১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩০, ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - ছবি : সংগৃহীত

জন্মগতভাবে মানুষের মাঝে কোনো কিছু অর্জনের লক্ষ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটে থাকে। চেতনার আলোকে মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ কোনো কিছু বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালি জাতি প্রাচীনকাল থেকে আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মূলত বঙ্গভূমি বা বাংলাদেশ হিমালয় পর্বতের অববাহিকা এবং নদীবিধৌত উর্বর পলি ভূমি দ্বারা গঠিত একটি ভূখণ্ড। ভৌগোলিকভাবে এ দেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর যে কারণে এ দেশে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। উর্বর ভূমিতে প্রচুর ফলদ ও বনজ বৃক্ষ জন্মে। অপর দিকে খাল-বিল, নদী-নালাতে এ দেশ ভরপুর। এ কারণে এ দেশের নদী-নালাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। সে কারণে বলা যায়, প্রাকৃতিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে এ দেশের সম্ভাবনা অপার। অপর দিকে প্রচুর নদী-নালা ও খাল-বিল জালের মতো এ দেশে ছড়িয়ে রয়েছে, যে কারণে নৌপথে চলাচলের প্রচুর সুবিধা রয়েছে। মধ্য এশিয়া থেকে আগত বিদেশীরা এ দেশে স্থলপথে বারবার আগ্রাসন চালিয়েছে। বাঙালি জাতি যথাসাধ্য তাদের প্রতিহত করেছে। অপর দিকে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে নৌপথে আগমন করেছিল। নৌপথের আধিক্য থাকায় ইউরোপীয়রা সহজেই বাংলাদেশে তাদের ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। মূলত এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদই চিরকাল বিদেশীদের আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সে কারণে বারবার বাঙালিরা মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদেশীদের প্রতিহত করেছে। পাঠান মোগল মারাঠা এবং ব্রিটিশ ও ইউরোপের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করেছে।

১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ বিতাড়নের পর বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্গত একটি প্রদেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশ ছিল। পূর্ব পাকিস্তান তার মধ্যে একটি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের আশ্রিত হিসেবে ভাবতে শুরু করে। অথচ জনসংখ্যার বিচারে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তানের অপর চার প্রদেশের সম্মিলিত জনগোষ্ঠী থেকে অধিক ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরপরই দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটে। একনায়কসুলভ মানসিকতা নিয়ে গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ বাঙালিদের ওপর উর্দু ভাষা দৃশ্যত চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি আঘাত হানেন। বীর জাতি সম্মিলিতভাবে এ অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার সমর্থনে তার দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদের পথ ধরে জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সাংগঠনিকভাবে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সর্বপ্রথম প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ডাকসুর নেতৃত্বে এ আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। পরে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতারা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ফলে আন্দোলন অচিরেই জাতীয় আন্দোলনে রূপ লাভ করে। প্রতিবাদী বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়ে ওঠে। মূলত আমাদের স্বাধীনতার চেতনার মূল চালিকাশক্তি ছিল ভাষা আন্দোলন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিকার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশে একটি পোস্টার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর শিরোনাম ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ সে পোস্টারে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্যের চিত্র পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা ছাড়াও শিক্ষা-উপকরণের কাগজ ও অন্যান্য দ্রব্যের তুলনামূলক বাজার দর ওই পোস্টারে ছাপা হয়েছিল। বাঙালির সাথে বৈষম্যমূলক এ আচরণ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সর্বোপরি চাকরির বৈষম্য ছিল অবর্ণনীয়। সিভিল সার্ভিসসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালির প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত। বিশেষত সামরিক বাহিনীতে তাদের চাকরির কোটা ছিল অত্যন্ত সীমিত। জন্মসূত্রে দৈহিক খর্বতা ও স্বাস্থ্যহীনতার ধুয়া তুলে বাঙালির সামরিক বাহিনীতে চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।

অধিকারবঞ্চিত বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। জাতির এ চেতনাই ছিল মুক্তির চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা জানি, ভাষা সংগ্রামের অগ্নিঝরা আন্দোলনে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতার বুকের রক্ত ঝরেছিল। মূলত আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতারা বাঙালি জাতির মুক্তির দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এক পর্যায়ে মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকে। মূলত ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির পথের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার সে কালজয়ী ভাষণ অদ্যাবধি জাতির হৃদয়কে আন্দোলিত করে। এ ভাষণে তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত স্বাধীনতা ঘোষণার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। অবশ্য বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা ও ১১ দফাতে ধর্মীয় বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ভাষা আন্দোলন ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে বাঙালি জাতি বন্ধুর পথ অতিক্রম করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্রিটিশদের অনুসৃত ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির অনুকরণে বাঙালির মুক্তির চেতনাকে অবদমন করার জন্য ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের সে অপতৎপরতার ফাঁদে পা দেইনি। ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিক, দল, মত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেদিন বাঙালি জাতি মুক্তির চেতনায় পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর কোনো ভাষণেই তিনি ধর্ম বিভাজনের কথা উল্লেখ করেননি। অথচ স্বাধীনতার পরে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিশেষত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে ইসলামবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত হন। এর ধারাবাহিকতা আজো অব্যাহত রয়েছে নানাভাবে। আমরা জানি, বামপন্থীদের অনেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সশস্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। যেমন- তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে খুলনার ডুমুরিয়া থানা ‘মুক্ত’ করে সে অঞ্চলকে ‘মুক্ত অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে জাসদ গণবাহিনী সশস্ত্র বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়েছিল।

১৯৭৪ সালে তারা সশস্ত্রভাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর মাঝেও কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন। সর্বোপরি, বাম আদর্শে বিশ্বাসী সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে বরিশালের পেয়ারা বাগানে সর্বহারা পার্টি গঠন করে সমগ্র বাংলাদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের সূত্রপাত করা হয়েছিল। প্রতীয়মান হয়, স্বাধীনতার পরে বামপন্থীরাই বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে রাজনৈতিকভাবে কিছু আলেম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে তাদের ভুল মত দিয়েছিলেন। অথচ আমরা জানি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী সা: মক্কায় ইসলাম প্রচারের দীর্ঘ সময়ে অবিশ্বাসীদের ভ্রান্ত মতাদর্শের বিরুদ্ধে কখনোই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেননি। কারণ তিনি জানতেন, নগণ্য মুসলমানদের নিয়ে এই সশস্ত্র সংগ্রামের পরিণতি কখনোই শুভ হবে না।

মহানবী সা: মদিনাতে হিজরতের পর অনুকূল পরিবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের রহমতে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। সে কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনসাধারণকে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করা আসলে মহানবী সা:-এর আদর্শের পরিপন্থী যা আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল। অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কোনো ‘ইসলামী দল’ স্বাধীনতার বিপক্ষে কার্যত মতামত প্রকাশ বা অবস্থান গ্রহণ করেনি। তারা সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অনুকূলে তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। আমরা আরো জানি, বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ দিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে ইসলামী মূল্যবোধের বিপক্ষে কিছু বুদ্ধিজীবী অবিরত প্রচার করে চলেছেন আসলে তার কোনো ভিত্তি নেই। বস্তুনিষ্ঠভাবেই নিরুপিত হওয়া প্রয়োজন, কে প্রকৃত দেশপ্রেমিক।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement