১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

করোনাকালে ধর্ষণ বেড়েছে

-

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর বাংলাদেশে ধর্ষণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে বিভিন্ন বয়সী নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বয়স্ক নারীর তুলনায় কন্যাশিশুদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বেশি। এর মধ্যে গণধর্ষণ, নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনাও আছে। নারী বিচারপ্রার্থীর দুর্বলতার কারণে প্রশাসনের কারো কারো অনৈতিক সুযোগ নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর অপরাধ লুকানোর জন্য হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষিতা লজ্জা অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছে।

ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানী সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়কেই এর জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রে দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া, জবাবদিহির অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনৈতিকতা, অদক্ষতা ও অযোগ্যতা, দলীয়করণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নৈতিক অবক্ষয়, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে দুর্বল করে তোলাসহ সব ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতিকীকরণের প্রভাব খাটানো, লোভ-লালসা ও অনেক ক্ষেত্রে নারীদের খোলামেলা চলাচলের কারণেই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি, দুর্বল ব্যক্তিত্ব ও হতাশাগ্রস্ত মানুষ এবং ক্ষমতার কারণে অহঙ্কারী ব্যক্তিরা ধর্ষণের মতো অপকর্ম ঘটাচ্ছে বেশি। মহামারীতে জবাবদিহিতা কম থাকা, চাকরি হারানো, কর্মহীন থাকা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করোনাকালীন সময়ে সীমিত দায়িত্ব পালনের কারণেও ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ১৩টি। এ সময় মোট ২২৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। আর ধর্ষণের জন্য আত্মহত্যা করেন ১০ জন। অপর দিকে ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এক হাজার ৬২৭টি। এ সময় মোট ৩২৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। আর ধর্ষণের জন্য আত্মহত্যা করে ১৪ জন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের চেয়ে বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে মহামারী চলাকালেও ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা আর এ জন্য আত্মহত্যা করার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও চিন্তিত। পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের মামলা হয় সাড়ে চার হাজার, যা আগের বছর ছিল চার হাজার ৩৩১টি। এ ছাড়াও করোনা সংক্রমণের এই সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বাইরে ঢাকা রেঞ্জের ১৭ জেলায় ৭৪৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আর ডিএমপি এলাকায় হয়েছে ৩৭২টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, করোনা মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলছে, এ জন্য মানুষের কোনো বিনোদন নেই, কোনো সামাজিক জীবন নেই, সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছে। আর এই বিচ্ছিন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, কোণঠাসা করে রাখা, মানুষের মুখ বন্ধ করে দেয়া এসবের জন্য দায়ী, এরই সাথে সারা বিশ্বে পুঁজিবাদের যে চরম অধঃপতন সেটিও এর জন্য দায়ী কম নয়। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশেও এই দুই ক্ষেত্রে অধঃপতন স্পষ্ট। একটি হচ্ছে ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরেকটি দুর্নীতিতে। ধর্ষণ আর দুর্নীতি কিন্তু আলাদা নয়, দু’টিই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ। মনোচিকিৎসক অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, পর্নোগ্রাফি ধর্ষণের মতো অপরাধ আরো উসকে দিচ্ছে, এতে মানুষের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ শেষ করে দিচ্ছে। যারা পর্নোগ্রাফির জগতে ঢুকে পড়ে তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়। এতে ধর্ষকরা একজন নারীকে দেখামাত্রই তাকে ‘ভোগ্যপণ্য’ বলে মনে করে। আর সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে শক্তি ও আধিপত্যের প্রভাব এবং অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক তাড়নার কারণেই সাধারণত ধর্ষকরা এমন সব জঘন্য অপরাধ করে।

বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে কিশোর ও তরুণ তথা সমাজের সব মানুষের ভালোভাবে সময় কাটানোর পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, সেই সাথে চলাচলের শিথিলতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া, বিচারপ্রার্থীর পক্ষে আদলতে সাক্ষীর বারবার গিয়ে সাক্ষী দেয়ার অনীহা, পারিবারিক ও আত্মসম্মানের কারণে মামলা না করাসহ মহামারীতে জবাবদিহিতা কম থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে।

যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধানবিরোধী দলসহ দুই বিরোধীদলীয় নেতাই নারী সে দেশের নারীর অগ্রযাত্রাকে পেছনে ফেলে নারী নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ায় সমাজের সুশীল ব্যক্তিদের অনেকেই আতঙ্কিত। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটা শান্তিময় এবং নিরাপদ সুন্দর পৃথিবী দিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ও পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন এবং প্রত্যেকের আচার-আচরণে, কাজে-কর্মে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে লোভ-লালসা পরিহার করে নারীরা আরো অধিক সচেতন হয়ে পারিবারিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাজ করে যাবে এমনটাই জাতি প্রত্রাশা করে। আর তাতেই নারী নির্যাতনের মাত্রা অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : প্রকাশক, অর্থনীতির ৩০ দিন ও মানবাধিকার কর্মী


আরো সংবাদ



premium cement
পেকুয়ায় ডাম্পট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ৪ ভিয়েতনামে বিনোদন কেন্দ্রে আগুন, মৃত্যু ১১ গুমের সাথে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা, নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র গুমে জড়িত ২০ সেনা-র‌্যাব-পুলিশ কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা কুলাউড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় যুবক নিহত মিয়ানমার নিয়ে বৈঠকে বাংলাদেশ, ভারত, চীনের যেসব হিসাব-নিকাশ সাকিবের বিদায়, ফাইনালে সাব্বির-মোসাদ্দেকের দল প্রধান উপদেষ্টা আজ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারতে লঞ্চে ধাক্কা নৌবাহিনীর স্পিড বোটের! মৃত ১৩ পণ্যশুল্ক নিয়ে মোদিকে হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

সকল