ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা
- ড. হাফিজ মুজতাবা রিজা আহমাদ
- ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৫৫
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অনাচার চরম আকার ধারণ করেছে। হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, সুদ-ঘুষ, প্রতারণা-প্রবঞ্চণা, অপহরণ ও মিথ্যাচার অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নৈতিক সঙ্কটের নির্দেশক। সমাজের বৃহৎ অংশ যখন নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা ইত্যাদিকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে এবং জুলম, নিপীড়ন, জবরদখল, শোষণ ও দুর্নীতিকে ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তখন বুঝতে হবে নৈতিক সঙ্কট বিরাজমান। অন্য দিকে তথ্যপ্রযুক্তি তথা ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইন্টারনেট এগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, শুধু তরুণ-তরুণীরা নয়; বরং যেকোনো বয়সের ব্যক্তিরাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সময় অতিক্রম করতে দ্বিধাবোধ করে না। এভাবে সর্বস্তরের ব্যবহারকারীরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অপব্যবহারের দিকেও ঝুঁকে পড়ছে। বর্তমান নেট দুনিয়ায় পাবজি (প্লেয়ার আননোনস ব্যাটেল গ্রাউন্ড) নামক এক ধরনের ভিডিও গেম রয়েছে, যাতে কে কতজন হত্যা করল, কত পয়েন্ট পেল, জীবিতদের কিভাবে হত্যা করা যায়, এসবই হচ্ছে মূল আকর্ষণ। এ খেলায় কিশোর-কিশোরী ও যুবসমাজই বেশি জড়িত। করোনাকালে এ ধরনের ভিডিও গেমের ব্যবহার বেড়েছে অনেকাংশে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা তৈরি করছে নিজেদের একটি বলয়। পরিণামে দূরত্ব বাড়ছে মাতা-পিতা ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে। একাকিত্ব এবং যান্ত্রিক জীবনই তাদের সঙ্গী হচ্ছে। ডিজিটাল মাদকে আসক্ত ছেলেমেয়েরা বাস্তব জীবন থেকে বের হয়ে এক কল্পনাজগতে বসবাস শুরু করে। বাধাগ্রস্ত ও পরিবর্তন হয় তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ। তারা জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা খুঁজে ফিরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের জগতে। স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মতো গুণগুলো হারিয়ে যেতে থাকে তাদের মধ্য থেকে। নিজেকে ছাড়া পরিবারের, সমাজের সদস্যদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ লোপ পায় এবং নিজেদের অজান্তেই আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে ওঠে। বাস্তবজীবনের পরাজয়কেও তারা মেনে নিতে পারছে না। এমনকি তারা নিজেকে এবং নিজের জীবন নিয়েও সন্দেহ-অবিশ্বাস ও আশাহীন হয়ে পড়ছে। ফলে তারা জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মে। শিশু-কিশোর ও কোমলমতিদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী এবং সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার নৈতিকতার আবশ্যকীয়তা বুঝে ইসলাম শিক্ষা বইয়ের নাম পরিবর্তন করে নাম রেখেছে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’। সে জন্য মাননীয় সরকার প্রধানকে সাধুবাদ জানাই। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে শিক্ষার সর্বস্তরে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ প্রত্যাশিত। কিন্তু সর্বস্তরে তো নেই; বরং স্কুল-কলেজ পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক হিসেবে যে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয় রয়েছে, তা আজ অবহেলিত ও সঙ্কুচিত। উল্লেখ্য, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদফতর কর্তৃক নির্দেশিত পাঠ্যপুস্তকের আলোকে মূল্যায়ন নির্দেশনায় অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুতি ও জমা দানের ক্ষেত্রে নবম শ্রেণীতে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়ে এখন পর্যন্ত অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত ও স্কুলে জমা দানের নির্দেশ দেয়া হয়নি, যেখানে অন্য প্রায় সব বিষয়ে দেয়া হয়েছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং ডিজিটাল মাদক নামক এই ভয়াবহতা থেকে একমাত্র ‘ইসলামী শিক্ষা’ই রক্ষা করতে পারে। কেননা এ শিক্ষা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব কুরআন মাজিদের সার্বিক দর্শনের ভিত্তিতে রচিত। আর এ লক্ষ্য সামনে রেখেই শিক্ষার উচ্চস্তরে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নেই নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রস্তাবিত ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগ সম্পর্কে কোনো কোনো মহলে প্রশ্ন তোলা হয়। এ সম্পর্কে নওয়াব আলী চৌধুরী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, অতীতের মুসলিম মনীষীদের চিন্তাধারা ও ইসলামের পুরোপুরি ইতিহাস সম্পর্কে মুসলিমদের অবশ্যই অবগত হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ে নিউ স্কিম মাদরাসা স্থাপন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিউ স্কিমের ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগে প্রবেশ করলে এমন গ্র্যাজুয়েশন লাভ করবে, যা সেই বিভাগের গ্র্যাজুয়েটদেরকে উত্তম প্রশাসনিক চাকরি-বাকরি লাভ বা শিক্ষা পেশা অবলম্বনে উপযোগী করে তুলবে এবং আশা করা যায়, এরা অন্যান্য বিভাগের গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কোনো অংশেই কম হবে না। এই নিরিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইসলামিক স্টাডিজ বোর্ড’ রাখারও যৌক্তিকতা রয়েছে (দ্য কলকাতা গেজেট)। নওয়াব আলী চৌধুরী আরো বলেন, এই বিভাগের গুরুত্বের তাগিদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলে এর বিশেষ উল্লেখ থাকা আবশ্যক। সুতরাং ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অভিনব সৃষ্টি। এর আগে উপমহাদেশের কোথাও এমন নজির বিদ্যমান ছিল না। চৌধুরী সাহেব ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগের ছাত্রদের জন্য একটি বৃত্তিরও ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিষয়টির জন্য একটি স্বতন্ত্র ফ্যাকাল্টি গঠনের জন্যও তিনি বক্তব্য পেশ করেন। এই উদ্যোগ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জোরালোভাবে ফুটে উঠে। সুতরাং তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী (কলা) পর্যন্ত ‘ইসলাম শিক্ষা’ বাধ্যতামূলক হওয়া অতি আবশ্যক এবং প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায়ও এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি অত্যাবশ্যক।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা