১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মদিনা রাষ্ট্র, মদ এবং কবিতা

মদিনা রাষ্ট্র, মদ এবং কবিতা - ছবি : অন্য দিগন্ত

উর্দু কবিতা ও পাকিস্তানের রাজনীতির মাঝে সম্পর্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। মির্জা গালিব প্রায় ২০০ বছর আগে এমন কিছু কবিতা লিখে গেছেন, যেখানে আজকের পাকিস্তানি রাজনীতির চিত্র লক্ষ করা যায়। কে জানে না, ইমরান খান যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন বলতেন, যদি আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হই, তা হলে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের চেয়ে আত্মহত্যাকে প্রাধান্য দেবো। ইমরান খান বাস্তবিকই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং তিনি আইএমএফের সাথে একটি নতুন চুক্তি করে ঋণও নিয়েছেন। ইমরান খান যখন আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন, তখন মির্জা গালিবের এই কবিতা আমাকে খোঁচা মারতে থাকে- কারজ কি পিতে থে মেই লেকিন সামাঝতে থে কে হ্যাঁ/রাঙ্গ লাভেগি হামারে ফাকা মাসতি এক দিন- অর্থাৎ ঋণ করে মদপান করত, কিন্তু ভাবত, হ্যাঁ/একদিন আমাদের দারিদ্র্য রঙ আনবে।

আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের কথা তো এখন বেশ পুরনো হয়ে গেছে। শুকরিয়া যে, ইমরান খান আত্মহত্যা করেননি। কেননা ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ আত্মহত্যা হারাম। এ রাষ্ট্রে আরো অনেক কিছু হারাম। বর্তমানে আমার ইঙ্গিত অভিযোগ ও বদনামের রাজনীতি এবং সুদ খাওয়ার দিকে নয়, বরং আমার ইঙ্গিত মদপানের দিকে। পাকিস্তানে জবাবদিহিতার দফতর ‘নিব’ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারকে ১২ আগস্ট তলব করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে লাহোরের একটি হোটেলে স্থাপিত মদের দোকানের জন্য মদের অবৈধ লাইসেন্স ইস্যু করিয়েছেন। উসমান বুজদারের এই তলবকে কেন্দ্র করে আবদুল হামিদ আদমের এই কবিতাটি মনে পড়ে গেল- সাকি মুঝে শারাব কী তোহমাত নেহিঁ পাসান্দ/মুঝ কো তেরি নিগাহ কা এলজাম চাহিয়ে- সাকি, শরাবের অপবাদ আমার পছন্দ নয়/আমি তোমার দৃষ্টির অভিযোগ চাই।

উসমান বুজদারকে রক্ষা করতে দাবি করা হচ্ছে যে, লাহোরের একটি হোটেলকে তো এক্সাইজ ট্যাক্সেশন বিভাগ মদের লাইসেন্স ইস্যু করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী এ লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ লাহোর হাইকোর্টের মাধ্যমে এ লাইসেন্স পুনর্বহাল করে নিয়েছে। সুতরাং বুজদারের ওপর আরোপিত অভিযোগ মিথ্যার ঝুড়ি। নিবের পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদদের ওপর আরোপিত সব অভিযোগকে ‘মিথ্যার ঝুড়ি’ই অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ কারণে বুজদারেরও এ অধিকার আছে যে, তিনি নিবের অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করবেন। কিন্তু এ বিষয়ে তার পক্ষে প্রদত্ত যুক্তি শুনে জালাল লাক্ষৌবীর এ কবিতা মনে পড়ে গেল- শাব কো মেই খুব সি পি সুব্হ কো তাওবা কারলি/রেন্দ কে রেন্দ রাহে, হাথ সে জান্নাত না গায়ি- অর্থাৎ রজনীতে প্রচুর মদপান করে সকাল বেলায় তওবা করেছে/মদপানও হলো, জান্নাতও হলো না হাতছাড়া।

উসমান বুজদার সিন্ধুর নয়, বরং তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পিপলস পার্টির নন, বরং তেহরিকে ইনসাফের। দলটির দাবি হচ্ছে, তারা পাকিস্তানকে মদিনা রাষ্ট্র বানাতে ক্ষমতায় এসেছেন। উসমান বুজদারের দল জিগার মুরাদাবাদীর এ কবিতার আশ্রয় নিতে পারে না- গারচে আহলে শারাব হেঁ হাম লোগ/ইয়ে না সামঝো খারাব হেঁ হাম লোগ- অর্থাৎ যদিও আমরা মদ্যপ/এটা মনে করো না আমরা খারাপ মানুষ।

মদকে ‘সব অনিষ্টের মূল’ অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ চুপি চুপি মদপান করে থাকে। দিনের আলোতে মদপানের নিন্দা করে, আর রাতের আঁধারে মদের নেশায় ডুবে যায়। আরজ করতে চাই, হয় আপনারা ‘মদিনা রাষ্ট্রের’ কথাই বলবেন না। যদি মদিনা রাষ্ট্রের কথা বলেন, তা হলে মদের দোকানের লাইসেন্স মুখ্যমন্ত্রী প্রদান করুন, কিংবা অন্য কেউ; সেটা আর মদিনা রাষ্ট্র হতে পারে না। অথবা আপনারা সাগের সিদ্দিকীর মতো মেনে নিন, আপনারা কোনো ফেরেশতা নন- ম্যাঁয় আদমি হুঁ কোয়ি ফেরেশতা নেহিঁ হুজুর/ম্যাঁয় আজ আপনি যাত সে ঘাবরা কে পি গ্যায়া- অর্থাৎ আমি মানুষ, কোনো ফেরেশতা নই জনাব/আমি আমার প্রতি হতাশ হয়ে পান করেছি।

যদি আপনারা বাস্তবিকই ফেরেশতার খুব কাছাকাছি হয়ে থাকেন, তা হলে আমাদের এ কথা শোনাবেন না, মদের লাইসেন্স উসমান বুজদার নয়, অন্য কেউ ইস্যু করেছে।’ আমাদের জানা মতে, নিবের কাছে বুজদারের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ জমা আছে। কিন্তু বর্তমানে নিব তাকে শুধু মদের লাইসেন্স ইস্যু করানোর অভিযোগে তলব করেছে, যাতে জবাব দিতে তাকে বেশ সমস্যায় পড়তে না হয়। এটি কোনো গোপন কথা নয়, বুজদারকে প্রশ্নাবলিও বলে দেয়া হবে। তা হলে তিনি জবাব দিতে যথেষ্ট সময় হাতে পাবেন। মদের লাইসেন্স ইস্যু করা সম্পর্কে তলব করা তার জন্য শুধু একটা ইঙ্গিতমাত্র। যদি তিনি জ্ঞানী হয়ে থাকেন, তা হলে এ ইঙ্গিতেই বুঝে যাবেন। নতুবা আরো অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। ইনসাফের দাবি হচ্ছে, মদের লাইসেন্স ইস্যু করার বিষয়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীকে নয়, বরং ইসলামাবাদের সরকার গোষ্ঠীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। সবাই জানে, ইসলামাবাদের সরকারে এমন ব্যক্তিও যুক্ত আছেন, মদের বোতলকে ‘মধুর বোতল’ অভিহিত করতে যাদের কোনো জুড়ি নেই। আর যখন তেহরিকে ইনসাফের জাতীয় অ্যাসেম্বলির হিন্দু সদস্য ড. রমেশ কুমার বর্তমান জাতীয় পরিষদে মদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিল উত্থাপন করেন, তখন জেইউআই (এফ) ছাড়া আর কোনো দল বিলের প্রতি সমর্থন জানায় না।

ড. রমেশ কুমার তার বিলে বলেছিলেন, ইসলাম ও খ্রিষ্টানসহ সব বড় ধর্মে মদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং সংবিধানের ধারা ৩৭ সংশোধন করে মদকে অমুসলিমদের জন্যও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। কিন্তু তেহরিকে ইনসাফের সরকার তাদেরই দলের জাতীয় অ্যাসেম্বলির হিন্দু সদস্যের এই বিল আইন ও বিচারের স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। নির্মম পরিহাস দেখুন, সরকার ও বিরোধী দল জাতীয় স্বার্থের নামে কয়েকটি বিল চুটকি বাজানোর সামান্য সময়ের মধ্যেই পাস করিয়ে নিয়েছে। অথচ পাকিস্তানকে ‘মদিনা রাষ্ট্র’ বানানোর জন্য আইন প্রণয়ন করা যাচ্ছে না। যদি ড. রমেশ কুমারের ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পেশকৃত বিল পাস হতো, তা হলে লাহোরের একটি হোটেল কর্তৃপক্ষ মদের লাইসেন্সের জন্য আদালত থেকে স্থগিতাদেশ অর্জন করতে পারত না। লাইসেন্স যেই ইস্যু করুক, দায়দায়িত্ব তেহরিকে ইনসাফের সরকারের, যারা অমুসলিমদের জন্যও মদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বিল প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা অমুসলিমদের নামে মুসলমানদের মদপান চলতে দিতে হয়, আবার পাকিস্তানকে মদিনা রাষ্ট্র বানানোর দাবিও করতে হয়।

হতে পারে উসমান বুজদার ‘নিব’কে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু নিবের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পিছুটান পিছুটান ভাব রয়েছে। আর তেহরিকে ইনসাফের লোকেরা ইকবালের ভাষায় চোখে চোখ রেখে নিবকে জিজ্ঞাসা করছে- তেরে শিশে মেঁ মেই বাকি নেহিঁ হ্যায়/বাতা, কিয়া তু মেরা সাকি নেহিঁ হ্যায়, অর্থাৎ তোমার বোতলে মদ অবশিষ্ট নেই/বলো, তুমি কি আমার সাকি নও?

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১০ আগস্ট, ২০২০ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement