২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘কইলে কথা, করলে কী’

-

স্কুলজীবনে প্রিয় শিক্ষকদের একজন ছিলেন জায়েদ আলী স্যার। শিক্ষার্থীদের থেকে কিভাবে পড়া আদায় করে নিতে হয়, তা তিনি জানতেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর তার তত্ত্বাবধানে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ভোটে মনিটর নির্বাচিত হয়েছিলাম। মনিটরের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন। সবই ঠিকঠাক চলছিল। একদিন স্যার ক্লাসে এসে দেখলেন, টেবিলে ময়লা। ডেকে নিয়ে বেত দিয়ে এমন আঘাত করলেন সাথে সাথে আমার ডান হাতের তর্জণী ফুলে নীল হয়ে গেল। এই শাস্তি দেয়ার সময় মুখে একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তিনি, ‘কইলে কথা, করলে কী’?। কারো কথার সাথে কাজে মিল না থাকলে প্রায়ই কথাটি বলতেন। সেই দিনের শিশুমনে গেঁথে যাওয়া ওই উক্তির মর্মার্থ উপলব্ধি করেছিলাম। দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত হয়ে যে তা পালনে ব্যর্থ হয় তাকে তার দায়ভার বইতে হয়।

আজকের বৃহত্তর সমাজে, কিছুটা পরিপক্ব মস্তিষ্কে যখন চার পাশের অসঙ্গতি, অন্যায়, দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যের অনিষ্ট করতে দেখি; তখন স্যারের কথাটি মনে পড়ে যায়। আর ভাবি, তারাও তো কোনো-না-এমন কোনো আদর্শবান শিক্ষকেরই ছাত্র ছিলেন। তারাও তো শিশুমনে একজন সৎ ব্যক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই বাসনা অনেকের হৃদয় থেকে উবে যেতে থাকে। একসময় লোভ-লালসা, ক্ষমতাবান হওয়ার খায়েশ, অর্থ-বিত্তের জৌলুস কিংবা ক্ষমতাবানের কাছে আত্মসমর্পণ করে লাভবান হওয়াই পরম চাওয়া হিসেবে গণ্য হলো ।

যেমন নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অন্যতম প্রধান কাজ। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকেন যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং সরকার গঠন করে থাকেন। এ জন্য অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা এবং জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে পছন্দসই ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন সেই দায়িত্ব পালন করার কথা নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশনাররা পক্ষপাতিত্ব করবেন না, এই শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু বর্তমান সিইসিসহ সব কমিশনার শপথ নিয়ে তা কেমনভাবে তা রক্ষা করছেন, সেটি দেখে নির্বাক দেশবাসী।

১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরার সংসদ উপনির্বাচনে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ অনেক দল আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তী তিন নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ দলটির জোট অংশ না নেয়ায় ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছিলেন রকিব উদ্দীন কমিশন। কার্যত মাত্র ৭ শতাংশ ভোটার ভোট পড়লেও ৪০ শতাংশ ভোট দেখিয়ে জাতিকে ধোঁকা দিয়েছিল রকিব উদ্দিন নির্বাচন কমিশন।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও ৩০ ডিসেম্বরে যে ভোট হওয়ার কথা ছিল তা ২৯ ডিসেম্বর রাতেই ‘সম্পন্ন’ করে ৩০ তারিখে আওয়ামী লীগের বিপরীত কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দিয়ে একটি ‘তামাশার’ নির্বাচন করতে সক্ষম হয় নুরুল হুদা কমিশন। এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফল প্রকাশ করেছে, তাতে ভোট পড়ার অস্বাভাবিক চিত্র পাওয়া যায়। ‘দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এতে আরো দেখা যায়, এক হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ছয় হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে, এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি (প্রথম আলো, ২৪ জুলাই, ২০১৯)।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এ ফল বিশ্লেষণে বলেছিল, এটা কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও বলেছেন, শতভাগ ভোট পড়াটা অস্বাভাবিক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সাথে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। যেটা হয় না পৃথিবীতে কোথাও, সেটি চলতে পারে না। আমরা এটা দেখেছি শুধু মিলিটারি আমলে ডিক্টেটরদের সময়।’ তার মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেয়া উচিত। সেখানে শতভাগ ভোট কিভাবে পড়ল, সেটি নির্বাচন কমিশনের নিজেদেরই বের করতে হবে। (বিবিসি বাংলা অনলাইন, ৪ জুলাই ২০১৯)

৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেন, ‘নির্বাচন আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং একধরনের অভূতপূর্ব নির্বাচন হয়েছে, যার ফলে এ নির্বাচন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।’ (বিবিসি বাংলা, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯)

সিইসি নুরুল হুদাও স্বীকার করেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানাননি; তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)

ইসির ‘কিছুই করার নেই’ এই জায়গাটিতেই আমাদের প্রশ্ন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ গ্রহণ করেছি। আমরা সংবিধান এবং সংবিধানের অধীনে প্রণীত আইন-কানুন, বিধি-প্রবিধানের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনে অটল এবং আপসহীন থাকব। নির্বাচন কমিশনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারের অনুসরণীয় দিকনির্দেশনা কাজে লাগাব এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দক্ষতা ব্যবহার করব। আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো সরকার, কোনো দল বা কারো দ্বারা কখনো প্রভাবিত হবো না (বাংলা নিউজ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)। কিন্তু তিনি তার শপথ রক্ষা করতে পারেননি। নির্বাচনে তার ভূমিকা এবং একটি বিশেষ দল ছাড়া অন্য দলের সাথে তার আচরণ এ দেশের জনগণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি একটি দলের কাছে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো যেন দাসখত দিয়ে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়; প্রায় সবখানেই শপথ ভঙ্গের প্রতিযোগিতা চলছে। ঠাণ্ডা মাথায় নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে শুভ মানবিকতা, ন্যায়-অন্যায় বোঝার সক্ষমতা, যারা কিছু বলতে চান তাদের চুপ করিয়ে দেয়া হচ্ছে দণ্ডের ভয় দেখিয়ে। অথচ তারাই শপথ নিয়েছিলেন, এ সমাজকে রক্ষার। সব কিছু দেখে বিবেকহীন এই সমাজকে আমার শিক্ষকের মতোই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘কইলে কথা, করলে কী?’

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement