্বাভাবিক সময়ে এই রোগ ভদ্রবেশি শয়তান সেজে থাকে। চিন্তার গভীরে লুকিয়ে থাকে। সময় মতো অর্থাৎ নিজের মতের অমিল হলেই রোগটা টুপ করে বেরিয়ে আসে এবং উল্টাপাল্টা গালিগালাজ (রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রেফতার) শুরু হয়ে যায়। এটা যে কী ভীষণ এক রোগ! একবার এক প্রামাণ্যছবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের একটু আগে, একজন তথাকথিত প্রগতিশীল প্রামাণ্যছবির পরিচালকের সাথে গল্প করছিলাম। ভদ্রলোক বেশ আনন্দের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎ সেখানে নিমন্ত্রিত অতিথির মাঝে ওই পরিচালকের বিপরীত মতাদর্শের একজনকে দেখে, তার মুখটা কালো হয়ে গেল। তার মুখের ভাবান্তর আমার চোখ এড়ালো না। জিজ্ঞেস করতেই ওই ভদ্রলোক বললেন, এতক্ষণ তো ভালোই লাগছিল, কিন্তু এই লোকটাকে (নিমন্ত্রিত সেই অতিথি) দেখে মুডটাই অফ হয়ে গেল। এই হলো আমাদের সহনশীলতা। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম মাত্র।
সমাজের এই রোগটা নিয়ে একটু গভীরে যাওয়া যাক। রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে নয় (রাষ্ট্রের চরিত্রই নিপীড়নমূলক) সমাজের জায়গা থেকে এই রোগের ভয়ানক দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সমাজ ঠিক থাকলে, রাষ্ট্র ঠিক হতে বাধ্য।
সমাজের চরিত্র সঠিকভাবে সনাক্ত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়, আমাদের। ধরা যাক, কোনো এক লোক নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিলেন বা লিখলেন ক ও খ বিষয় নিয়ে। এই ক ও খ বিষয় দুটি বিপরীতমুখী মতাদর্শের দুটি বিষয়। দুটি সাংঘর্ষিক মতাদর্শ। এখন যে লোকটা এই দুই মতাদর্শের ওপর বক্তৃতা দিলেন বা লিখলেন, উনি এমনভাবে লিখলেন যেখানে দুটো বিষয়েরই মন্দ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। মজাটা হলো, ক মতাবম্বীরা খ-এর ওপর যে ঝাড়িগুলো দেয়া হয়েছে সেটার ভূয়ষী প্রশংসা করবে ঠিক কিন্তু ক মতাদর্শগুলোর উপর যে বিষোদগারগুলো করা হয়েছে সেই বিষয়ে প্রচন্ড রাগান্বিত হবে বা মারমুখী হয়ে উঠবে। একই কাজ খ পন্থীরাও করবে। কিন্তু এটা লক্ষ্য করবে না যে ভদ্রলোকটি দুটি বিষয়েরই মন্দ দিকগুলো তুলে এনেছেন এই কারণে যে ক বা খ মতাদর্শের ভেতর যে ত্রুটিগুলো আছে, ক বা খ পন্থীরা ওই ত্রুটিগুলো নিয়ে যেন চিন্তা বা সমালোচনা বা পর্যালোচনা (অর্থাৎ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মন্দ বিষয়গুলো যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা) করার অবকাশ পান। নিজেদের চেহারাটা সঠিকভাবে যেন আয়নায় দেখতে পান (আমরা আয়নায় শুধু নিজেদের চেহারা দেখি, নিজেদের দেখি না)। হয়তো সেই বেচারা লোকটি ক বা খ কোনো পক্ষেরই না। স্রেফ ভুল বা সমস্যাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্যেই বক্তৃতা দিয়েছেন বা লিখেছেন। এই যে নিজেদের মতাদর্শের গুণ বা প্রশংসা শোনার আকুতি এবং দোষ বা ত্রুটি না শোনার বিকৃতি, এই দুইয়ের মাঝে সেই রোগের বসবাস। আমরা শুধু ধর্মের মধ্যেই অন্ধবিশ্বাস দেখি। অথচ চরিত্রগতভাবেই যে আমরা অন্ধবিশ্বাসী এক জাতি সেটা ভেবে দেখি না। আমরা নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ বলে চিৎকার চেঁচামেচি করি, কিন্তু নিজেরা থাকি নিজেদের অনড় অবস্থানে। আমাদের চরিত্রের এই অনড়তাই এই রোগের মূল কারণ। আমরা নড়াচড়া করতে চাই না কিন্তু প্রগতিশীল হতে চাই। চরিত্রের এই দ্বিচারিতাও এই রোগের আরেকটা কারণ। একদিকে দ্বিচারিতা করি, আবার অন্যদিকে অনড় থাকি। আমাদের চরিত্রের এসব জটিল দিকগুলো যদি পরিচ্ছন্ন না করি তাহলে শতমতের এই সমাজে আমরা কোনভাবেই একসঙ্গে বসবাস করতে পারব না। এমনকি সমাজ তো দূরে থাক, এক পরিবারের মধ্যেও আমরা সহাবস্থান করতে পারব না।
অন্যের মতামতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মধ্যে কোনো বাহাদুরিত্ব নেই। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া, ধৈর্য নিয়ে ওইসব মতামত সঠিকভাবে বিশ্লেষণের মধ্যেই বরং কৃতিত্ব থাকে। এসব সহনশীলতার অভাবের কারণে আমরা থিসিস, এ্যান্টি-থিসিস পার হয়ে সিনথেসিসে পৌঁছাতে পারি না। শুধু এ্যান্টি-থিসিসে ঝুলে থাকি। ঝুলে থাকা সমাজ কখনো কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে না, কল্যাণ তো নিয়ে আসেই না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা